সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এক সাহিত্যিক ও সমাজশিক্ষক || সরোজ মোস্তফা

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এক সাহিত্যিক ও সমাজশিক্ষক || সরোজ মোস্তফা

শেয়ার করুন:

আশ্বিনের পঁচিশ তারিখে বৃষ্টি হচ্ছে খুব। সারারাত তুমুল বৃষ্টির পর ছাব্বিশের দুপুরেও বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে মগরার তীর। মনে হচ্ছে ঢাকাতেও বৃষ্টি হচ্ছে। এই ভেজা প্রকৃতিতে দু-একটা পাখি বিদায়ী আশ্বিনকে উদযাপন করছে। শোকের বেদীতে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারকে বিদায় জানাচ্ছেন তাঁর বন্ধু ভক্ত, অনুরাগী, অনুবর্তীবৃন্দ। সেই কবে থেকে শুনছি, কারো জন্যই কিছু থেমে থাকে না। কিন্তু এই কথাটিকে এখন আর মানতে পারি না। প্রকৃতির নিয়মেই এই সকাল-সন্ধ্যা হচ্ছে-হবে-হয়েছে। কিন্তু এই যে মানুষ যাচ্ছে, একটা মানুষ কি আরেকটা মানুষের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারছে?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একজন সমাজশিক্ষক—এমন সমাজশিক্ষকের কার্যক্রম কাঁধে নেয়ার মতো মানুষ আমাদের সমাজে আর কে কে আছেন? তাই মানুষ চলে যাওয়ার পর তাঁর চেয়ারটা দখল হয় কিন্তু তাঁর গুণের অনুগামিতা ঠিকঠাক আর থাকে না। নতুন চেয়ারে বসা মানুষেরা অনেক ক্ষেত্রেই প্রাচীন ব্যক্তিকে অস্বীকার করে কিংবা তাঁর দৃষ্টি আর দার্শনিকতাকে বহন করতে চায় না। সবাইকে অস্বীকার করলে কোনো সমস্যা হয় না কিন্তু সমাজে এমন কিছু জাগ্রত ধীমান থাকেন যাদেরকে অস্বীকার করলে মাটি মরে যায় কিংবা সমাজও প্রাণহীন হয়ে যায়। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির একজন মৌলিক কথাসাহিত্যিকই নন বরং সত্য প্রকাশ ও চিন্তনচর্চায় আপন পরিধি ভাঙতে ভাঙতে তিনি পরিণত হয়েছেন ধীমান প্রাজ্ঞ পথিকৃৎ ব্যক্তিত্বে।

বাংলাদেশের সময়টাকে তিনি স্পষ্ট দেখেছেন, বলেছেন।

“কোনো বিজ্ঞানী নেই, গবেষক নেই, দার্শনিক নেই। যেদিকে তাকাবেন, শুধু প্রশাসক”—এই প্রবাদপূর্ণ সত্য কথাটি এই সময়ে আর কে উচ্চারণ করতে পারবে? তিনিই বড় শিক্ষক যিনি শেখানোর চেয়ে শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীর মনকে প্রস্তুত করেন। তাঁর মতো সজ্জন, বিনয়ী, নিরহঙ্কারী শিক্ষকের সংস্পর্শে যারা এসেছেন তারাই কেবল জানেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ভেতর-বাহির। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল চিন্তা-দর্শনের মানুষ হিসেবে কখনও আপোস করেননি। কোনো রাজনৈতিক দল বা সংঘের সাথে জড়ানো কিংবা লেজুরবৃত্তি করেননি। বিনয়ী এবং উদারপন্থার বিপরীত দর্শনের মানুষদের সাথেও বিবাদে জড়াননি। সিলেটের মানুষদের মতো সহজ ও সহমর্মিতায় বিবেকধর্ম দিয়েই মানুষকে বিচার করেছেন। নিজের লেখালেখি দিয়ে, অধ্যাপনা ও মননচর্চার মাধ্যমে, সামাজিক আয়োজন ও বক্তৃতার মাধ্যমে পরিপার্শ্বকে আলোকিত করে গেছেন। সত্যকথনে তিনি নির্মোহ ও দায়িত্ববান । বাংলাদেশে এই ঘরানার লেখক, চিন্তক, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী আর কি আসবে? নবীন পাঞ্জেরীর মতো সহজ-সরস ও স্মিতহাসিতে আর কি বলবে কেউ অনিবার্য সত্যকথা?

