[প্রয়াত ‘দর্পণ’ পত্রিকায় এই লেখাটা ছাপা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় একযুগ আগে। এরই মধ্যে একে একে তিনটে অ্যালবাম বেরিয়ে গিয়েছে ব্যান্ড ‘দলছুট’ থেকে — ‘আহ্’, ‘হৃদয়পুর’, ‘আকাশচুরি’ — এবং সম্ভবত ‘স্বপ্নবাজি’ রিলিজ হয়েছিল এই লেখাটা ছাপার অব্যবহিত প্রাক্কালেই। স্বপ্নবাজি ছিল সঞ্জীবের জীবদ্দশায় রিলিজড একমাত্র সোলো সংকলন। তবে জীবনাবসানের বাদে এক – দেড়টা অ্যালবাম আরও বেরিয়েছে বোধহয় একক হিশেবে। সেগুলো অবশ্য পূর্ণাঙ্গ নয়, এক-দুইটা গান নতুন পাওয়া গেছে অ্যালবামগুলোর সুবাদে। এমনিতে সংগীতশিল্পী হিশেবে সঞ্জীবের ইনফর্ম্যাল পদচারণা আগে থেকে থাকলেও স্টুডিয়োরেকর্ডেড অ্যালবামের বিবেচনায় তার ফর্ম্যাল সংগীতশিল্পীজীবন সাকুল্যে একদশকের। ১৯৯৭ থেকে ২০০৭। ডেব্যু ‘আহ্’ রিলিজড ইন ১৯৯৭ এবং জীবদ্দশায় ‘জোছনাবিহার’ রিলিজড ইন ২০০৭ সঞ্জীবের লাস্ট অ্যালবাম। জোছনাবিহার বেরোনোর মাসখানেকের মধ্যে অনন্তলোক বিহারে বেরিয়ে পড়েন সঞ্জীব (Sanjeeb Chowdhury)। অগস্ত্য যাত্রার রাতে ব্যাপক ঘূর্ণিবায়ে দেশের পরিস্থিতি ছিল লণ্ডভণ্ড। সঞ্জীবপ্রয়াণের দিনটায় ‘সিডর’ ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত সঙ্গিন।
বলছিলাম, অধুনালুপ্ত ‘দর্পণ’ পত্রিকায় লেখাটা ছাপা হয়েছিল ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে। লিখেছেন আরিফ জেবতিক। সঞ্জীব চৌধুরীর (Sanjeeb Chowdhury) সঙ্গে একান্ত কথাবিনিময়ের মাধ্যমে লেখাটা গড়ে উঠেছে। একটা আখ্যানের আদল পেয়েছে লেখাটা। গল্পচ্ছলে এক অন্তরঙ্গ সঞ্জীবপোর্ট্রেট। মূলত সঞ্জীবের ব্যক্তিমুখটুকু ক্যাপ্চার করার দিকেই ছিল রচনাকারের ঝোঁক। সঞ্জীবসংগীত নিয়া, গীতিকার সঞ্জীব নিয়া, বা সঞ্জীবের সুরায়োজন নিয়া আরিফ জেবতিক এইখানে কথা খর্চা করেন নাই। ফিচার রাইটিঙের একটা সুন্দর নমুনা হিশেবে এই রচনা তৎকালে আমাদের নজর কেড়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সঞ্জীব চৌধুরী নিউজপেপারে চাকরির সুবাদে পোস্ট-নাইন্টিজের তারুণ্যভরা বাংলাদেশের সংবাদজীবিতায় ফিচার রাইটিঙে ব্রেকথ্রু এনেছিলেন। সঞ্জীবের ফিচারধাঁচ ফলো করে সেকালের বিনোদনসাংবাদিকতায় নয়া হাওয়া এসেছিল।
পয়লা ছাপাকালে এই রচনার শিরোনাম ছিল ‘সঞ্জীব চৌধুরী : আমাদের এক স্বপ্নবাজ গায়েন’; সচিত্র রচনার সঙ্গে তিনবাক্যে একটা ছোট্ট বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছে দেখতে পাচ্ছি : “বৃহত্তর সিলেটের আউলবাউল ঘরানার এক সার্থক উত্তরাধিকার আজকের জনপ্রিয় গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী। হবিগঞ্জের বানিয়াচঙের ছেলে সঞ্জীব চৌধুরী গায়ক হয়ে ওঠার কাহিনি গল্প-উপন্যাসের মতোই আকর্ষণীয়। দর্পণের পাঠকদের জন্য সেই অজানা কাহিনিই তুলে ধরছেন আরিফ জেবতিক। আর ক্যামেরায় ক্লিক করেছেন তরুণ সাংবাদিক হাসান বিপুল।” বলা প্রাসঙ্গিক হবে, ‘দর্পণ’ ছিল একটি নিয়মিত মান্থলি; সিলেট থেকে বেরোত। রঙিন প্রচ্ছদে এবং ভিতরের সজ্জায়-বিন্যাসে এই পত্রিকাটা সেই-সময় বেশ সমাদৃত হয়েছিল পাঠক ও ক্রেতা সাধারণের মধ্যে। যে-সংখ্যা থেকে এই রচনাটা আমরা সংগ্রহ করছি, প্রিন্টার্স লাইনে দেখা যাচ্ছে সেইটা সেপ্টেম্বর ২০০৪ সনের, বর্ষ ১৩ সংখ্যা ৯ এবং পুরানলেন জিন্দাবাজার সিলেট থেকে প্রকাশিত।
‘দর্পণ’ পত্রিকাটা গানপারের নিজস্ব মোহাফেজখানায় ছিল সযত্ন সংরক্ষিত। কম্পোজ করা হয়েছে সেখান থেকে; এবং প্রয়োজনীয় প্রুফ দেখেশুনে এইটা ছাপানোর আগে লেখকের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি আমরা। আরিফ জেবতিকের অ্যাভেইলেবল ফেসবুকপাতায় ইনবক্স করে লেখাটা ছাপানোর ব্যাপারে অনাপত্তি প্রার্থনা করে রেখেছি গানপার তরফে, এইটা আপ্লোডমুহূর্ত পর্যন্ত ইনবক্সের রিপ্লাই পাওয়া না-গেলেও পাবো বলে আশা রাখি। প্রিন্ট পত্রিকা থেকে অনলাইন মাধ্যমে পুনঃপ্রকাশের একটা কারণ হচ্ছে এ-ই যে, এই চমৎকার রচনাটা গায়েন সঞ্জীবের সুরমুগ্ধ সবাইকে পড়ানো।
সঞ্জীব চৌধুরী প্রয়াণের একদশক পূর্ণ হয়ে গেল দেখতে দেখতে। পেশাজীবনে সাংবাদিক হিশেবে সঞ্জীব চৌধুরী শিল্পীপরিচয়ের আগে থেকেই ছিলেন স্বনামে খ্যাত। ঝড়ের গতিতে এসে একদশকের স্বল্পসীমায় বাংলা গানে অমোচনীয় একটা ছাপ রেখে যেতে পেরেছেন বলা বাহুল্য। ঝড়েরই এক রাতে এই পৃথিবীর মায়া ছাড়িয়ে গেছেন অফেরা আনভুবনের বাটে। এই রচনাটা ছাপানো ও প্রচারের মধ্য দিয়া আমরা তার প্রয়াণবার্ষিকীতে স্মরণ করছি তাকে শ্রদ্ধায়, সুরে এবং সোল্লাসে। — গানপার]
_____________________________________
আমাদের এক স্বপ্নবাজ গায়েন
প্রথম প্রকাশ / সেপ্টেম্বর ২০০৪
প্রকাশস্থল / দর্পণ (মাসিক) বর্ষ ১৩ সংখ্যা ৯
রচয়িতা / আরিফ জেবতিক
সংগ্রহ ও ভূমিকা / গানপার
_____________
হবিগঞ্জের জালালী কইতর
সুনামগঞ্জের কুড়া
সুরমা নদীর গাঙচিল আমি
শূন্যে দিলাম উড়া।শূন্যে দিলাম উড়া রে ভাই
যাইতে চান্দের চর,
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি
কইলকাত্তার উপর।তোমরা আমায় চিনোনি
তোমরা আমায় চিনোনি …
সেই কবে, দেশভাগের সময়, আমাদের সিলেটের এক কবিয়াল তার জীবনের পথচলায় কলকাতা ভেসে গিয়েছিলেন, তারপর আর তার ফেরা হয়নি পিতৃভূমে। তবু বাকিটা জীবন তিনি কেঁদে কেঁদে ফিরেছেন হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ আর সিলেটের মাটির জন্য। আকুল হয়ে গেয়েছেন, — ‘তোমরা আমায় চিনোনি?’
নাহ্, তিনি সঞ্জীব চৌধুরী নন, তিনি অন্য আরেকজন। তবু যখন এক মেঘমেদুর বিকেলে আমরা আজকের দলছুট গায়ক সঞ্জীব চৌধুরীকে খুঁজে বের করে মুখোমুখি বসি, সেই চান্দের চরের গায়কের কথা আমাদের মনে পড়ে যায়।
সঞ্জীব চৌধুরী, আজকের বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম গায়কদের একজন। তবু ঝকঝকে তকতকে গায়কদের ভিড়ে তিনি আলাদা এক মানুষ। সেলিব্রিটির মুখোশটা তার মুখে আঁটে না, তাই মুখোশ ফেলে রেখে মুখটাকে ভাসিয়ে রাখেন সঞ্জীব। প্রতিষ্ঠা আর জনপ্রিয়তার ইঁদুরদৌড় থেকে বহু দূরে তার সহজাত অবস্থান। সত্যিই যেন এক দলছুট। তাই ঘরোয়া আড্ডায়, টেবিলে তবলা ঠুকে তার উত্তাল গলাটা যত সহজলভ্য, সাক্ষাতকার প্রদানে তটটাই বিরক্ত। আমাদের তাই কথা বলতে হয় কৌশলে। আর সেই কথার ফাঁকেই উঠে আসে শৈশব, কৈশোর, সংগ্রাম আর জীবনযুদ্ধের গল্প। অজানা এক সঞ্জীব চৌধুরী উঠে আসেন আমাদের মাঝে …
বানিয়াচঙের দরিয়া
সঞ্জীব চৌধুরীর জন্ম ২৫ ডিসেম্বর। হবিগঞ্জের বানিয়াচঙে আক্ষরিক এক অজপাড়াগাঁতে, পঁচ ভাই আর চার বোনের সংসারে সঞ্জীব ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। শৈশবের সেই বানিয়াচঙই নষ্ট করেছে তাকে। তার যে বাউলিয়ানা, যে উদাসী অবয়ব, অনেকের মাঝে থেকেও যে নিয়ত নিঃসঙ্গতা — তা সে বানিয়াচঙের দান।
বানিয়াচঙ, সেখানে বর্ষায় শুধু ধূ ধূ জল, জলেরই তেপান্তর। ছোট ছোট গ্রামগুলো হাওরের বুকে যেন ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপ। অগনন পাখির ডানায় যে ‘হুম হুম’ শব্দ সঞ্জীব চৌধুরীকে ঘুম ভাঙিয়ে দিত কুয়াশার ভোরে, সেই পাখির ডানার শব্দ তার আজও মন থেকে যায় না। বহুদূরে, দিগন্তেরও সীমারেখা মাড়িয়ে নাম-না-জানা পাহাড়, সামনে হাওরের আকুল জলরাশি, উত্তাল বাতাসের ঝাপটায় এলামেলো মুখ-চোখ — কী সাধ্য সঞ্জীবের ঘরে বসে থাকার? ছোট্ট কিশোর যদি ডিঙ্গি ভাসায় অথৈ জলে, তবে তার বাউল হওয়ার বাকি থাকে কী?
সঞ্জীবকে চৌধুরীকে তাই আজও স্পর্শ করতে পারেনি ঢাকার যান্ত্রিকতা। শৈশব তাকে দাগ কেটে গেছে ভীষণ। অবলীলায় তাই স্মরণ করতে পারেন মাইকে-শোনা প্রথম গান, — ‘ও দাইমা, কিসের বাদ্য বাজে গো?’
সেই বাদ্য, সেই করুণ গানই তিনি ঠোঁটে তুলে নেন। পড়াশোনা ফেলে পড়ে থাকেন এখানে-ওখানে। রাত জেগে শোনেন গ্রামীণ কথকের গল্প, চাটাইতে গুটিশুটি মেরে বসে রাতের পর রাত যাত্রাপালায় কাটিয়ে দেন। নিজেও ঢোল-করতাল-মন্দিরা নিয়ে উঠোনে বসে পড়েন একেকদিন। পরিচিত মহলে গায়েন হিসেবে পরিচিতিও জোটে কিছুটা। সেই পরিচিতি তাকে খুশি করলেও, লেখাপড়াটা গোল্লায় গেছে ভেবে অভিভাবকরা এবার তাকে পাঠিয়ে দেন হবিগঞ্জ শহরে। বড় ভাইবোন এখানেই তখন পড়াশোনা করছেন। সঞ্জীবকে প্রথম ভর্তি করা হলো নাতিরাবাদ পাঠশালায়। এর কিছুদিন পর তার ঠাঁই হলো বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে।
যাত্রা আর পালাগান থেকে বহুদূর চলে এলেও এবার তার সঙ্গী রেডিও। ‘বিবিধ ভারতী’ অনুষ্ঠানের ‘নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা’ কিংবা রেডিও শিলং-এর হিন্দি গান হুবহু ঠোঁটস্থ করে করে সঞ্জীব গায়কই রয়ে গেলেন। এবার হস্তক্ষেপ করলেন বড় ভাইবোনেরা। হবিগঞ্জের পালা চুকিয়ে সঞ্জীব চৌধুরীকে নিয়ে আসা হলো ঢাকায়। বকশীবাজারের নবকুমার ইনস্টিটিউটে ক্লাস এইটে ভর্তি হলেন তিনি। কিন্তু এখানেই তার জীবন বাঁক নিলো প্রথমবার।
আমরা যদি স্বপ্ন দেখি, কার তাতে কী
ক্লাস এইটের সঞ্জীব চৌধুরীর সঙ্গে ক্লাস সেভেনের উদাসী সঞ্জীবের খুবই তফাৎ। সেই তফাৎ জীবনকে দেখায় তার অনুভবে। কিশোর সঞ্জীব তখন সুকান্তের উত্তরাধিকার। মেতেছেন বামপন্থী রাজনীতিতে ‘ছোটদের রাজনীতি’ দিয়ে শুরু করে মার্ক্স, লেলিন, এঙ্গেলস, মাও সেতুং, শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস আর কৌশল চর্চায় দিনমাস কেটে যায়। ছাত্র ইউনিয়নের সার্বক্ষণিক কর্মী সঞ্জীবকে তবু গান পিছু ছাড়ে না। বড়বোন তাই তাকে নিয়ে এলেন ছায়ানটে। গানটা অন্তত ভালোভাবেই শিখুক। তবু ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের রক্তচক্ষু এড়িয়ে তিনি পলাতক। ক্লাসিক্যাল চর্চার চেয়ে মঞ্চে উঠে গণসঙ্গীত গাওয়ার প্রতিই তার ঝোঁকটা বেশি।
শুভ্র আর তার সোনালি গিটার
এসএসসি পাশ করে আবারও মেধাবী ছাত্রদের আড্ডাখানা ঢাকা কলেজে সঞ্জীব চৌধুরী ভর্তি হলেন। তবে তার আড্ডা গান নিয়েই। খুব কাছের কিছু গানওয়ালা বন্ধু জুটল এখানে। তখনকার তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘ফ্রিজিং পয়েন্ট’ আর সঞ্জীব চৌধুরী সুরের আড্ডায় সঙ্গী। ফ্রিজিং পয়েন্টে তখন কাজ করছেন নিলয় (বর্তমানের সবচেয়ে শক্তিশালী গিটারবাদক) শুভ্র সহ তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা। একসঙ্গে ওঠাবসা, নাওয়াখাওয়া; কিন্তু চূড়ান্ত পথ ভিন্ন। অন্যরা ব্যান্ডসংগীতে, আর সঞ্জীব চৌধুরী তখনও গণসংগীতকে আঁকড়ে ধরে। সঞ্জীবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শুভ্র পরবর্তীকালে প্রবাসে মারা যান। সঞ্জীবের একটি জনপ্রিয় গান ‘ওকে দাও ফিরিয়ে দাও তার সোনালি গিটার’ সেই শুভ্রকে ভেবেই লেখা।
আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই
“ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম অঙ্কে কিন্তু ডিপার্টমেন্টের অধিকাংশ ক্লাসগুলোই ছিল সকালবেলা। সকালে ঘুম থেকে উঠতে বিরক্ত লাগত। তাই দু-বছর পর ছেড়ে দিলাম ডিপার্টমেন্ট” — জ্বি, এটাই সঞ্জীবের নিজের কথা। শুধু ঘুম থেকে উঠতে ভালো লাগে না বলেই ভার্সিটি ছেড়ে দিতে পারে কেউ — এটা বিশ্বাস করা কষ্ট। কিন্তু সঞ্জীবের কাছে ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। তাই বলে ভার্সিটির চৌকাঠ ডিঙিয়ে একবারে বেরিয়ে এলেন না। বেছে বেছে বের করলেন সবচেয়ে কম ক্লাস আছে কোন ডিপার্টমেন্টে। সেটা সাংবাদিকতা বিভাগ। ব্যাস, ভর্তি হলেন এখানেই। আর বাকি সময়টা কেটে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার তুখোড় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘স্বরশ্রুতি’-তে। এদিকে ডাকসু নির্বাচনে সাংস্কৃতিক সম্পাদক বিজয়ী হয়েছেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু অশোক কর্মকার, সেই সঙ্গে সঞ্জীবের কর্মব্যস্ততাও বেড়ে গেল।
স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তখন পুরো দেশ উত্তাল। সে-আন্দোলনের অগ্রসারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। আর প্রতিটি মিছিলে, মিটিঙে, প্রতিবাদ আর বিক্ষোভে অনিবার্য উপস্থিতি সঞ্জীব চৌধুরীর। পাগলের মতো গান লিখছেন, সুর দিচ্ছেন আর গেয়ে চলেছেন এখানে-সেখানে। ঝাকড়া চুলে সঞ্জীব গেয়ে চলছেন, “বিশ্বাস করুন বন্ধুগণ, আমি বলতে চেয়েছিলাম সেইসব কথা। কিন্তু আমাকে চুপ করিয়ে দেয়া হলো … আমাকে বলা হলো — খামোশ!” হয়তো সেই জনসভার আরেক কোণে তখন চলছে লাঠিচার্জ আর টিয়ারগ্যাস। একটু পরেই গলায় হারমোনিয়াম বাঁধা সঞ্জীব হয়তো আর তিষ্ঠোতে পারলেন না — পালিয়ে রওনা দিলেন অন্য জনসভায়।
এরই মাঝে আন্দোলন-সংগ্রামের দিনপঞ্জি নিয়ে বেরিয়েছে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘রাশপ্রিন্ট’। বইয়ের একটি গল্প বাংলা অ্যাকাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘আশির দশকের শ্রেষ্ঠ গল্প’ হিসেবে তালিকাভূক্ত হয়েছে।
কিন্তু কোনোদিকেই ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁর। এসব দেখেশুনে শুভানুধ্যায়ীরা ভাবলেন ছেলেটির একটি গতি করা দরকার। ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় একদিন সিনিয়র ভাই নাইমুল ইসলাম খানের মুখোমুখি পড়ে গেলেন সঞ্জীব। নাইমুল সঞ্জীবকে বললেন, “নতুন একটি পত্রিকা বের করব। অন্যরকম পত্রিকা, আয় কাজ করি।”
পেশাগত জীবনে এভাবেই সাংবাদিকতায় পা রাখলেন সঞ্জীব চৌধুরী। শুরু করলেন ‘আজকের কাগজ’ দিয়ে। এরপর ‘ভোরের কাগজ’-পর্ব পাড়ি দিয়ে … এখন ‘যায় যায় দিন’ পরিবারের সাথে যুক্ত।
