২০০৩ সালের ১৯ আগস্ট বাগদাদে জাতিসংঘ মিশনের হেডঅফিসে বোমা হামলায় প্রাণ হারায় ওই সময়কার ইরাক মিশনের প্রধান সার্জিও ভিয়েরা দি মেলো। যাকে জাতিসংঘের ভবিষ্যতপ্রধান ভাবা হচ্ছিল। ভাবা হচ্ছিল কফি আনানের যোগ্য উত্তরসুরী। ব্রাজিলিয়ান সার্জিওর অবদানের ফলেই দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ ও ইন্দোনেশিয়ার ঔপনিবেশিক অবস্থা থেকে স্বাধীনতা পায় পূর্বতিমুর। এর আগে কম্বোডিয়ায় শান্তি ফিরিয়ে আনতেও তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য।
অসম্ভব সাহসী, সৎ ও মানুষের শান্তির জন্য নিবেদিতপ্রাণ এক কূটনৈতিক সার্জিওর সাথে তিমুরে পরিচয় হয় তার প্রতিবেশী দেশ আর্জেন্টাইন অর্থনীতিবিদ ক্যারোলিনার। তারা প্রেমে পড়ে। আর এই সিনেমাটা মূলত তাদের প্রেমের গল্পের পাশে সার্জিওর গল্পটার একটা অংশ।

তার ব্যক্তিত্বের উদাহরণের জন্য প্রচুর ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু একটা ঘটনা উল্লেখ করছি, সেইটা বাগদাদের। ইরাকের রাজধানীতে যখন সে অ্যাপোয়েন্টেড হয়ে গেল, গিয়ে দেখে ইউএন অফিস মার্কিন বাহিনীর নিরাপত্তায় ঘেরা। সে গিয়েই প্রথমে যা করল তা হলো সব নিরাপত্তা সরিয়ে দিল। দিয়ে তার সহকর্মীদের বললো, আমরা আমেরিকার কোনও অ্যাজেন্ডা পূরণ করতে এখানে আসিনি। আমরা আসছি ইরাকিদের সহযোগিতা করতে। আমেরিকার নিরাপত্তার বলয়ে থেকে ইরাকিদের মাঝে এই আস্থা আনা যাবে না, যে আমরা তাদের জন্যই আসছি। যদিও এই রকম অনিরাপত্তার দরুণই বোমা হামলাটা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু তার অতীত জীবন দুর্দান্ত সংগ্রামের।
তার মৃত্যুর সময় তার পাশে ছিল পূর্বতিমুরে তার সহকর্মীদের একাংশ। ছিল প্রেমিকা ক্যারোলিনাও। তাদের পরিকল্পনা ছিল ইরাকে শান্তি ফিরিয়ে আনার পর তারা রিও ডি জেনিরোতে চলে যাবে। সেখানে সংসার করবে। কিন্তু হয়নি। তাতে কি? ক্যারোলিনা এখনও সার্জিওর সামাজিক স্ত্রী হিসেবে মর্যাদা পাচ্ছে। থাকছেও সার্জিও যেখানে বাকি জীবন কাটাতে চাইছিলেন সেই অঞ্চলে।
যারা ব্রাজিলিয়ান মুভি দেখে থাকেন তারা ওয়াগনার মাওরাকে চিনে থাকতে পারেন। খুব জনপ্রিয় অভিনয়িশল্পী সেখানকার। আর নারকোস যারা দেখছেন তারা তো পাবলো এস্কোবার চরিত্রের জন্য মাওরাকে মনে রাখবেনই। তার জন্যই মূলত দেখতে বসছিলাম ছবিটি। কিন্তু সার্জিওর জীবনের একটা ছোট্ট বাতাস গায়ে লাগার পর মনে হইলো সার্জিওরে নিয়া আরও জানা উচিত। দেখলাম তারে নিয়া আরেকটা ছবিও হইছে। দেড়ঘণ্টার ডকুমেন্টারি। কিন্তু পাইলাম না খুঁজে। পাইলে সেইটাও দেখব। তারে নিয়া বইও আছে। তার লেখা বইও থাকার কথা। সিনেমার সূত্র বলে। সেইটা আপাতত খুঁজতেছি।
২
সার্জিও ভিয়েরা দি মেলো-কে নিয়া ফিকশনটা দেখার পর তার সম্পর্কে যে আগ্রহ তৈরি হইছিল তারই ধারবাহিকতায় এইবার ডকুমেন্টারিটা দেখা গেল। ইরাকে জাতিসংঘ মিশনের কার্যালয়ে বোমা হামলায় নিহত হবার আগে তার যে বর্ণাঢ্য জীবন তার কিছুই আসলে দুইটা সিনেমায় আসেনি। তার জীবন এতটাই ড্রামাটিক যে একটা গল্প বললেই বোঝা যাবে।
সার্জিও তার বায়োগ্রাফি লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে ভেবেছিল ইরাকের কার্যক্রম শেষ করে সে আবার রিও-ডি জেনিরোতে ফিরবে। বিয়ে করবে প্রেমিকা ক্যারোলিনাকে। আর লিখতে-চাওয়া বায়োগ্রাফিটার নাম হবে ‘বন্ধু যুদ্ধাপরাধীরা’।
জাতিসংঘের শান্তি মিশনে যোগ দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেই। আর তার প্রথম পোস্টিং ছিল বাংলাদেশে। সার্জিও ডকুমেন্টারিটায় তার চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার শরণার্থী শিবিরের ছবিও পাওয়া যায়।

তার প্রেমিকা ক্যারোলিনা তাকে কিছুটা কমিউনিস্টও বলতে চাইলেন সাক্ষাৎকারে। কিছুটা বিপ্লবীও। তার একটা উদাহরণ অবশ্য পাওয়া যায় পূর্বতিমুরের প্রেক্ষাপটে। জাতিসংঘ তাকে সেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতা চর্চার সুযোগ দিয়েছিল। অনেকটা স্বৈরশাসকের মতো। কিন্তু সে পূর্বতিমুরকে স্বাধীনতা দিয়েছে। যদিও সে দিয়েছে বলাটা ভুল, কিন্তু পূর্বতিমুরের স্বাধীনতার পেছনে তার অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডকুমেন্টারিটাতে বোমা হামলার পর সে ঠিক কোন পরিস্থিতিতে আটকা পড়েছিল তার কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। যেখানে কি না বিশ্বের সেরা সেনাবাহিনী বলে দাবি করা মার্কিন বাহিনীও একটা ধসে-পড়া ভবন থেকে সার্জিওর মতো একজনকে জীবিত উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
ডকুটা উৎসাহ নিয়েই দেখা গেল সব মিলে। ফিকশনটা নিয়েও আগে কয়েকটা শব্দ লিখেছিলাম, আলস্য নিয়ে। চাইলে তাও পড়তে পারেন। এই নিবন্ধের প্রথম অংশ ফিকশন ও দ্বিতীয় অংশ ডকুমেন্টারি নিয়ে লেখা।
এপ্রিল ২০২০
ইলিয়াস কমল রচনারাশি
সিনেমার চিরকুট প্রবাহ
- সিনেমার চিরকুট ২৭ - October 19, 2025
- বাংলাদেশের সিনেমা নিয়া আমি লিখতে আগ্রহী || ইলিয়াস কমল - October 1, 2025
- সিনেমার চিরকুট ২৬ - September 24, 2025

COMMENTS