টনি মন্টানা (Tony Montana) নামের ক্যারেক্টারটা আমাদের স্মৃতিতে কেমন করে থেকে যায়, একেবারেই রিয়্যাল এবং টর্চার্ড একটা পার্সনের ডাইমেনশন আকারে, এইটাই সিনেমায় ইন্ট্রেস্টিং লাগে। বেশিরভাগ থ্রিলারের বেলায় দেখবেন চরিত্রগুলা প্রায় একই রকম, বদলানো যায় একটার লগে আরেকটারে, ক্যারেক্টারগুলা ইন্টার্চেইঞ্জ করে নেয়া যায়। আর গ্যাংস্টার ম্যুভিগুলা বেশিরভাগই খিয়াল করবেন যে অ্যাকশনপ্রধান বা অ্যাকশনধর্মী, চরিত্রপ্রধান নয়। ক্যারেক্টারের পার্সনালিটি ডেভেলপ করার দিকটায় গ্যাংস্টার ম্যুভিগুলার নজর বিশেষ নাই। কিন্তু ‘স্কার্ফেইস’ ম্যুভিটা ব্যতিক্রম বলতে হবে এক্ষেত্রে। গ্যাংস্টার সিনেমার ধারায় স্পেশ্যালই বলতে হবে এরে, যেমন ‘গডফাদার’ (The Godfather), যেখানে একটা ‘খারাপ’ লোকেরে ফ্রেমবন্দি করা হয়েছে এবং তার ভিতরকার মানুষটারে এম্ফ্যাসিস দেয়া হচ্ছে আস্ত ম্যুভিজুড়ে। এবং বোধহয় এইটা আদৌ কাকতাল নয় যে মন্টানা ক্যারেক্টারটা পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন আল পাচিনো (Al Pacino), যিনি মাইকেল কর্লিয়োনি করেছিলেন গডফাদার সিনেমায়।
কিউবা থেকে অ্যামেরিকায় আসা আধপাগলা কিসিমের একটা মানুষ এই মন্টানা। ছায়াছবিটার প্রবেশদৃশ্যে এই তথ্যটা আমরা পায়া যাই যে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে যখন কিউবান শরণার্থীদের অ্যামেরিকায় ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়, ফিদেল ক্যাস্ট্রো তখন তার নিজের কায়দায় একটা ছোটখাটো প্রতিশোধ নেন স্বীয় ভূখণ্ডের সমস্ত অপরাধী দাগি আসামীদের কারাগার থেকে বের করে অ্যামেরিকায় পাঠাইতে থাকেন; গাদাগাদি কিউবান গারদ খালি করে দলে দলে দাগি দণ্ডপ্রাপ্ত ষণ্ডাগুণ্ডাদের সঙ্গে সে-দেশের বেকামা ভয়ার্ত লোকেরা পাড়ি জমাতে থাকে সীমান্ত পারায়া অ্যামেরিকায়। আমরা দেখতে পাই সীমান্ত পারাইবার সময় ইউএস ফেডারেল অ্যাইজেন্টদের মন্টানা ব্লাফ মেরে নাস্তানাবুদ করে ফ্যালে; এবং মন্টানা তার বাকি জিন্দেগি জুড়ে এই একটা কাজই নিরলস করে যেতে দেখব গোটা সিনেমায় — ব্লাফ। মন্টানার রিয়্যাল কোনো ক্যারেক্টার নাই, রিয়্যাল কারেজ বা যারে বলে সৎ-সাহস মন্টানায় গরহাজির, সিনেমায় এই বিবৃতিটাই প্রতিষ্ঠা পাইতে দেখি; যদিও ‘সচ্চরিত্র’ ও ‘সৎ-সাহস’ উভয় মানবিক গুণেরই ইল্যুশন পয়দাইতে দেখা যায় মাদক কোকেইনের প্রভাবে একদম অল্প সময়ের জন্য হলেও।