বাবা সৈয়দ আমীরুল ইসলাম ও মা রাবেয়া খাতুন—দুজনেই ছিলেন শিক্ষক। তাঁর মায়ের আপন মামা ছিলেন বিদগ্ধ সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী। আমার কাছে মনে হয় সৈয়দ মুজতবা আলীর মতোই তিনি ছিলেন অভিজাত, পণ্ডিত, রসিক এবং আড্ডাবাজ। সৈয়দ বংশের আভিজাত্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের ভেতরেও একজন ভালো মানুষের যতগুলো গুণ থাকার কথা, তার কোনোটিরই ঘাটতি ছিল না তাঁর।

সাহিত্য হচ্ছে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের আইডেন্টিটি আর অধ্যাপনা হচ্ছে তাঁর পেশা। আমার মনে হয় সাহিত্যচর্চা ও শিক্ষাচর্চাকে তিনি একটা সেতুতে বাঁধতে পেরেছিলেন। সাহিত্যচর্চা এবং শিক্ষাচর্চা দুটোই একটা সাধনা এবং যাপিত জীবনের দীর্ঘ এক অভিযাত্রা। পারিবারিক পর্যায়েই তাঁর সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি। সেই অভিযাত্রার শুরুতে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে আমরা দেখেছি শিল্পকলার সমালোচক হিসেবে আবির্ভূত ও বিকশিত হতে। আলস্যকে উপভোগ করেছেন তিনি কিন্তু নিয়মিতই লিখেছেন। একটু একটু করে সুপরিচিত হয়ে ওঠার দিনগুলোতে ধারাবাহিকভাবেই লিখেছেন ‘অলস দিনের হাওয়া’। একেকটি গল্পে, উপন্যাসে নিজেকেই ছাড়িয়ে গেছেন। নিজের লেখালেখি বিশেষ করে গল্প লেখা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “আমি বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, মফস্বল শহরে ঘুরেছি মানুষের জীবনের নানা গল্পের সন্ধানে, চোখ খোলা রেখেছি সেসব গল্পের পেছনের রঙগুলোকে চিনে নিতে এবং কান পেতে দিয়েছি তাদের ভাষার ধ্বনিময় অথবা নীরব অঞ্চলে যেখানে শব্দ-নৈঃশব্দ্যের দ্বৈরথে তৈরি হয় প্রতিদিনের আখ্যানগুলো। আমার গল্পের বিষয়ের জোগান দিয়েছে আমার অভিজ্ঞতা, আমাদের সংবাদপত্র, জানাশোনা মানুষজন, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমার কথোপকথন। গল্প সবখানে আছে, এবং কোনো গল্পই হারিয়ে যায় না। এক মানুষের গল্প জায়গা নেয় অন্য মানুষের গল্পে, সমষ্টির স্মৃতিতে।” এই কথাগুলোই তাঁর গল্প পড়ার ও তা নিয়ে ভাবার দরজা খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট; যথেষ্ট তাঁর গল্পের অন্তঃশিলায় প্রবহমান দর্শনকে খুঁজে নেওয়ার জন্য।

শিক্ষাজীবনে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল কবিতায় ইমানুয়েল সুইডেনবার্গের দর্শনের প্রভাব। তাঁর চিন্তাচেতনা, দর্শন ও লেখালেখির প্রত্যেকটি বিষয়-আশয় ও প্রকরণই বর্তমানের হয়ে উঠেছে। দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন—“আমাদের শাসনব্যবস্থা এখনও উপনিবেশিক মডেলের উপর ভিত্তি করে চলে। ফলে জনগণের অধিকার সহজেই অস্বীকার করা হয়, দেশের অগ্রগতি ধীরগতিতে হয় এবং জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অসমতা ও বৈষম্য বাড়তে থাকে।” এমন সহজ করে দেশকে-সময়কে নিয়ে কে আর কথা বলবেন! কে আর বলবে “মুখস্থবিদ্যা অমানুষ তৈরি করে। আমাদের দরকার সংস্কৃতি শিক্ষা।”

আমাদের দেশের শিক্ষকদেরকে নিয়ে কেউ আর তেমন ভাবেন না। শিক্ষকতা যে নিতান্ত চাকরি নয়—এই বিষয়টাকে কেউ বুঝতে ও মানতে চান না। অথচ একটা সময়কে, একটা জাতিকে একমাত্র শিক্ষকই উপযুক্ত নার্সিং করতে পারেন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তরুণদের সাথে মিশতেন, উদ্বুদ্ধ করতেন, প্রাণিত করতেন—তার একমাত্র কারণ হতে পারে এই প্রজন্মকে দায়িত্ববোধ শেখানো, করনীয়টা বোঝানো। বক্তৃতায়, আড্ডায়, লেখালেখিতে তিনি এই বেকুব জাতির মধ্যে শিক্ষা ও শিক্ষকতার ধারণাকেই প্রচার করেছেন। বাংলাদেশে চির অবহেলিত ক্ষেত্রটির নাম শিক্ষকতা। শিক্ষা ও শিক্ষকতার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এত অকপট সত্য আর কেউ উচ্চারণ করেননি । জীবনের শেষ পাবলিক স্পিচে, শেষ আক্ষেপের মতো তিনি উচ্চারণ করেছেন :

