যেসব কার্যকারণফেরে ফিওদোর দস্তয়েভস্কি বুদ্ধিজীবীদের অপছন্দ করতেন, ভেবে দেখলে কলিযুগের লেখকরা মোটের ওপর এই কাতারে পড়েন। নতুন চিন্তা ও সৃজনের স্ফুরণ নেই কিন্তু ভানটা গিজগিজ করছে যেখানে… এ-রকম জীবকে যদি বুদ্ধিজীবী ধরা যায়, তার সঙ্গে লেখকের অভিন্নতা কমবেশি স্বতঃসিদ্ধ। বাককুশলতার নামে বাকোয়াজি, কথার জাহাজ সেজে মানুষকে ইমপ্রেস করার ভাও, নিজের ধারণা ও বিশ্বাস অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কসরত, বিদ্যা বেচার ফন্দিফিকির…, বিশিষ্ট সাজার এইসব প্রাণান্ত কসরত ও ব্যবসাদারি বুদ্ধিজীবীতা দস্তয়েভস্কির পোষায়নি।
ভানসর্বস্ব বুদ্ধিজীবী বিপজ্জনক প্রাণী। চারপাশে যা ঘটে সেগুলোর জন্য নিজেকে সে দায়ী ভাবে না। অন্যকে দায়ী ও অপরাধী সাব্যস্ত করাতেই তার যত সুখ। মোল্লা-পুরুতের সঙ্গে এখানেই সে অভিন্ন। উভয়ের মাঝে ফারাক যৎসামান্য। সমাজে যত অনাচার চলে, দুজনেই তার জন্য অন্যকে দায়ী ঠাউরায়, অন্যের কাছে কৈফিয়ত দাবি করে, কিন্তু নিজের বেলা ঠনঠনা। এই বুদ্ধিজীবী এক ভড়ংসর্বস্ব বাকসন্ত! অন্যের হিসাব নিতে পটু কিন্তু নিজেরটা কস্মিনকালে নয়। রুশ দেশের পেটের ভিতরে এ-রকম একখানা বুদ্ধিজীবী সমাজ দস্তয়েভস্কি সরেজমিনে নিরিখ করেছিলেন। রুশি নয় বরং নিজেকে ইউরোপীয় প্রমাণে যারা ব্যস্ত থাকত। ইংরেজ-জার্মান-ফরাশিকে মক্কা ঠাউরে নিয়েছিল। আমাদের সঙ্গে ব্যাপারখানা বেশ মিলেঝুলে যায় বটে!
সমাজের চোখে ইতরজন ও খতরনাক হিসেবে সাব্যস্ত বনিআদমদের সহবতে সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত দস্তয়েভস্কির দিন কেটেছে। পাল-পাল দাগী আসামিদের সঙ্গে পার করেছেন দিনরজনি। টের পেয়েছিলেন, — জেলখাটা এইসব ধূর্ত আসামি প্রাণে বাঁচতে অপরাধের পক্ষে সাফাই গাইলেও তাদের বোধবুদ্ধি সমাজের বিশিষ্টজনদের মতো গোলমেলে নয়। অপরাধ তারা কখনোই অস্বীকার করে না। কৃতকর্মের জন্য নিজেকে দায়ী বলেই দাগায়। তাদের এই কনফেশন, নিজেকে অকপটে পাপী স্বীকার যাওয়ার হ্যাডম, তাঁর চোখে নিখাদ মনুষ্যত্ব হয়েই ধরা দিয়েছিল। ওরা নিষ্কলুষ নয় কিন্তু পাপীসন্ত বলে ভাবতে মন আপত্তি করে না। সমাজে যারা উচ্চ আসনে বিরাজ করেন নতুবা সেখানে উঠবার সিঁড়ি তালাশ করতে বেচইন থাকেন, তাদের মধ্যে এই কনফেশনটি বিরল! মনুষ্যত্ব সেখানে ইন্তেকাল ফরমায়। মরণ ঘটে তার।
কথার জাহাজ বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে সমস্যাটি আরো মর্মান্তিক। দস্তয়েভস্কির বয়ানবিশ্বে এনারা সকলে তাই খলনায়ক। Fiction Beast-এর বয়ানে দস্তয়েভস্কি কী হেন কারণে বুদ্ধিজীবীদের পোছা জরুরি ভাবতেন না, উল্টো অবজ্ঞা করতেন বেশক, সেই ব্যাখ্যা শুনতে বসে মনে হলো,— আমাদের যুগে বেঁচে থাকলে নিজের লেখক পরিচয়টিকে হয়তো মনে-মনে ঘৃণাই করতেন অপরাধ ও শাস্তির লিপিকর।
প্রাসঙ্গিক লিঙ্ক : বুদ্ধিজীবী বনাম দস্তয়েভস্কি
তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS