দাঁতি-লাগা জাড়ের রাত আটটা বাজবার ঠিক দশমিনিট আগে সরদার শওকত ইমাম সহসা তার হণ্টনসঙ্গীটিকে হতচকিত করে দিয়ে মর্চুয়ারিট্রের বরফধোঁয়াচ্ছন্ন পুকুরে পড়ে যান।
বহু বহু বছর বাদে সেই পতনস্মৃতিটি পৃথিবীর লোকায়ত চৈতন্যে ফেরে ফের আরেকটা পতনজনিত শব্দের সূত্রে। এইটা ভাদ্র, অতএব শীতেরও দিরং নাই আর, তেরো না-হোক তেইশে শীত তো সমাসন্ন। ফলে এই বিবশ ভাদ্দুরে চ্যাপাশুঁটকিবিপন্ন গরমের দুপুরে পুকুরবক্ষে তালপতনের শব্দসূত্রে সেই বিধুর শীতের উজ্জ্বলতর অতীতে মানুষপতন মনে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিকতার সীমা খুব বেশি লঙ্ঘন করেছে বলা যাবে না। তারপরও শরীয়তপুর অরিজিনের সরদারজির স্মৃতিতে সেই ইন্সিডেন্ট ততটা দাগ কেটে থেকে গেছে কি যায় নাই বলাটা আপাতত সম্ভব হচ্ছে না।
তা, কত হবে, আট-দশ তো হবেই বছরের হিসাবে। বেশিও হতে পারে। এক্স্যাক্টলি ফিগারটা ২০০৫ হবার পক্ষেই স্মৃতির রায় যাচ্ছে। ভেন্যু, অকুস্থল, সুনামগঞ্জের প্রত্যন্তসীমার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা। ইউয়েনোকোয়ার্টারের পেছনে যে-কয়টা বিল্ডিং রয়েছে, যেগুলো ‘সীমান্ত’…‘দিগন্ত’… প্রভৃতি নামাঙ্কিত, সেগুলোরই একটা থেকে বেরিয়ে সহকর্মীর সঙ্গে শির্শিরানো জ্যোৎস্নায় শীতকম্পিত শরীরে জুব্বাজাব্বা চাপিয়ে সরদার চলছিলেন রাতের আহার সারতে। কোয়ার্টার থেকে আলমের হোটেল পর্যন্ত যেতে হেলেদুলে দশমিনিট লাগবে। খেয়ে ফিরে লেপের হিম খোড়লে ঢুকতে আধাঘণ্টা থেকে ফোর্টি মিনিটস লেগে যাবে। এইটাই ছিল প্ল্যান। হেনকালে সোজা সাগরে ভাসান। দুইজনে খেজুরালাপ করতে করতে হেঁটে যাচ্ছিলেন উপজেলাবাজারের আলম মিয়ার হোটেল আলম অ্যান্ড রেস্টোরেন্টের দিকে হেলানোদুলানো ভঙ্গিতে, এমতাবস্থায় নিঃশ্বাসপাশের সঙ্গীকেও সতর্ক করার সুযোগটি না দিয়ে ঝুপ্পুস শব্দ শুনিয়ে সরদার শওকত ইমাম পুকুরে পড়ে যান।
পতনে এই গল্প কেন শুধু, কোনো গল্পই বাঁচে না। গল্প বাঁচে তার উত্থানে। সরদার শওকত ইমাম উঠে আসেন অচিরে সেই ইউয়েনোর কোয়ার্টারের গেটের সামনের ফিশারিফিডে জ্যাবড়ানো কচুয়া কালার পুকুরের পেট চিরে। এবং অগত্যা ভাতের হোটেলে যাত্রার নাস্তি ঘটিয়ে ফের কোয়ার্টারেই ফিরতে হয় জামাজুতো বদলাবার নিমিত্তে।
