কবিতা পড়ার নেশা চার বছর পেরিয়ে গেল। এই ঘোরের মধ্যে কীভাবে নিজেকে যে বড় করেছি তা কেবল কবিতাই জানে। এখন অনুভব করি মানুষকে রক্তমাংসে বড় হওয়ার পাশাপাশি কবিতায়ও বড় হতে হয়। কুরআনি কবিতা, মজলিশি কবিতা, হাদিসি কবিতা। আরো থাকতে পারে। আক্ষরিক অর্থে অনেকে ভিন্নমত পোষণ করবেন আমার কথার সাথে। তবুও দুনিয়ায় সকল সৃষ্টি এবং মাজেজা আমার কাছে কবিতাই মনে হয়। আর জীবন; — সে মানবদেহের দুইশো ছয়টি হাড়ের মতোই এক-একটি কবিতা। আর কবিরা এর থেকেই সৃষ্টি। আল্লাহর সৃষ্টি কবিতাও।
মানুষ কখনও ভ্রমণে বের হয়। আবার কখনও কাল্পনিকভাবে দৈব ভ্রমণ করে। কেউ হাঁটতে হাঁটতে দীর্ঘ পথ মাড়িয়ে গেলেও নিজেকে ভ্রামণিক মনে করেন না। কেউ আবার লিখে রাখতে চায়, — গাছের শুকনো পাতাটির লুটিয়ে পড়ার মর্মান্তিক আখ্যান। মাড়িয়ে গেলে কেনই-বা মর্মর শব্দ হয় কেবল শুকনো পাতাটির! মেঘ অথবা রোদ কেন আকাশে থাকে? — ভেসে যায়; নিজস্ব সীমানা ছাড়িয়ে ছুটে আসে আমার কাছে?
পুরো বই থেকে কবিতার দুটো খণ্ড আমি লিখব। প্রথম পৃষ্ঠা থেকে একটি৷ বইয়ের শেষ দিক থেকে একটি।
‘সিলভার কালার রেইন৷ বৃষ্টি বললাম না ইচ্ছে করেই। ফার্মগেটের কাছাকাছি যারা থাকেন, এই বৃষ্টিতে, আসুন চা খায়ে নিই। আট নম্বর শেষ লোকালটাও চলে যাচ্ছে।’
*
‘মুনলিট নাইট। ট্রেনের ভেতর থেকে দেখা যাচ্ছে ভরা চাঁদ। এই এপ্রিলে, একইসাথে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে গ্রাম ও শহর। ধারালো ব্লেডের মতো বাতাস এসে গালে লাগছে। কেউ ঘুমাক বা না ঘুমাক — এপ্রিলের কোনো কবিতাই রহস্যপ্রিয় নয়। বোকা বউ অভিমান বোঝে না। কু ঝিক ঝিক… ঝিক ঝিক…ঝিক ঝিক…’
এই দুই খণ্ডের মধ্যে বেশ একটা দুরত্ব আছে। কত দূরত্ব সে-কথা আমি লিখে বোঝাতে পারব না। শুধুমাত্র অনুভবশক্তির মহানুভবতাই বলতে পারবে। ঝড়ঝাপটা, বর্ষা, শীত, শরৎ, বসন্ত, মাঘ, আড্ডা, চা খাওয়া, বাসে চড়া, প্রিয় খাবার, ঘুম, ভালোবাসা, ফুল, নারী, শৈশব, সমালোচনা, কবি, চলন-বিচলন, শোক, পাখি — সবকিছুই একটা শেকলে বাঁধা বদ্ধ কারাগারে বন্দি। তুমি চাইছ আমাকে, পাচ্ছো না, আমি পাচ্ছি তোমাকে অথচ তুমি হারিয়ে যাচ্ছ — আবার কিছুই আমার না; কিন্তু তোমাকে আমি ভ্রমণের জন্য আমন্ত্রণ করছি, যেন পৃথিবীটা আমার। কবি আমার কাছ থেকে সাধুবাদ পেলেন। তা কিন্তু সহজ নয়, যা পাওয়া যায়।

মা-বাবা, টাকা, দিন, আমার বড় হওয়া, সমাজ, পরিবেশ, চাওয়া, পেয়েছি, বউ, যত্ন, আদর, চলছে দিন মাউথ অর্গানে ভর করে। ধর্মই সবচেয়ে বড়। ডিজিটাল আমার ধর্ম নয়, আকাঙ্ক্ষায় সবসময় সুখ মেলে না। ধ্বংসে কখনও ঈর্ষা থাকে, দেখা যায় পাহাড় নামক সেই বাড়িটি আমার, অশ্লীলতা আমার খাট, রাষ্ট্র বিদ্রোহের জন্যই, প্রাণিরা সব মানুষ নয়, সমাজের চোখের পাতায় চাঁদের আলো বায়না ছাড়াই পড়ে, সেই আলো আসে আমার ঘরে — তারপর আমরা সেই আলোর দিকে তাকাই। তখন দেখি কবি বলেন — ‘অধমে তাকাও, সোনা — পাতাঝরা দিন বয়ে যায়।’
