শাহজালাল শাহপরান গ্রামবাঙলায় গাজির গান || তুহিন কান্তি দাস

শাহজালাল শাহপরান গ্রামবাঙলায় গাজির গান || তুহিন কান্তি দাস

শেয়ার করুন:

ছোটবেলায় বাড়ির উঠানে বসে শুনতাম হযরত শাহজালাল আউলিয়ার সিলেট বিজয়ের কীর্তি৷ গ্রামের বাড়ির উঠানে একটা টেবিলে টেপ রেকর্ডারে ফিতার ক্যাসেট বাজিয়ে চারপাশে সবাই বসে শুনতাম। সে কী আগ্রহ আর উদ্দীপনা! কখনো মনে হয়নি সে ভিন্ন ধর্মের কেউ৷ যা বুঝতাম, সিলেটের রাজা গৌড় গোবিন্দের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ৷ তখন হযরত শাহজালাল তাঁর সাথিদের নিয়ে সিলেট বিজয় করেছিলেন। বিজয়ের চেয়ে অত্যাচারিত-নিপীড়িত মানুষকে মুক্ত করেছিলেন বলাই সঠিক হবে। অর্থাৎ নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই মানুষ শাহজালাল হিন্দু না মুসলিম সে-পরিচয় খুঁজতে যাননি কেউ৷ কিংবা উচ্চবর্গের হিন্দুদের সাম্প্রদায়িকতার মোহে আটকে থাকেননি।

একটা হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দুগ্রামে এমন কিছু শুনতে কেউ বাধা দিয়েছে স্মৃতিতে নাই৷ বা কেউ হিন্দুধর্মের ফতোয়া দেওয়ার চিন্তাও করেনি কোনোদিন৷ আবাল-বৃদ্ধ সবাই মিলে একসঙ্গে এসব ক্যাসেট শুনতাম৷ ইসলাম ধর্মে যাহা আউলিয়া তাহাই হিন্দু ধর্মীয় উপাখ্যানের অবতার এমনটাই জানতাম৷ ফলে আলাদা করে জাত-পাতের পরিচয় জানা খুব একটা দরকার ছিল না৷ অনেক বছর পরে বুঝলাম তিনি আসলে ভিন্ন ধর্মের মানুষ। অনেক পরে জানতে পারি তিনি ছিলেন একজন সুফি সাধক৷ আমাদের এলাকা থেকে সিলেট প্রথম আসার পরে শাহজালাল-শাহপরানের মাজারে এসে মানত করে যাওয়া ছিল অনেকের ক্ষেত্রে রুটিন ওয়ার্ক অথচ ধর্মে সনাতনী।

আবার বর্ষায় গ্রামে গ্রামে আসতো গাজির গান৷ লাল কাপড় পরা বাউলের মতো। সঙ্গে কিছু একটা নিয়ে আসতেন কিছু গানপাগল মানুষ। এসে লোহার শিকের মতো কিছু একটা দিয়ে বৃত্ত আঁকতেন। বৃত্তের ভিতরে পুঁতে রাখা হতো লোহার শিকটা যা দেখতে অনেকটা ত্রিশূলের মতো। এইটাকে ঘিরে গান করতেন গাজীরা। চারপাশে মানুষ জমে যেত৷ সে কী খুশির মেলা! গ্রামজুড়ে হৈ-হুল্লোড়, গাজির গান আইছে! গান শেষে বাধ্যতামূলক সবাই বাড়ি থেকে চাল দিতেন যে যার সামর্থ অনুযায়ী। হাওর অঞ্চলে অনেকটা গ্রামীণ রেওয়াজ ছিল তাদের চাল দেওয়া৷ খুশি হয়েই দিতেন সবাই৷

এক গ্রামে কয়েক ধাপে গাজির গানের আসর বসতো৷ আমরা পিচ্চি বাচ্চারা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো ছুটতাম পিছু পিছু। গাজি মানে যে মুসলমান অনেক পরে জানতে পারি৷ কাকা-জ্যাঠারা কখনো আলাদা করে বোঝাতেও চাননি। অন্য সব গানের আয়োজনের মতোই গাজিদের গান শুনতাম। একটু ভিন্নধর্মী গান খুব আনন্দ লাগতো। গানটা ছিল মানুষের অন্তরের খোরাক ফলে কোন ধর্মের মানুষ গাইছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। মানুষের জীবনবাস্তবতার সঙ্গে যোগ ছিল সেটাই বড় কথা৷ মানুষ তার জাগতিক দুঃখ-ব্যথার উপশম খুঁজে পেয়েছিল গানের কথা কিংবা সুরে৷

‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ এল রে দুনিয়ায়’ কিংবা ‘ইয়া নবি সালাম আলাইকা’ গানগুলো ছোটবেলা থেকে শুনি আরাম করে৷ যখন শুনি প্রাণ ভরে ওঠে। গানের লিরিক কী বলে তার হিসাব নাই সুরের দরদ আপন করে নিয়েছি গান হিসাবে৷

আজ এসে দেখছি কিছু মানুষ গান গাওয়ার অপরাধে গলা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চায়। রাজু ভাস্কর্যে দাঁড়িয়ে ধর্মের দোহাই দিয়া এইসব হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। সরকার সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক নিয়োগ বাতিল করসে উনাদের মন যোগাইতে।

পাঁচ আগস্টের পর এমন নতুন নতুন সংস্কৃতিবিদ্বেষী মানুষজনের আমদানি হইছে৷ বোঝাই যাচ্ছে সরকার প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই এইসব ঘটনা ঘটছে৷ খুব একটা সক্রিয় হইতে দেখা যায়নি এই গোত্রের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারকে৷ আজকে আবার বাউল আবুল সরকারকে গ্রেপ্তার করা হইছে৷ শরিয়ত দেওয়ান-রিতা দেওয়ানের কথা মনে আছে। আওয়ামী সরকার মূলত কাঠমোল্লাদের খুশি করতেই তার হাতে হাতকড়া পরিয়েছিল। তবে শেষ রক্ষা আর হয়নি৷ আওয়ামীলীগের পতন হইলেও ধর্মান্ধ আরেক লীগের উৎপাত দেখা যাচ্ছে। তবে এই ধর্মান্ধ ভণ্ডদের মুখোশ দিন দিন সামনে আসতেছে। মজলুম হয়ে উঠছে জুলুমবাজ। ফলাফল হবে আরও ভয়াবহ। এই কথা বিগত লীগ সরকারের সময় অনেকবার বলছিলাম৷ সেই আঠারো সালের নির্বাচনের আগে থেকে। যে-পথে আওয়ামীলীগ হাঁটছে তাতে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে তাদের সামনে, কিন্তু ক্ষমতার মোহে পাত্তাই দিতেন না উনারা৷ গরিবের কথা (অভিশাপ) যে বাসি হইলেও ফলে তার একটা জ্বলজ্যান্ত চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা থাকার পরেও জুলাই অভ্যুত্থানের আগের সেই মজলুম ভাইয়েরা জালেম হয়ে উঠছেন৷ সুতরাং পরিণতিও আন্দাজ করা যাচ্ছে খুব সহজে। শুধু দরকার সংগঠিত থাকা বাউল-শিল্পী-সংগঠক ও মানবিক মানুষের। কেননা, এই চক্র হাতবদল হয়ে হয়ে চলতেই থাকবে৷ ক্ষমতার ঘনিষ্ঠ হয়ে আবির্ভাব ঘটবে আরেক দলের। তারাও আবার একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যাওয়ার আগেই, থামিয়ে দিতে হবে৷ তার জন্য প্রয়োজন বিবেকবান মানবিক মানুষের পাশাপাশি বাউল-ফকির-সংস্কৃতিমনা প্রতিটা মানুষের একাত্ম হওয়া৷ এর বাইরে কোনো শর্টকাট সমাধান নাই আসলে৷ অস্তিত্বের প্রয়োজনে প্রাণে প্রাণ মেলাতেই হবে৷