বেঙ্গল প্যাটার্ন বিল্ডিংগুলোতে তো আংরেজদের ন্যায় ফায়ারপ্লেইস থাকে না দেয়ালের গায়ে সিন্দুকপ্রতিম, বিশ্বম্ভরপুর অঞ্চলে গ্যাসসংযোগ না-থাকায় লাকড়ির চুলা ছিল, ওই বিপত্তারণে লাকড়ির উনোনখানা কাজে লেগেছিল ব্যাপক। পাক্কা সাতটা চ্যালাকাঠ খর্চা করে সরদারজির তবিয়ত পূর্বাবস্থায় ফেরানো সম্ভব হয়েছিল।
পড়ে গিয়েছিলেন কেন সরদারজি? জীবনের প্রতি অভিমান কিংবা কোনো জয়শ্রীর প্রতি আক্রোশবশত? অভিমান বা আক্রোশ থাকতেই পারে এক বছর-ছাব্বিশের নবযুবার, সকলেরই থাকে যেমন বয়স তিরিশের পূর্বাব্দি। কিন্তু সরদারজির সঙ্গী পরে একটি রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে সেসবের কোনো আলামত অকুস্থলে পাওয়া যায়নি। দিনটি ছিল শুক্লপক্ষের। আর হাওরের জ্যোৎস্না যারা দেখেছেন, তাদেরকে তো বলতে হবে না বাকিটুকু; অথবা যারা দেখেন নাই ইহজন্মে হাওরজ্যোৎস্না, তাদের কাছে ঘটনাবর্ণনের ভাষা বাংলায় নাই; সাংবাদিক বা সাহিত্যিকরা পারতেন হয়তো উটকো রহস্যসাস্পেন্স জুতে দিয়ে ব্যাপারটা আরও খোলতাই করে তুলতে।
এমনিতে শীতের রাতে কিংবা দাবদাহের নিঝুম ছুটিদিনের দুপুরে নানাবিধ পতনের শব্দ হয় ভিটালাগোয়া পুকুরে। যেমন তালপতনের শব্দ, চালতাপতনের শব্দ, নারিকেলপতনের শব্দ, এমনকি মেহগনিগাছের কেঠো ফল পানিতে পড়ার একটা আলাদা ডিস্টিংক্ট সাউন্ড আছে শ্রুতিগ্রাহ্য।
পিনপতন নিস্তব্ধতা বলি যেমন আমরা, বাংলা বাগধারায়, তেমনি তালপতনের শব্দে এমন একটি বিষন্ন গম্ভীরতা আছে যা উপেক্ষার নয়। স্লাইটলি মিউজিক্যাল। সরদারজির জ্যোৎস্নাতাড়িত পুকুরপতনের শব্দ ও দৃশ্য ঔজ্জ্বল্যে আনপ্যারালাল আজও।
কোয়ার্টারের ঠিক সামনের পার্টে, ইউয়েনোর হাভেলির গা ঘেঁষে যেতে যেতে, এখনও কী দিঘিভুলানো পুকুরটা বা তার পাশাপাশি তিনতিনটা মাছফালানো পুকুর বিরাজে? এমএ মান্নানের দানবীয় উন্নয়ন থেকে রেহাই পেয়েছে এমন ঘটনা যদিও অতি বিরল ওই এলাকায়। সেইকালে তো বিশ্বম্ভরপুরে একটাও পথঘাট ছিল না, এন্ট্রি এবং এক্সিট করার ক্ষেত্রে নৌকাই ছিল ভরসা, আজকাল অনেককিছুই হয়েছে ডেভেলপমেন্ট।
হলেও, আঘাটায় ঘাট আর আপথে ব্যাপক পথ হলেও, সম্ভবত পৌষজ্যোৎস্নায় পুকুরপতন ওই একবারই সংঘটিত হয়েছিল মনুষ্যেতিহাসে।
জাহেদ আহমদ ২০১৬
- আশ্বিনা - October 6, 2025
- স্টোরি অফ অ্যা স্টেরিয়ো - October 4, 2025
- কার গান কে গায় - September 29, 2025
COMMENTS