শ্বাসরুদ্ধ সাতদিন

শ্বাসরুদ্ধ সাতদিন

যেসব ঘটনা প্রায় কিংবদন্তির মতো গল্পাকারে শুনে এসেছি ছোটবেলায়, একটা বয়সে এসে ডেইলি নিউজপেপারে বা স্বনির্বাচিত বইয়ের পাতায় পড়েছি কিছুটা হাল্কাপাৎলা ভাসাভাসাভাবে, সেইসব যখন সিনেমায় চিত্রায়িত হতে দেখি কিছুটা বাড়তি আগ্রহ তো হয়ই সিনেমাটা লাইন-বাই-লাইন মনোযোগে দেখার জন্য। প্রতিক্রিয়া দুই রকমেই হয়, নিগ্যাটিভ এবং পোজিটিভ; অনেকসময় ইন্-ডেপ্থ জানা যায় আগের সেই কবেকার বাল্যবয়সে-শোনা ভাসাভাসা কাহিনিকিসসাটা, আবার অনেকসময় সিনেমার আতিশয্যে ব্যাপারটা বিরক্তিকরও হয়। এক্সাম্পল দিতে এখন পারব না, আশা করি সিনেমাবাহিত বর্তমানে এইরকম অভিজ্ঞতা প্রায়-সময়েই হয় রেগ্যুলার সিনেদর্শক সকলেরই। বিশেষত অদূর ইতিহাসের কোনো ঘটনা আবর্তিত হয়ে সেই সিনেমা গড়ে উঠলে দর্শকমাত্রই লাইনে-লাইনে একটা প্রায়োর-এক্সপেরিয়েন্সের দোলাচলে দেখতে থাকেন সিনেমাটা, নানা কারণেই সেইটা কখনো উপভোগ্য হয় ফের কখনো হয়ও না।

অ্যানিওয়ে। ‘সেভেন ডেইজ্ ইন্ এন্টিব্’ (7 Days In Entebbe) সিনেমার কাহিনি ইতিহাসেরই অংশ বটে। এইটা সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে, এই রিভিয়্যুয়ারের জন্মের বছর-দুয়েক আগে। এরপর গল্প শোনার মতো বয়সে এই রিয়্যাললাইফ ঘটনাটা বাবাকাকাদের মুখে শুনেছি, কিছু বইপত্রিকাতে পড়েছিও, বহুবছর বাদে ২০১৮ সনে এসে এইটা ছায়াছবিতে দেখছি। ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়াই সিনেমা। ডাকাতি ছিনতাই নয়, রাজনৈতিক ছিনতাই। পোলিটিক্যাল কারণেই ছিনতাই। বিশ্বজনমত ও বিশ্বের নজর নিজের দিকে ঘোরানোর লক্ষ্যে এই ছিনতাই সংঘটিত হয়েছিল। পরে একাধারে এমন অনেক ছিনতাই হয়েছে, এখনও বন্ধ হয় নাই নিশ্চয়। ন্যাক্কারজনক ব্যাপার সন্দেহ নাই, নিরীহ মানুষদেরে জিম্মি রেখে এই ছিনতাই-রাহাজানি যতই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে হোক না কেন কৌশল হিশেবে এইটা নিন্দনীয়। তবু যারা কাজটা করে, তাদেরও যুক্তি থাকে; এইটা তাদের কাছে মুক্তিরই দিশা পাবার পথে একটা কার্যক্রমের অংশ মাত্র। ম্যুভিতে হাইজ্যাকারদের পারস্পরিক সংলাপে এমন কতিপয় আলাপ আমরা শুনতে পেয়েছিও।

১৯৭৬ সনে প্যালেস্টিনিয়্যান এবং জার্মান হাইজ্যাকাররা মিলে এয়ার ফ্রান্সের একটা প্যাসেঞ্জারপূর্ণ উড়োজাহাজ অস্ত্রের মুখে জাহাজচালক ও যাত্রীসাধারণ সকলকে জিম্মি করে একনায়ক ইদি অ্যামিনের উগান্ডায় নিয়া নামায়। তারপর মুক্তিপণ দাবি করে ইজরায়েলি গবার্নমেন্টের কাছে। প্যালেস্টিনিয়্যান পোলিটিক্যাল দাবিদাওয়া। ইজরায়েলের মসনদে তখন ইৎজ্যাক রবিন। ক্যাবিনেটে আরও যারা আছেন তারাও পরিচিত আমাদের কাছে, এদের একজন পরে প্রেসিডেন্টও হয়েছেন, রবিনের ক্যাবিনেটমেম্বার এবং তখনকার ডিফেন্সমিনিস্টার শিমন প্যারেজ। গত অর্ধশতকের বিশ্বরাজনীতিতে ইনফ্লুয়েনশিয়্যাল ফিগার অনেকেরই দেখা পাওয়া যায় সিনেমায় এবং সময়টা শ্বাসরুদ্ধকরই কাটে দর্শকদের। একে তো সশস্ত্র হাইজ্যাকারদের ছড়ানো প্যানিকের সাস্পেন্স, তদুপরি চিনা-আধাচিনা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কর্মকাণ্ডের সাস্পেন্স, সবকিছু মিলিয়ে এন্টিব এয়ারপোর্টে যেন দর্শকেরা অসহায় জিম্মিদের সঙ্গেই আটকা পড়ে থাকে।

এই জিম্মিকালিক সাতদিনেরই কাহিনিপরম্পরা নিয়া সিনেমা আবর্তিত হয়েছে। ফ্ল্যাশব্যাকে ‘টেরোরিস্ট’-দের কিছু পুরানা কাসুন্দি, কিছু দ্বন্দ্ব ও পোলিটিক্যাল মিটিঙের ফ্ল্যাশব্যাক, কিছু ফ্যুটেইজ ইত্যাদি সিনেমায় স্পিড সঞ্চার করেছে বৈকি। ইৎজ্যাক রবিনের নেতৃত্বে ইজরায়েল সরকার ফাইন্যালি ডিসাইড করে রেস্কিয়্যু মিশনে যাবে। এই সিদ্ধান্ত নিতে নিতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়, সেসব সিনেমায় দেখানোর সময় ইজরায়েলি ক্যাবিনেটের অন্তর্কোন্দলও অন্তরাল থাকে না। তারপরও রবিনের স্থিতধী লিডার্শিপ অন্তত ম্যুভিতে বেশ চমৎকারভাবেই ভিশ্যুয়্যালাইজ্ করা গিয়েছে। এইটা হিস্ট্রি-বেইসড পোলিটিক্যাল থ্রিলার ঘরানার সিনেমায় তেমন উঁচু দরের নির্মিতি বলতে না পারলেও অনুপভোগ্য নয়।

ইজরায়েল আর প্যালেস্টাইনের মধ্যকার দ্বন্দ্বসংঘাত তো বর্তমান দুনিয়ায় পুরানা সংঘাত দুইটার মধ্যে একটা। সংঘাতের সূত্রপাত গত শতকের চল্লিশের দশকের শেষভাগ থেকে, এখনও সংঘাত নিরসনের কোনো ফলপ্রসূ উদ্যোগ আমরা দেখি না। শান্তিচুক্তি ইত্যাদি হয়েছে শেষ নব্বইয়ের দশকে, ভেস্তেও গিয়েছে সেইটা, তারপরে লোকদেখানো সন্ধিচুক্তির উদ্যোগটাও কেউ নিচ্ছে না। মানুষ মরছে কাতারে কাতার রোজ, ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে দুই তরফেই, প্যালেস্টাইনের ক্ষতি শুমার করে দেখবার মতোও নয়। এতটাই বেশুমার সেই ক্ষতি, মানে এবং পরিমাণে। প্যালেস্টিনিয়্যানদের বংশ উজাড় হয়ে যেতেছে। প্যালেস্টিনিয়্যানরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লড়ে চলেছে। বেড়া টানা হয়েছে একটা আপাত সমাধান হিশেবে। এখনও রোজ মরছে। এখনও সমাধান সুদূরপরাহত হয়ে রয়েছে। এখনও বোমায় বিধ্বস্ত ঘর থেকে বেরিয়ে একেকটা মানুষ শববাহকের কান্ধে চড়ে ফিরছে। প্যালেস্টিনিয়্যানরাই মূলত।