কবিগানের সুরে সুরে শরিয়ত-মারফতের যথার্থতা নিরুপণ বাংলা চিরায়ত সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা। মানিকগঞ্জ অঞ্চলে এই চর্চার সিলসিলা বহু আগে থেকে৷ এইসব চর্চার বীজ বিদেশ থেকে কেউ এসে বপন করে দিয়ে যায়নি৷ সম্পূর্ণ অর্গানিক। কিংবা শহুরে বাবুরাও এই বীজ লাগায়নি৷ এইগুলা তো কোনো মাস্টারমাইন্ডের মেটিক্যুলাস পরিকল্পনার অংশও না। মানুষ তাঁর জীবনবাস্তবতার নিরিখে এই চর্চাকে আপন করে নিয়েছে৷ সুতরাং এত সহজ না যে চাইলেই মাটিতে মিশাইয়া দেওয়া যাবে একটা সাংস্কৃতিক ধারাকে৷

মানুষ ঘুরে দাঁড়াবেই তার অস্তিত্বের প্রশ্নে। মাঝখান থেকে আবার একটা সংঘাতের জন্ম হবে ধর্মান্ধদের বাড়াবাড়ির কারণে। এই দায় সংখ্যাগরিষ্ঠ উগ্রবাদী ধর্মীয় রাজনীতির ওপরই বর্তাবে। আর যারা সংঘাত চায় (মূলত বিদেশি শক্তি যাদের আশীষে এত সক্রিয়তা মৌলবাদী-উগ্রপন্থীদের) তাদের মনের বাসনা পূরণ হবে এর ফাঁকে৷ তবে মানুষের অন্তরের খোরাক মানুষই আগলে রাখবে৷ এবং মানুষই জিতবে৷ এই সংঘাতে মানবিক আদর্শের জয় অনিবার্য।

মাজারে মাজারে ফকির সাধকদের সুফিবাদী চর্চা এ-দেশের বুকে নদীর মতো বয়ে চলা স্রোত। কিংবা মানবশরীরের শিরায় শিরায় বয়ে চলা রক্তের ধারা৷ এই পরম্পরাকে যারা কবর দেওয়ার মরণখেলায় নামসে তাদের ধ্বংস অনিবার্য এইটুকুই জানি৷ মুক্তবাজার অর্থনীতির ডামাডোলে জীবনসংসারের খেই হারিয়ে কিছু মানুষ পরমের সাধনা করে৷ জীবনের কোনো অর্থ খুঁজে না পেয়ে স্বরূপের সন্ধানে মন-প্রাণ ভাসায়ে দেয়৷ সেই মাটির মতো নিরীহ মানুষগুলোকে এরা ফেরারি বানাচ্ছে৷ গলা চেপে ধরে তাদের কন্ঠ রোধ করার উপক্রম হালে পানিও পাচ্ছে বেশ৷

কোথাও কোনোদিন শুনি নাই কোনো বাউল কাউকে হামলা করসে৷ কোনো ফকির সাধক কাউকে হত্যাযোগ্য করে নাই কোনোদিন৷ সে তাঁর কথা বলে যায়, এবার আপনার পছন্দ হইলে আপনি তাকে ডাকবেন না ডাকলেও ক্ষতি নাই। কিন্তু ধর্মের নামে হামলা-হত্যা যারা করছে তার নজির অভাব নাই৷

তবে জনবিদ্বেষী এইসকল গোয়ার্তুমির ফল ভালো হয় না৷ ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘরে জন্ম নেওয়া এসব নব্য ধর্মান্ধ ফ্যাসিবাদীরা না বোঝে ধর্ম, না বোঝে মানুষ৷ না জানে মানুষের অসহায়ত্ব, না বোঝে খোদার নিকটে আন্তরিক আর্তনাদ৷ বাউল হওয়া বা সন্ন্যাসী হওয়া এত সোজা না রে ভাই। অনেক কষ্ট পাইয়া, জগৎসংসারের সকল হিসাবের খাতা উল্টাইয়া তারপর মানুষ পাগল সাজে কিংবা সাজতে বাধ্য হয়। এইসব মানুষকে হত্যাযোগ্য করার নির্মমতার বিচার মানুষই করবে৷ তাই তো নজরুল বলে গেছেন,—

হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষেরে ঘৃণা করি
ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি
ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল!—মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;—গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।


তুহিন কান্তি দাস রচনারাশি

শেয়ার করুন:
পরের পোষ্ট
আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you