‘স্কার্ফেইস’ ম্যুভির নামকরণটা হাওয়ার্ড হক্সের (Howard Hawks ) ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে বেরোনো সমনামী সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত, ওই সিনেমার উপজীব্য ছিল আরেক জগদ্বিখ্যাত অপরাধী আল-কাপনের গোটা ক্যারিয়ার। হক্সের সিনেমাটা ওই সময়ের সবচেয়ে বেশি মারদাঙ্গাভরা গ্যাংস্টার ফিল্ম হিশেবে ইতিহাসগ্রাহ্য। তদ্রুপ ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে বেরোনো সমনামের ব্রায়ান ডি-পাল্মা (Brian DePalma) পরিচালিত ম্যুভিটাও উরাধুরা ভায়োলেন্সের কারণে সমালোচিত হয়েছিল। উভয় সিনেমাতেই নৃশংসতা আমদানি করতে হয় নাই, সিনেমানায়ক ও অন্যান্য চরিত্রগুলার যাপনধারা থেকেই সৃষ্ট সমস্ত খুনতৃষ্ণ সহিংসতা। আর এই দুই সিনেমাতেই হিংস্রতা খামাখা হানাহানির বাহন হয় নাই, কিংবা ম্যাসালা ম্যুভির শর্তে কেবল দর্শক-লোগো-কো মনোরঞ্জন-কে-লিয়ে এস্তেমাল করা হয় নাই ঢিশুমঢিশুম; বরঞ্চ আত্মধ্বংসী ক্রিয়াকলাপ যে কেমন ভয়ঙ্কর হতে পারে সেই জিনিশটাই চিত্রিত করবার গরজে অ্যাকশন-মাইরধইর-রক্তারক্তি আর কুরুক্ষেত্র-লঙ্কাকাণ্ড এসেছে। এই দুই ম্যুভিতেই ভিন্নকালের দুই গ্যাংস্টারের উত্থান ও পতন দেখানো হয়েছে; এই সিনেমা-দুইটারই আখ্যানভাগে গ্যাংস্টার নায়কদ্বয়ের সহোদরার প্রতি নিঃশর্ত মমতা দেখানো হয়েছে যা প্রায় নিউরোটিক অবসেশনের পর্যায়ে পড়ে, সোজা বাংলায় যা মনোবিকলনেরই নিশ্চিত উদাহরণ। তবু ১৯৮৩-র ‘স্কার্ফেইস’ কোনো অর্থেই আগেরটার রিমেইক নয়; শেষেরটা হক্সের সিনেমার চাইতে বরং ফোর্ড কপোলার ‘গডফাদার’-এর লগে তুল্য।
তুল্য, গডফাদারের লগে তুল্য, কেননা ব্রায়ান পাল্মার ‘স্কার্ফেইস’ আর মারিয়ো পুজোর উপন্যাস-উদ্ভূত কপোলার ‘গডফাদার’ উভয় সিনেমায় ক্রিমিন্যাল দুই প্রোট্যাগ্যনিস্টকে দেখানো হয়েছে একটা বিক্রয়যোগ্য ব্যক্তিপণ্য হিশেবে, দেখানো হয়েছে এমন এক সমাজে তারা কর্মরত যে-সমাজ খরিদ করতে চায় এই প্রায়-নিউরোটিক বিকলনগ্রস্ত অসহায় ব্যক্তিগুলাকে। আগের দিনে এদের খরিদ করা গেছে বেলেল্লা মদে-মাৎসর্যে। কর্লিয়োনি ফ্যামিলির ক্ষেত্রে এইটা সম্ভব হয়েছে জুয়া আর বেশ্যালয়ের বিনিময়ে। এক্ষেত্রে, ‘স্কার্ফেইস’-এর বেলায়, এর হাদিয়া কোকেইন। যদিও সব জায়গায় বার্তা আগেরটাই বহাল থাকতে দেখি : নিজের সম্পত্তি নিয়া বাড়াবাড়ি করে কেবল বোকা ভোদাইগুলাই। টনি মন্টানার ক্ষেত্রে একদম শুরুতে একটা সোজাসাপ্টা বাছাই করে নেবার অপ্শন/অফার হাজির