সৈয়দ শামসুল হকের ‘তিন পয়সার জ্যোছনা’ অবশ্যই লেখকের আত্মজীবনী। কিন্তু কতটুকু? ১৯৫০-এর দশকে নতুন দেশে, নতুন সমাজে নতুন লেখকগোষ্ঠীর পরিচয়ই উঠে এসেছে এই গ্রন্থে। কথাশিল্পীর বর্ণনায়, আত্মজীবন বলার সহজতায় বইটিতে একজন লেখকের সময়, পারিপার্শ্ব, সহচরগণ জীবন্ত হয়ে আছে। পাকিস্তান জন্মের পর পঞ্চাশের দশকে ঢাকাকে কেন্দ্র করে কীভাবে একটা নতুন সমাজ তৈরি হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে দেশ-সমাজ-সংস্কৃতি-লেখকগোষ্ঠী—তার একটা স্মারকচিহ্ন এই গ্রন্থ। একজন লেখক যখন আত্মজীবনী লিখেন তখন পুরো সময়টাকেই লিখেন। সমাজকে পাল্টে দেয়ার আকাঙ্ক্ষায় সহচরবৃন্দ যারা কাজ করেছেন—সবাইকেই লেখেন।
এই গ্রন্থটায় লেখকের যৌবনকালের স্মৃতিই উঠে এসেছে। উঠে এসেছে পঞ্চাশের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে বাংলার সমাজ। পাকিস্তানের জন্মের পর দ্রুতই নতুন এক অনুভূতি ও স্বপ্নের কথা বলতে শুরু করেছেন সাহিত্যিকেরা। সমাজকে বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষায় দারুণ দাপটে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছেন হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীরের মতো তরুণেরা। সৈয়দ শামসুল হকের বর্ণনার ভেতর দিয়ে সংস্কৃতির এক স্বর্ণযুগের প্রতিচ্ছবিই উন্মোচিত হয়েছে।
কুড়িগ্রাম থেকে পুরান ঢাকায় তিনি লেখাপড়া করতে এসেছিলেন। বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে ডাক্তার হবে। সেই ছেলে লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়েছে। বোম্বে গিয়ে সিনেমার স্ক্রিপ্টরাইটার হয়েছে। সেখান থেকেও পালিয়েছে। লেখালেখিকে জীবিকা করেছিলেন তিনি।
লেখালেখি একটা জেদ। একটা স্বপ্ন। একটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা। তাঁকে নিয়ে তাঁর পিতার ভয় ছিল। তিনি বলেছিলেন—‘তুমি না খেয়ে মরবে। তোমার পাজামা থাকবে ময়লা, তোমার যক্ষা হবে, সুরায় মাতাল তুমি নর্দমায় গড়াবে!’ কিন্তু পিতার কথা সত্য হন হয়নি। বরং পিতা তাঁর পুত্রের প্রতিষ্ঠিত লেখকজীবনকে দেখে গিয়েছেন। পুত্রকে উদ্দেশ্য করে উনিশ শ তেপ্পান্নর নভেম্বরে এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন : ‘সম্প্রতি তোমাকে লক্ষ করিয়া আমি বিস্ময়াপন্ন হইলাম। তোমাকে ঠিক চিনিয়া উঠিতে পারিলাম না। সন্দেহ হয় আমিই তোমার জন্মদাতা কি না। বোধ করি জগৎও তোমাকে জন্ম দিয়াছে। জগতের ভাগই অধিক বলিয়া দেখিতে পাই। পিতা হিসাবে আমি নিমিত্ত মাত্র।’
বাংলাদেশ সৈয়দ শামসুল হক লেখক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারার একটা দৃষ্টান্ত। এই দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি না-থাকায় কত মানুষ ঝরে যায়। এই শিক্ষাটি তিনি নিয়েছিলেন কথাশিল্পী শওকত ওসমানের থেকে। তিনি বলেছিলেন : ‘একেকটি দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের পেছনে নিরানব্বইটি লাশ, তারা পারেনি দাঁড়িয়ে থাকতে—এটা দৈবের করণ নয়, দাঁড়িয়ে থাকার জেদটির অভাবের জন্যেই নিশ্চয়।’
জীবনে জেদ থাকা লাগে, দাঁড়িয়ে থাকা লাগে আর লাগে দাঁড়িয়ে থাকার মাটি। কতরকম অভিঘাত যে আসে, জীবনের সেই অভিঘাত সহ্য করতে হয়। সহচরদের ক্ষমতাবানদের অভিঘাত সহ্য করতে করতে একজন লেখক লেখক হয়ে ওঠেন। সৈয়দ শামসুল হকের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আপন মাটিতে দাঁড়ানোর শক্তিতে একজন লেখক প্রতিপক্ষের সব অপমান ফিরিয়ে দিতে পারেন। লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েও তিনি তাই ফজলে লোহানীর সেই কথাটি ভুলে যাননি। সেদিন পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভায় অন্যেরা তাঁর গল্পকে তুচ্ছ বলে অপমান করেছিল। প্রকৃত বন্ধুর মতো ফজলে লোহানী সওগাত আপিসের বাইরে ডালিমগাছটির নিচে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভা শেষে দাঁড়িয়ে থাকা সৈয়দ শামসুল হকের কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন : ‘একদিন ওরা কেউ থাকবে না, তুমি থাকবে!’
একজন লেখককে অনেক অনেক অপ্রাপ্তির ভেতর দিয়ে যেতে হয়। অনেক অনেক অপ্রাপ্তিই তাকে কল্পনা আর দেখার প্রাপ্তির দিকে নিয়ে যায়। গ্রন্থে তিনি লিখেছেন : ‘বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিনের মধুদার কথাও কৃতজ্ঞ আমি মনে করে উঠি, লেখাপড়া ছেড়ে দিলে তিনিই তো আমাকে অম্লান নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলেছিলেন—ভালো করছেন! আর বাড়িতে হাহাকার পড়ে গেলেও, মায়ের চিঠিতে কান্নার জল এসে পৌঁছুলেও, ফজলে লোহানী আমাকে বলেছিলেন—হোয়াট ক্যান আ ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি গিভ ইউ অ্যাক্সেপ্ট আ ব্যাজ অব স্লেভারি! দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ইয়োর ইউনিভার্সিটি!’
‘তিন পয়সার জ্যোছনা’ মূলত পঞ্চাশের দশকের বাংলা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক জগতের পরিচয়। একজন লেখক এর লেখক হয়ে ওঠার অকৃত্রিম বর্ণনা। গ্রন্থটা একজন লেখকের প্রত্যয়, জেদ ও স্মৃতির জ্যোৎস্না।
প্রয়াণদিবসে দোয়া করি পরকালে তিনি নিশ্চয়ই ভালো থাকবেন।
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপারে সৈয়দ হক
- রকিব হাসান : অকাল প্রস্থান - October 16, 2025
- সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এক সাহিত্যিক ও সমাজশিক্ষক || সরোজ মোস্তফা - October 13, 2025
- শিক্ষকের জন্মদিন || সরোজ মোস্তফা - October 5, 2025
COMMENTS