এই কবিতাবলির ভূমিকা : কবির শেষকৃত্য ও শ্মশানবন্ধুর স্বগতোক্তি
ধ্যান
যে চোখ দিয়ে দেখি, সে আমি নই
যে কান দিয়ে শুনি, সে আমি নই,
যে জিহ্বায় স্বাদ নিই, সে আমি নই,
এই শরীর কিংবা চিত্ত? এসবও আমি নই।
যা আমি দেখি তা আমি নই
যা আমি শুনি সেও আমি নই
যে গন্ধ আসে সে আমি নই
স্বাদ অথবা স্পর্শ তাও তো আমি নই।
আমি দৃষ্টি নই, শব্দ নই, গন্ধ নই
বিচার কিংবা স্বাদ অথবা মন — কিছুই নই,
নই আমি এই পৃথিবী কিংবা ওই আকাশ
জল অথবা বাতাস এসব কিছুই আমি নই।
চেতনাও নই আমি
বস্তুর বন্ধনে তেমনই নাই জানি।
জন্ম মৃত্যু ছুঁয়ে যেতে পারে না আমায়!
হাসি সদা এটা জেনেই
জন্মাইনি তাই মরব না কখনোই।
জন্ম আমাকে জীবন দেয়নি
মৃত্যু আমার জীবন নেবে না
জন্ম মৃত্যুতে আমার জীবন
নির্ভর কিংবা নির্বল কখনোই নয়।
.
.
বিশ্বরূপ
নানান মৌলে এই যে অস্তি
নরম জলে আমিষময়,
আগুন জ্বলে আহার আসে—
হলোই তবে, আকাশ জয়।
বিযুযতে জীবন ভাবনা—
তেমনি আসে নিপাত ভয়,
পুরজনে শেষ জানে না;
আগুন, অস্ত্র আর সময়।
কায়ার মালায় অভিজন যত
স্বাতন্ত্র্যে সব মিছেই বয়,
ক্ষয়ের সাথে অর্জন যোগে;
গণিত শুধুই রিক্ত রয়।
মহাকালসহ সকল চলন—
আছে যা সবে—পুর হয়েই,
যা হবার তা ভালোই হবে—
জড়িয়ে ক্রীড়া; এক ছকেই।
.
.
ডাক
মরে যাও তুমি
মরে যাও এইসব জনপদে।
যেখানে শকুনের উৎসব মহান, লালাময়
আহ্লাদিত শেয়াল আর কুকুরে চলে মেজবান।
মরে যাও, মরে যাও তুমি এই জনপদে
ধুপছায়ায় শূন্য মাথা, যেন দম দেয়া ঘড়ি,
সময়ে সময়ে প্রয়োজন লাল জল চাবি
মরে যাও! মরে গিয়ে বেঁচে যাও, বেঁচে যাও তুমি।
.
.
উচ্ছেদ
ভূমিপুত্র শূন্য করে কী করবে তুমি?
কী করবে তোমার পাশের মানুষেরা এই পোড়া মাটি দিয়ে?
স্বপ্নে স্বপ্নে ফিরে আসবে চিৎকার আর কান্না,
ভীত, ঘর্মাক্ত দেহে জেগে মাঝরাতে প্রতিদিন
কী শান্তি আনবে তুমি সেই পোড়া মাটি খেয়ে?
তিস্তা, মেঘনা আর নাফের লাল জল
অশ্রু হয়ে বইবে তোমার চোখে,
বিছানায় থাকবে হাড় ভাঙার মটমট শব্দ।
সিন্দুকের আর কতটুকুই ভরবে তুমি ঐ মৃত ভিটা নিয়ে, কী শান্তি আনবে তুমি সেই পোড়া মাটি দিয়ে?
.
.
সময়
এই তো কিছুদিন ধরেই ভাবছি
তুমিসহ চলে যাব কোনো এক বনে।
সভ্যতার শেষ সুতাটিও খসে গেলে
জন্ম দেব নবরূপ সময়, আমরাই।
ক্যাপিটালিজম ও সোশ্যালিজমকে যে
বায়বীয় করে দেবে সারভাইভালের তাপে।
পোশাকি সভ্যতা খাবি খাবে ঠিকই তখন,
তোমার নগ্ন শীতল আর নরম নরম পায়ে।
.
.
পাথরের জল
পাথরেও জল থাকে, আছে
সত্য স্পর্শে ঝরনাধারা যারা,
বৃষ্টি তাতে না আসলেই কী?