দেখি; যে, সে কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা আর্ন করতে পারত, সৎ ও নিষ্ঠাবান থেকে বাসন-বর্তন ধোয়াপাখলার কাজ করেই নিজের গ্রাসাচ্ছাদন জোটাতে পারত। অথবা, দ্বিতীয় অপ্শন হিশেবে, সে পারে সংগঠিত অপরাধচক্রে ভিড়ে যেয়ে নিজের নিয়তি নির্মাণ করতে, বেআইনি ক্রিমিন্যাল সিন্ডিকেইটের কম্পিটিটরদের সবাইকে খুনাখুনির টেক্কায় কিস্তিমাৎ করে সবচেয়ে দামি গাড়ি আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় চোখকাড়া নারী নিজের করে পেতে এবং নাইটক্লাবের দারোয়ানের কাছ থেকে জুতাচাটা আনুগত্য জুটাইতে। টনি মন্টানারে তেমন-একটা থালাবাসন ধুইতে হয় নাই অবশ্য। টনি নিয়তিনির্মাণের দ্বিতীয় অপ্শনটারেই বেছে নিয়েছে।
এই সিনেমায় দেখতে পাবো মন্টানা কাজ করে সাউথ ফ্লোরিডার দিকটায়; সেখানকার ইলিগ্যাল ড্রাগ ট্রেইডের লগে লেপ্টালেপ্টি কারবার তার। সিনেমাটায় তারে, মানে টনি মন্টানারে, একপ্রকার অ্যানথ্রোপোলোজিক্যাল ডিটাচম্যান্ট থেকে দেখে গেছেন পরিচালক। মনে রাখতে হবে যে এইটা সেই কিসিমের সিনেমা নয় যেইগুলাতে ক্যারেক্টারেরা গায়ে লেবেল লাগায়া থাকে (যেমন ধরেন ‘বস্’, ‘লেফটেন্যান্ট’, ‘হিটম্যান’ প্রভৃতি সিনেমা) এবং চরিত্রগুলা টায়ে-টায়ে তেমনটা আচরণ করে যেমনটা আচরণে দেখতে চাই আমরা তাদেরে। এই সিনেমার ডিরেক্টর ডি-পাল্মা এবং তার চিত্রনাট্যকার অলিভার স্টোন () পুরা গ্যালারিভরা ক্যারেক্টার পর্দায় ঝুলিয়েছেন যাদের প্রত্যেকটাই একেকটা স্পেসিফিক ইন্ডিভিজুয়্যাল। সবচেয়ে ফ্যাসিনেইটেড ব্যাপার এই সিনেমার যেইটা তা হচ্ছে এইটা দেখতে বসে আপনি বুঝতে পারবেন যে কথিত ক্রাইম ম্যুভির ক্লিশে দেখতে বসেন নাই এইখানে, এমন কতিপয় মানুষের হাঁটাচলা-যাপনজীবন দেখতে বসেছেন যারা নাকি ক্রিমিন্যাল।
আল পাচিনো মন্টানা ক্যারেক্টারটারে বেহুদাই সিম্প্যাথেটিক করে তোলেন নাই সিনেমায়। তিনি মন্টানারে চেনাজানা মানুষের ভুলেত্রুটিতে স্খলনে সঙ্কল্পনে একাকার করে এঁকেছেন তার অননুকরণীয় অভিনয়প্রতিভায়। আঁকাটা, বাহুল্য বলা, হরিফায়েড ওয়েতেই সম্পন্ন করতে হয়েছে। টনি মন্টানা আমাদেরই চিনপরিচিত চেহারা, আমরাই তো মন্টানা। আমরা প্রায় প্রত্যেকেই। নিশ্চয় আমরা পয়সাপাতিওয়ালা হইতে চাই, হিম্মতি ক্ষমতাশালী হইতে চাই, ডিজায়ার-উস্কে-দেয়া সেক্সপার্টনার আমরাও তো চাই, প্রাসাদোপম বাড়িতে রোজ ঘুমাইতে চাই, চাকর-নফরের সভয় আদর-আনুগত্য সবই চাই। ড্রাগ ডিলিং ট্রেইডে এমনধারা লাইফস্টাইল সহজেই হাসিল করা যায়। কিন্তু এর ফলে যা হারায়া যায় তা হচ্ছে আপনার আত্মা। ড্রাগ বেচাবিকির রাস্তায় আত্মা বিকি দিতে হয় সর্বাগ্রে।