“শিক্ষককে ভালো হতে হবে। শিক্ষককে মেধাবী হতে হবে। আমাদের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা কত বেতন পান? সংস্কার তো ওইখান থেকেই শুরু করতে হবে। মৌলিক বিষয়গুলো তো আপনাকে দেখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দাবি জানান, তাদের দাবিগুলো মিটে যায়। এখনো দেখছি, বেতন বাড়ানো হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খুব আনন্দ পাচ্ছেন। তাদেরও বেতন বাড়বে। বেতন তো বাড়া উচিত প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের! এই বর্তমান বাজারে তাদের যদি দেওয়া হয় এক লক্ষ টাকা করে মাসে, তাদের থাকার জায়গা দেওয়া হয় মানসম্পন্ন, বিসিএস পরীক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করার চাইতে এই মেধাবীরা এসে প্রাইমারি স্কুলে এসে ঢুকবে। আপনি ভাবুন, কত বড় একটা বিপ্লব হতে পারে শিক্ষার ক্ষেত্রে! কেউ শোনেননি কথা। আমি বহুদিন থেকে লেখালেখি করছি। কেউ একটা কথাও শোনেননি। সংস্কার হবে কী করে? যারা সংস্কার করবেন তাদেরও তো শিক্ষার অভাব আছে।

শিক্ষার একটা সংস্কৃতি আছে, সংস্কৃতির একটা শিক্ষা আছে। দুটো মেলে না। যেসব দেশে দুটো মিলে গেছে, সেসব দেশে উন্নতি হয়েছে। শিক্ষার সংস্কৃতিটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এটা আলোকিত করে মানুষকে। আর সংস্কৃতির শিক্ষা হচ্ছে সবাইকে সবার সঙ্গে যুক্ত করা। এই প্রাণের সঙ্গে প্রাণ যুক্ত না হলে, মনের সঙ্গে মনের মিল না হলে সমাজে কলহ থাকে, সমাজে অসূয়া থাকে, নিন্দাবাদ চলতেই থাকে, এবং একসময় সেটি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তো আমরা সবাই পাই। তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভেতরে সংস্কৃতিটা কোথায় আমাদের?

আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, দ্বন্দ্বমান সমাজে সব সময় পক্ষ-প্রতিপক্ষ থাকে। পক্ষের দিকে যদি আমরা থাকি, যেখানে শুভ আছে, সুন্দর আছে, কল্যাণ আছে, তাহলে বাকিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা তো ওইদিকে চলে যাই। আমরা অকল্যাণ দেখলেই দৌড়ে পড়ি। অশুভ দেখলেই আমাদের আনন্দ হয়। বীভৎসতা-সহিংসতা আমাদের এত বেশি তৃপ্তি দেয়! একজন নিরীহ মানুষকে ধরে আমরা যে-কোনো ধরনের অন্যায় করতে পারি তার সঙ্গে। তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারি। একজন নারীর নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে কখনো দেবো না। তাদেরকে সবসময় একদম এক ধরনের মোরাল পুলিশিঙের ভেতর রাখব।”

গত ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আবু খালেদ পাঠান সাহিত্য পুরস্কার ২০২৫ বিতরণী অনুষ্ঠানে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার উপর্যুক্ত কথাগুলো বলেছিলেন। শেষ করেন এই বলে, “আগামী বছর যখন আপনাদের আবার পুরস্কার দেওয়া হবে, আমি চাই আপনারা সেটা কিশোরগঞ্জে দেন। ঢাকার মানুষ কিশোরগঞ্জে যাবে। আমি মনে করি, সেটাই ভালো হবে। তাহলে আমি নিজে যাব আমি কথাও দিচ্ছি আপনাদেরকে যদি বেঁচে থাকি।” তাঁর শেষ আক্ষেপটাও কানে বাজছে : “কেউ শোনেননি কথা। আমি বহুদিন থেকে লেখালেখি করছি। কেউ একটা কথাও শোনেননি।” (সূত্র : ডেইলি স্টার)

আমরা সবকিছুই রেখে যাই। তাই, পৃথিবীতে যাওয়া বলে কিছু নেই। আমি ছোট মানুষ। মগরাতীরের ছোট শহরে থাকি। এখানেই তাঁর সাথে দুবার দেখা হয়েছে। সামান্য কথাও হয়েছে। এইটুকু স্মৃতি নিয়েই আমি গর্বিত। একজন বিকশিত মানুষ আর মহান লেখকের লেখালেখি সহ তাঁর সঙ্গে উদযাপিত অতুলনীয় স্নেহরসিকতাপূর্ণ সামান্য স্মৃতির ভিতরেই আমি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে ধারণ করব।

১১ অক্টোবর ২০২৫


সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপারে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you