দলছুট দুইজনা
প্রতিষ্ঠার পেছনে না-ছুটেও প্রচারবিমুখ সঞ্জীব চৌধুরী আর বাপ্পা মজুমদার হইচই ফেলে দিলেন তাদের ব্যান্ড ‘দলছুট’ নিয়ে। ‘দলছুট’ প্রথম থেকেই ব্যতিক্রম। ব্যান্ডের স্থায়ী সদস্য মাত্র দুইজন। অথচ তারাই গান লেখেন, সুর করেন, গেয়েও বেড়ান। বাপ্পার সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরীর পরিচয় অনেকটা ঘটনাচক্রেই। ঘনিষ্ঠতা আরো অনেক পরে। অশোক কর্মকারের ‘কালরাত্রি’ নামের নিবেদনে ১৮ মিনিটের সূচনা-সংগীতটি তৈরি করলেন দু-জন মিলে। কাজ করতে করতেই বুঝতে পারলেন, তাদের বোঝাপড়াটা চমৎকার। ব্যস, প্রায় আড্ডার ছলেই তৈরি হলো গানের দল ‘দলছুট’। আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো শুভানুধ্যায়ী ক’টি ভাইয়ের উৎসাহে এবং তাগিদে প্রথম ক্যাসেট ‘আহ্’।
ক্যাসেট তো বের হলো, কিন্তু ক্যাসেটের প্রচারণায় কোনো পক্ষেরই উৎসাহ নেই। না প্রকাশকের, না গায়কদের। তখন ভোরের কাগজে কাজ করেন সঞ্জীব চৌধুরী, আর সেই পত্রিকাতেই কলাম লেখেন ‘শুভেচ্ছা’ ম্যাগাজিনের পরিকল্পক-উপস্থাপক আব্দুন নূর তুষার। তুষারই ধরেবেঁধে গান রেকর্ড করলেন দলছুটের, ক্যাসেট বের হওয়ার আট মাস পরে। বিটিভিতে প্রচারিত হলো দলছুটের প্রথম গান ‘শাদা ময়লা রঙ্গিলা পালে’ …। দলছুটের পালেও লাগল জনপ্রিয়তার বাতাস। আর পিছু ফিরতে হয়নি তাদের।
একান্ত সঞ্জীব চৌধুরী
একজন একান্ত সঞ্জীব চৌধুরী কেমন? ঘনিষ্ঠজনদের কাছে তাঁর জন্য কোনো ভালো বিশেষণ তুলে রাখা নেই। রাগী, খামখেয়ালি, বাউন্ডেলে — এ উপাধিগুলো তার জন্মগত উত্তরাধিকার যেন। তবু সঞ্জীব কোথাও মায়াময়। মমতায় আর্দ্র তার অন্তর। কতকিছুই তাকে কাঁদায়, ভাবায়। দেশের বাউলশিল্পীদের জন্য কিছু করার তাড়না তাকে কুরে কুরে খায়।
যে-কোনো ভালো উদ্যোগে, সংগ্রামে কি শান্তিতে সঞ্জীবকে ডাকতে হয় না, নিজেই হাজিরা দেন। নিজের একক অ্যালবাম স্বপ্নবাজিতে লিখেছেন, “রাত ভেঙে বাড়ি ফেরা … ঢাকার রাতজাগা নিশিপাওয়া সবাই আমার বন্ধু। পরম আত্মীয়ের মতো তারা আমায় পৌঁছে দেয় বাড়ির আঙিনায়। নিশিরাতে হাঁকডাকে বিরক্ত হয় ঘুমওয়ালা মানুষ।”
যতই হাঁকডাকে বিরক্ত হোক সবাই, সঞ্জীব চৌধুরী তার হাঁকডাক থামান না। তিনি ‘ঘুরিয়া ঘুরিয়া’ তাঁর স্বপ্ন ফেরি করে বেড়ান। সে-স্বপ্নের কোনো শেষ নেই। একটা সুন্দর ভোরের স্বপ্ন, একটা চমৎকার গানের স্বপ্ন, মানুষের হৃদয়ের কোণে একটু ঠাঁই পাবার স্বপ্ন, শোষণহীন স্বদেশের স্বপ্ন, দুঃসংবাদবিহীন এক সংবাদপত্রের স্বপ্ন …। আর নিজের মনেই তাই বলেন, “কতকিছুই তো হারিয়ে যায়, তবু বেঁচে থাকে স্বপ্ন। আমাদের স্বপ্নগুলোই না-হয় তবে দীর্ঘজীবী হোক!”
… …
- আমাদের এক স্বপ্নবাজ গায়েন || আরিফ জেবতিক - November 18, 2017
COMMENTS