রাজনীতি-অর্থনীতিকে সমান্তরালে রেখে অনেকেই বলে থাকেন, ‘দুনিয়াতে আদর্শ-ফাদর্শ এইসব অহেতুক, ফাঁপা বুলি।’ এসব বচন সহ্য করে সমাজে এখনও দু-একজন আছেন যারা আদর্শ প্রচার করে ফেরেন। সময় ক্লান্ত হলেও তারা ক্লান্ত হন না। অসার আন্ধার দূরে ঠেলে তারা নিজের কথাটা বলতে থাকেন।
ইতিহাস খুঁজলে দেখবেন, শিক্ষকরা বরাবর নির্যাতন-নিপীড়ন-বঞ্চনার শিকার। মরে-যাওয়া সমাজে কয়েকজন মানুষও একটা আদর্শ। ‘আদর্শ’ শব্দটা ছোট কিন্তু হালকা নয়। আদর্শ একটা শক্তি, একটা ধারণা। শিক্ষকের সেই আদর্শকে অনেকেই নিন্দা করে, গুঁড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু শিক্ষক আনন্দমনে তা বহন করেন। আদর্শ কারো উপর চাপিয়ে দেয়া লাগে না। আদর্শই আপন শক্তিতে অন্যমনে সঞ্চারিত হয়।
শিক্ষক সারাজীবন শিক্ষার ভেতরেই থাকেন। কাউকে শেখানো কিংবা শিক্ষিত করা—এটা কখনোই সম্ভব না। মানুষ নিজে নিজেই শেখে। নিজের প্রেরণা থেকেই সবকিছু গ্রহণ করে। শিক্ষক একটা পুস্তকের মতো কিংবা প্রকৃতির মতো। সবাই যার যার মতো তাঁর থেকে নেবে, গ্রহণ করবে কিংবা করবে না। প্রকৃতিতে কেউ থাকতে আসে না। কাজ শেষে সবাইকে প্রস্থানে যেতে হয়। শিক্ষকেরও সময় ফুরিয়ে যায়। ফুরিয়ে যাওয়াটাই নিয়ম। শিক্ষক প্রকৃতির নিয়মে চলেন। সময়, প্রকৃতি ও মানুষকে ভালোবাসেন। শিক্ষকের কোনো দিবস হয় না। তবু বলি, সবাই ভালো থাকুক, সময়টা ভালো থাকুক।
সাহিত্যিক ও শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের সাথে নেত্রকোণাতেই সাক্ষাৎ এবং কথাবার্তা হয়েছে। নেত্রকোণা সার্কিট হাউজে অনেক তরুণের সাথে বসে থেকে আমিও তাঁর কথা শুনেছি। সে-রাতে তাঁর যে উদারতা এবং আন্তরিকতা দেখেছি তার কোনো তুলনা নেই। অনেক কিছু মিলিয়ে একজন মানুষের সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়। স্যার খুব আস্তে আস্তে, ছোট ছোট বাক্যে কথা বলেন। সরস বর্ণনায় সেসব কথায় গভীরতা থাকে, তাকে অনিবার্য সত্য। সত্যের ধারণায় না-দাঁড়িয়ে কেউ কখনো লেখক কিংবা শিক্ষক হতে পারেন না।

একটা নির্ধারিত দর্শন, দায় ও আন্তরিকতা নিয়েই শিক্ষক ও লেখক হাঁটতে থাকেন। সমাজ হয়তো তাঁর লেখাকে কিংবা শিক্ষকতাকে গ্রহণ করতেও পারে কিংবা নাও করতে পারে কিন্তু লেখক কিংবা শিক্ষক তাঁর গন্তব্যপথের উল্টো দিকে হাঁটেন না। নিজেকে প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করার নাম শিক্ষকতা; নিজেকে প্রতিনিয়ত নতুন রূপে খুঁজে পাওয়ার নাম লেখালেখি। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার প্রতিনিয়ত নিজেকে তরুণ করে উপস্থাপন করেন এবং করে যাচ্ছেন।
গন্তব্য না-জেনেও মানুষ নামের ধারণা নিয়ে যারা হাঁটতে থাকেন তারাই শিক্ষক। আমাদের সমাজ থেকে লেখক হওয়ার প্রত্যয়, শিক্ষক ও শিক্ষকতা প্রায় ফুরিয়ে যাচ্ছে। সেই ফুরিয়ে যাওয়ার সমাজে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার এখনো আছেন। মানুষটা সিলেটের কমলালেবুর মতো সরস ও সহজিয়া। এমন দরদী, সহানুভূতিপূর্ণ মানুষ বাংলাদেশে খুব বেশি নেই। এই মুহূর্তে তাঁর মতো স্মার্ট, বিবেকবান শিক্ষক বাংলাদেশে প্রায় নেই বললেই চলে।
মানুষ নাই হয়ে যাওয়ার এই সমাজে তিনি, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুন। এ প্রাণহীন সমাজকে ছায়া দিতে থাকুন। এই বিপন্ন সমাজের জন্য শিক্ষকের ছায়া খুব প্রয়োজন। আজকের দিনে স্যারের দীর্ঘ ও প্রাণবন্ত সুস্থতা কামনা করছি।
০৫ অক্টোবর ২০২৫
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপারে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
- জীবন জানাবোঝার এই অনাড়ম্বর আয়োজন || সরোজ মোস্তফা - October 23, 2025
- রকিব হাসান : অকাল প্রস্থান - October 16, 2025
- সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এক সাহিত্যিক ও সমাজশিক্ষক || সরোজ মোস্তফা - October 13, 2025

COMMENTS