ছবির শুরুতেই আমরা সাবটাইটেলের লেখা পড়ে বুঝে ফেলি যে এইটা বানানো হয়েছে ইজরায়েলি পয়েন্ট অফ ভিয়্যু থেকে। সেইটা আদৌ সমস্যাও হয় না। কারণ সিনেমা বলি বা সাহিত্য ইত্যাদি শেষবিচারে একেকটা পয়েন্ট অফ ভিয়্যু থেকেই নির্মিত। প্রত্যেকটাই আলাদা ভার্শন একেকটা। সার্বজনীন বলিয়া আসলে কিছুই হয় না। তারপরও সৎ সিনেমা/সাহিত্যের নির্মাতা ব্যালেন্সটা রাখতে পারেন, কোনো আখ্যানকে একপেশে বা ক্লোজ-এন্ডেড করে ফেলা থেকে লেখক/রচয়িতা চাইলেই তার রচনাটা বাঁচাতে পারেন। এই বিবেচনায় মনে হয়েছে ‘সেভেন ডেইজ্ ইন্ এন্টিব্’ একপেশে একটা কাজ।

ম্যুভিনির্মাতা হোসে প্যাডিলহা রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ফিকশন বানিয়েই বিখ্যাত। মূলত বাণিজ্যিক ধারার ফ্যান্টাসি সিনেমাই নির্মাণ করিয়া থাকেন তিনি। থ্রিলার হার্ডকোর। কিন্তু সেই থ্রিলার ফ্যান্টাসির ভিতরেই পোলিটিক্যাল আন্ডারটোনটা থাকে। যেমন, হোসের বানানো ম্যুভিগুলোর মধ্যে ব্যবসাসফল হয়েছে এর আগে ‘এলিট স্কোয়াড’, ‘রোবোকপ’ ইত্যাদি। কিংবা ‘নার্কোস’ টিভিসিরিয়্যালের কথা বলতে পারি, কোলাম্বিয়্যান নার্কোটেরোরিস্ট পাব্লো এস্কোবারের জীবন নিয়া বানানো সিরিজের অন্যতম পরিচালক হচ্ছেন হোসে। এই ডিরেক্টরের কাজকর্ম মোটেও উপেক্ষা করার মতো নয়। কিছু সন্দেহ হয় এই কারণেই যে, হোসে কি হিস্ট্রি নিয়া ফ্যান্টাসি ফর্মে বেশিটা আগাইলেন? তবু সেই ইতিহাসত্রাসিত সাতটি দিনের টেনশনটা আনতে পেরেছেন ডিরেক্টর, অভিমুখ একপেশে হলেও, সঙ্গে সেই সাতদিনের ব্যাপারে একজন ম্যুভিনির্মাতার মন্তব্যও বুঝিবা আমরা পাই ঘটনার কনফ্লিক্ট ও আয়রনি ঘিরে। সেই দৃশ্যমন্তব্যগুলো দর্শক হিশেবে একেকজনের কাছে একপেশে বা সার্বজনীন যা-ই মনে হোক, সিনেমা দেখার তাতে ব্যঘাত ঘটে না।