কঠিন তো সেই বাইরেরটা।
স্থবির কিছু কষ্ট কথা
অন্য হৃদয় যথাতথা,
আকাশ দেখলে সব শেষ
একটা তেমন আছেই তো বেশ।
জলের মতো দুই হাতে সব তো আসে না,
গ্রহণ করো নৈবেদ্য তাই কিছু অপূর্ণতার
কথায় রইলো, মাথায় রেখো হাশরের কসম!
আমার মমতায় থাকবে না, এতটুকু জখম।
.
.
নিত্যতা
আমার মাঝেই কাম ক্রোধ
আমার মাঝেই মোহ লোভ
আমার মাঝে অধর্ম যত
আমার মাঝেই তো ধর্ম সব।
যা আমার মাঝে নেই
তা আর কোথাও নেই।
আমার মাঝেই কবিতা
আমার মাঝেই বিজ্ঞান।
আমার মাঝে গল্পকথা
আমার মাঝেই পটুয়া।
আমার মাঝেই লালন
আমার মাঝেই আযম,
আমার মাঝেই সন্ত্রাস
আমার মাঝেই সন্ন্যাস।
যা আমার মাঝে নেই
তা কোথাও আর নেই।
.
.
অস্তিত্ব
কোথাও তো ছিলাম আমি,
কুয়াশার আগে সোনালি স্তূপীকৃত ঘাসের বাগান
অথবা সমুদ্রতনয়ার কোলে যেখানে
চিরজোছনায় কোনো রাত ছিল না,
ছিল না কোনো নদীর আচমকা হারিয়ে যাওয়া।
আমি সেখানেই ছিলাম।
.
.
ইনফিনিটি
যত রকমে ভাঙতে পারো ততভাবে
তাই করো সর্বোচ্চ নিষ্ঠুরতায়,
ডার্ক ম্যাটার সাক্ষ্য দেবে প্রবহমানতা গুনে
এভাবেই ইতিহাস জমে এতকিছু শুনে।
অমাবস্যা থাকুক ইনফিনিটির স্রোতে
যুদ্ধ চলুক বৃষ্টির মতো, যেমন আষাঢ়ের।
স্বপ্নকে ডাউনলোড যদি করাই না যায় তবে
রাত থাকুক, ঘুম থাকুক সেই চিরকাল।
.
.
আমি ফিরে আসবো
পৃথিবীর স্তনে গাছ থাকে,
সেখানে চলে ঝিঁঝিঁ পোকার কিবোর্ড,
পাশের ফুটপাতে কেউ নেই
আমি হেঁটে যাই সোয়া পূর্ণিমা হাতে।
হ্রদের হৃদয় ভাঙে যদি এই নগ্ন পায়ে
আমি মাতাল হই আধারিত জলাশয়ে,
ঝাপসা ডানায় মেঘের চোর পুলিশ আজ
গল্পের রাজমুকুট সামনে নিয়ে আসে।
(ল্যাবএইডে লেখা কবিতা, ৩ মার্চ ২০২৪)
.
.
শেষ কবিতা
প্রথম আলোর আগ থাকেই এখানে ছিল
শালিক, দোয়েল, ফুটকি
আর ময়না পাপিয়ার জনমিতি,
যখন বাড়ে রথ এক দুই তিন—নানান তরঙ্গের স্রোতে
উড়ে চলে যায় চোখ আর কানের সকল মধুরতা।
সবশেষে একটা চড়ুই আমার জানালায় এসে
আমাকে আমার সামনে দাঁড়াতে বলে
তার শ্বাস আর বাসের জন্য।
(ল্যাবএইডে লেখা কবিতা, ১০ মার্চ ২০২৪)
কবিতাগুলি নির্বাচন করেছেন ও প্রয়াত কবিকে নিয়ে তাৎক্ষণিক গদ্যটি লিখেছেন কবি সরোজ মোস্তফা — গানপার
কবির শেষকৃত্য ও শ্মশানবন্ধুর স্বগতোক্তি
কবি রানা নাগ স্মরণপত্র
- দরকার গানের বাণীর মর্ম ও অঞ্চলগত বুলির বৈশিষ্ট্য বিবেচনা || আহমেদ স্বপন মাহমুদ - May 13, 2024
- কোকমোসাহেব, ফোকগোবেষক ও কতিপয় ধুন্ধা || মামুন খান - May 13, 2024
- কোকবাজারে কে গায় কার গান || এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান - May 13, 2024
COMMENTS