মন্টানা উক্ত সমস্তই পায় এবং পায়া হারায়। এই পাওয়া আর এই খোয়া-যাওয়া আগে থেকে প্রেডিক্ট করা যায় অনেকটাই। জিনিশটা আরও অন্যান্য সিনেমাসাহিত্যেও লভ্য। তবে যেই জিনিশটা স্কার্ফেসেই মিলেছে একদম অরিজিন্যাল তা হচ্ছে এই পাওয়া এই অর্জনটারে মন্টানা কী যে ফুর্তিতে এঞ্জয় করে! দুইটা দৃশ্য তো বলা যায় প্যাথেটিক একেবারে; এর মধ্যে একটায় দেখা যায় নাইটক্লাবে মন্টানা তার ব্লন্ড মিস্ট্রেস এবং বিশ্বস্ত অনুচর নিয়া আয়েশ করে কোকেইনে ডুবন্ত; তখন মন্টানা যে-অনুভূতি নিয়া হাজির হয় তা হচ্ছে কেবল প্রচণ্ড অসহিষ্ণু বিরাগ; অন্য একটা দৃশ্যে ডেসপারেইটলি মন্টানা সাহস আর শক্তি নিয়া জাগতে চাচ্ছে এবং তখন সাইডে থাকা একগাদা কোকেইনের দিকে সে এমনভাবে তাকায় যেন বেচারা অসহায়ভাবেই নিমজ্জিত এবং শ্বাস নিতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না।
‘স্কার্ফেইস’ সিনেমায় ক্রিমিন্যাল পার্সোন্যালিটিটারে পার্ফেক্টলি ক্যাপ্চার করা হয়েছে। এইটা নাইন্টিনথার্টিটুর সমনামী সিনেমার ট্র্যাডিশনটারে মেনে এক্সাইটিং একটা ক্রাইম পিকচার। এবং, পূর্বসূরি ‘গডফাদার’ ধারায়, একগুচ্ছ দুর্ধর্ষ সাপোর্টিং ক্যারেক্টারের প্রদর্শনী ‘স্কার্ফেইস’ যেখানে আছে অনুচর হিশেবে স্টিভেন বাওয়ার (Steven Bauer), ড্রাগের নেশা চাড়া দিয়া উঠলে একের পর এক ভুল প্রণয় এবং প্রেমিকে জড়ানো নারী মিশেল ফাইফার (Michelle Pfeiffer), অত কুচক্রী নয় এমন এক বস্ রবার্ট লগিয়া (Robert Loggia) এবং আছে পাচিনোর ছোটবোন হিশেবে ম্যারি এলিজাবেথ মাস্ত্রান্তোনিয়ো (Mary Elizabeth Mastrantonio) যে কিনা চায় নিজের শর্তে শেষ করে দিতে নিজেরে।
এই মানুষগুলারে নিয়াই, এই মানুষগুলার লগেই, জিন্দেগি কেটেছে টনি মন্টানার। আর ‘স্কার্ফেইস’ সত্যিকারের পতনবন্ধুর এক অভিযাত্রার কাহিনি যেখান থেকে ফেরত আসা যায় না প্রায়।
অনুবাদ : জাহেদ আহমদ ।। সূত্র : রজার ইবার্ট ওয়েবসাইট
অন্যান্য রজার ইবার্ট
জাহেদ আহমদ অন্যান্য
- কাব্য ও বিজ্ঞান || শ্রীঅশোকবিজয় রাহা বি.এ - January 14, 2025
- মুরারিচাঁদ কলেজ, অশোকবিজয় রাহা এবং একটি অগ্রন্থিত রচনা || মোহাম্মদ বিলাল - January 14, 2025
- জনতার কাব্যরুচির প্রতীক || ইলিয়াস কমল - December 14, 2024
COMMENTS