বিধানদা যদিও বলি, কিন্তু কবি হিশেবেই উনার সাথে আমার পরিচয়। বিধান সাহা। খুব কাছে থেকে দেখা এবং কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তবে প্রথমবার যখন দেখা হলো তখন বাংলামোটর থেকে আমরা তিনজন হেঁটে গিয়েছিলাম গল্প করতে করতে ফার্মগেট অবধি। সাহিত্যের তত্ত্ব, মুক্তগদ্য, বইপড়া, নন্দনতত্ত্ব, সমসাময়িক লেখক, কারা কীভাবে লিখছেন, আলোচনা, সমালোচনা, বই লেখা, খোশগল্প, হাসাহাসি, তেজগাঁও কলেজের সামনে দাঁডিয়ে পিঠা খাওয়ার ফাঁকে যা জেনেছিলাম তাতে তাঁর চিন্তার প্রসারতা বা তিনি কীভাবে কবিতাকে মূল্যায়ন করেন তা খানিক আঁচ করতে পেরেছিলাম। সেদিনের আলোচনায় কবিকে আমি আমার আপন ভাবার সুযোগ পেয়েছি। চিন্তার উৎকর্ষতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁর ‘এসো বটগাছ’ আর ‘অব্যক্ত সন্ধির দিকে’ আগে পড়েছিলাম তাই অনেকটা কৌতূহল আর আগ্রহ ছিল।
‘শ্রীদেবী অপেরা’ খুবই ভালো একটি বই। সিরিজ কবিতা বলা যায়। আবার প্রতিটিই আলাদা। তবে বইটি নিয়ে সামান্য ভাটার কথা যদি বলতে হয় তাহলে একটা বিষয় আমাকে ভাবিয়েছে, যে, এত তাড়াতাড়ি কেন টেনে নিয়ে গেলেন কবি কবিতাগুলোকে। যদিও প্রথমদিক থেকে শেষদিক অবধি একই লয়ে কবি কবিতার লাইনগুলো টেনে নিয়েছেন। এর পজেটিভ দিক হলো, বাক্যের অনৈক্য। অসংঘবদ্ধতার ঘনত্ব। তাছাড়া তাড়াহুড়োটা অদ্ভুত শক্তি হিশেবে কাজ করায় একটু দূরের বাতিঘর মনে হয়েছে দ্রুত শেষ হবার কারণে। কবিরা হয়তো এ-ধরনের কবিতা এভাবেই বলে যান — এতদূর আলোচনায় যাওয়া এখন আমার উচিত হবে না বলেই মনে করি। আফটার অল যথেষ্ট শক্তি নিয়েই উপস্থিত বিধান সাহার ‘শ্রীদেবী অপেরা’।
বইটি প্রকাশ করেছে পশ্চিমবঙ্গের তবুও প্রয়াস প্রকাশনী। প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত। বাংলাদেশে পাওয়া যাবে ঐহিক বাংলাদেশ-এর দপ্তরে কিংবা লেখকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করলে। গায়ে ভারতীয় মূল্য ৩০ টাকা লেখা থাকলেও বাংলাদেশি মূল্যে পড়বে ৫০ টাকা।
… …
- আজ বাজার মে পা-বা-জৌলন চল / ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ || তর্জমা / নাফিস সবুর - December 27, 2025
- লোককবি অন্নদারঞ্জন দাস ও তাঁর গান || জফির সেতু - December 27, 2025
- লোককবি তাজউদ্দিন ও তাঁর গান || জফির সেতু - November 25, 2025

COMMENTS