কাহিনির শুরু হয় অ্যাথেন্স উড়োজাহাজবন্দর থেকে। সেইখানেই জার্মান দুই যুবক-যুবতীর নেতৃত্বে একদল প্যালেস্টিনিয়্যান ফ্রিডম ফাইটার হাইজ্যাকের জন্যে বেছে নেয় এয়ার ফ্রান্সের যাত্রীবোঝাই অ্যারোপ্লেন। সেই প্লেনে ফ্রেঞ্চ, ইজরায়েলি এবং আরও কিছু ইউরোপিয়্যান প্যাসেঞ্জার অন-বোর্ডেড ছিল। যথাক্রমে ড্যানিয়েল ভ্রুল এবং রোজামান্ড পাইক অভিনয় করেছেন হাইজ্যাকে নেতৃত্ব-দেয়া যুবক ও যুবতীর ভূমিকায়। দারুণ করেছেন দুইজনেই। ভীষণ মাপা অভিব্যক্তির ন্যাচারাল অভিনয়। ইদি অ্যামিনের ক্যারেক্টারে অল্পকলেবর হলেও অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছেন অত-চেনা-নয় এমন একজন অভিনেতা। আর ইজরায়েলি ক্যাবিনেটের মন্ত্রীমিনিস্টার সকলেরই বিশ্বাসযোগ্য চেহারায় এলিট অভিনয় বের করে আনতে পেরেছেন পরিচালক। ইজরায়েলিরা ছাড়া প্যালেস্টিনিয়্যান কোনো ঐতিহাসিক লিডার্শিপের দেখা পাওয়া যায় নাই সিনেমায়। ‘টেরোরিস্ট’ গ্রুপের কিছু বৈঠকে যে-নেতৃত্ব দেখানো হয়েছে প্যালেস্টিনিয়্যানদের, এইটা না-দেখালেও হতো। পয়েন্ট অফ ভিয়্যু ম্যুভি নিশ্চয় আরও উপভোগ্য হতো তাতে।

গেল শতকের মধ্যপ্রাচ্য ক্রাইসিস নিয়া যাদের পত্রিকাবাহিত হলেও খানিকটা জানাশোনা আছে, ‘সেভেন ডেইজ্ ইন্ এন্টিব্’ তাদেরে উত্তেজিত উপভোগ্য সময় কাটানোর সুযোগ করে দেবে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, উনার বড়ভাই যুনি নেতানিয়াহু, ইৎজ্যাক রবিন, শিমন প্যারেজ প্রমুখ নেতৃবর্গের বহু অ্যাক্টিভিটি নিয়া আগে থেকে আপনি যা জানতেন তা ছায়াছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে দেখতে সময়টা খারাপ কাটবে না। আর সর্বোপরি মিউজিক। এই সিনেমায় বাৎশেভা ড্যান্স কোম্প্যানির স্টেজে একটি গীতিনৃত্যনাট্যের মহড়া আখ্যানের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় আর্টিস্টিক্যালি ইউজ্ করা হয়েছে। এই মিউজিক্যাল ড্যান্স পুরো বইটায় সাবপ্লট হিশেবে ফিরে ফিরে এসেছে। এর গান ইহুদি মিথ ও স্ক্রিপ্চার লতিয়ে একটা জাতীয়তাবাদী চৈতন্যের জয়গাথা গায়। সাউন্ডের স্ট্রেন্থ সংক্রমিত করে, এই গীতিনৃত্যনাট্যে যে-সাউন্ড রয়েছে, এবং সবকিছু মিলিয়ে মন্দ লাগবে না দেখার সময় সিনেমাটা।

Movie Title: 7 Days in Entebbe ।। Genre: crime thriller film ।। Director: José Padilha ।। Starring: Rosamund Pike and Daniel Brühl ।। Cinematography: Lula Carvalho ।। Music by Rodrigo Amarante ।। Language: English ।। Runtime: 107 minutes ।। Released in 2018

ছায়াছবি রিভিয়্যুকারী : মিল্টন মৃধা

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you