অন্ধকারযাত্রী || বিমান তালুকদার

অন্ধকারযাত্রী || বিমান তালুকদার

নিজের জানা এত অল্প যে মনে হয় অন্ধ আছি। চোখে দেখি না। এটি বিনয় নয়, কোনো কোনো সময় ভাবনায় মাথা এতটাই শূন্য লাগে যে ঢের ঢের টের পাই আমি সত্যিকার সংখ্যালঘু, অশিক্ষিত। এই দেশের মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ আমারই ভাবনার মানুষগুলোকে তো দেখি — ধর্ম দিয়ে নয় — তারাও আসলে ভীষণরকম একা, সংখ্যালঘু। চিম্বুক পাহাড়ে কিংবা পাহাড়ির হৃদয়, মাটি চিরে-ফেঁড়ে যে পাঁচতারা হোটেল বা বাড়তি আবাসন হয় তার আঁচ গায়ে লাগে! সভ্যতামেশিন বসিয়ে নদী, অন্যের জায়গা দখল করে বাড়ি, ভীষণ বীভৎস লাগে!

দুই.
শাল্লায়-টাল্লায় সারাবাংলায় যেসব ঘটনা হয় এসবেই তো চোখ আটকে থাকতে হয়। না-হলে পাঁচতারার ধোঁকা আসবে কোত্থেকে! লুট হবে কী করে! প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক অর্থাৎ জ্ঞানী ব্যক্তিরাও সংখ্যালঘু হন। রাজনৈতিক দুষ্টুবুদ্ধির লোকেদের মতো তারাও জানি কোন দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে আছেন ! কাদের তবে বলা — পড়ো, পড়ো? এই দেশে সব বঙ্গবন্ধুর, হাসিনার হয়ে গেলেও পড়াশোনাটা বঙ্গবন্ধুর, হাসিনার না — এইটা কে কাকে বুঝাবে? হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বলে দিলে সেটা কী মানতেই হবে!

তিন.
পড়াটা কেবল প্রভুর নামে, যিশুর নামে, ভগবানের নামে, বৌদ্ধের নামেই না। এবার না-হয় একটু পড়াশোনা শুরু করা যাক নদীর নামে, যে নিয়ত মরতে বসেছে। সবুজের নামে, যে হারিয়ে যেতে বসেছে। ফিঙে কিংবা দইয়ল পাখির নামে, যে গরু কিংবা এইজাতীয় প্রাণীর বুকে-পিঠে আনন্দে বসে যেতে পারে। সুফলা শস্যের নামে, সুবর্ণ মাছের নামে। মরমি বাউলের নামে, মানুষের নামে। আমাদের পড়া ধরতে শিখুক বেঁচে থাকতে সমূহ সৌন্দর্য উপভোগ, নির্মল সংসারের টানাটানি-মাখামাখিই স্বর্গ।

চার.
ভাবা যায় যে-লোক হাওরের পাড়ে বাস করে তার গাছ-মাছ আপনি খেয়ে ফেলবেন, আমটা খেয়ে বাকলটা দিবেন কতদিন সে এই বুঝ মানবে? কোন্ পরিশীলিত পড়া, ধর্ম তাকে শৃঙ্খলিত করে রাখতে পারবে? পারবে? কোনোদিন না! যারটা যার তাকে তা দিতে হবে। না-হয় বিদ্বেষপ্রসূত বিদ্বান হলেও হয় প্রতারক হবে, নয়তো দেশ হারাবে। দেশ পালানোর অভিশাপ কী ভয়ঙ্কর, যে পালিয়েছে সে-ই জানে! আর সহজ পথ তো মূর্খ হয়ে লাঠালাঠি করা। অবশ্য সহজ মানুষ এতটা অবিবেচক না। কলকাঠিটা ধূর্ত অন্য কেউ নাড়িয়ে নেয়।

পাঁচ.
শহর-গ্রামের ছেলেমেয়েদের হাত ধরাধরি করিয়ে ব্রতচারী করি। হাসি, খেলি, নাচি, গাই — এইসব আপনারা অচ্ছুৎ ব্যাপার বলে ভাবতে পারেন, গুরুসদয় ভাবেননি। গুরুত্বহীন বলতে পারেন। ঠাট্টা করে বেশ আনন্দও পেতে পারেন। অথচ আমি জানি একটা হাত আরেকটা হাতকে ধরার গুরুত্ব। একই ভূমির উপর দলগত কিংবা একা দলপ্রধান হয়ে স্বর্গীয় আনন্দ নিয়ে বলা — “আয় রে ভাই হিন্দু মুসলিম গলায় জড়াজড়ি / দেশের কাজে জন্ম মোদের দেশের কাজেই মরি।” … “বাংলাভূমির প্রেমে আমার প্রাণ হইল পাগল / আমি বাংলাপ্রেমে ঢাইলমু আমার দেহমনের বল গো।” — এই মরমি মৃত্তিকায় মরুর লু-হাওয়ার আওয়াজ মিশিয়ে দিতে গেলে খুব-একটা কেওয়াজ তো হওয়ার কথা না। আরো আরো ভাবনা তো মিশেছেই। সম্প্রদায়সামর্থ্যের বিঘ্ন ঘটে না এমন সমন্বয় হলেই তো হয়।

ছয়.
সিলেট অঞ্চলে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে অনেকের মতো অনেককিছু নাই তবুও একটু ভালোবাসা নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে, পাড়ায়-মহল্লায় যাই একটু গানের নামে, নাচের নামে, চিত্রকলার নামে। ছেলেমেয়েরা অন্ধের মতো মানে। লাইন ধরে। যারা গোল বাঁধায় নিশ্চয়ই তারা হয়তো আরও অন্ধ। তাদের কথা আরও বেশি মানে, শোনে।

সাত.
বলি বন্ধু, অন্ধদের বুঝতে পারবেন অন্ধ হলে। একটু অন্ধ হয়ে দেখুন। অন্য নাড়ির স্পন্দনটা কেমন। ঢিল ছুঁড়ে ঠারেঠুরে না। স্পষ্টতই পাবেন। ভয় দেখানোর প্রয়োজন নেই। শাস্ত্রভয়, মারী-মড়কও দেখা আছে। অন্ধজনকে আলো অন্ধজনও দিতে পারে মাননীয়। কূটচালের হলে অধিক আলোর জ্যোতিতে আপনিও জ্বলে মরবেন। জলে আরও দ্বিগুণ জ্বলবে। এবার একটু ভালোবাসার গান হোক। বড় অস্থির অশান্তিতে যে-গান তৃপ্তি দেয়, স্বস্তি দেয়।

আট.
যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গ নামিয়া,
মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্‌-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা —
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।

এ নহে মুখর বনমর্মরগুঞ্জিত,
এ যে অজাগরগরজে সাগর ফুলিছে।
এ নহে কুঞ্জ কুন্দকুসুমরঞ্জিত,
ফেনহিল্লোল কলকল্লোলে দুলিছে।
কোথা রে সে তীর ফুলপল্লবপুঞ্জিত,
কোথা রে সে নীড়, কোথা আশ্রয়শাখা!
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।

এখনো সমুখে রয়েছে সুচির শর্বরী,
ঘুমায় অরুণ সুদূর অস্ত-অচলে!
বিশ্বজগৎ নিশ্বাসবায়ু সম্বরি
স্তব্ধ আসনে প্রহর গনিছে বিরলে।
সবে দেখা দিল অকূল তিমির সন্তরি
দূর দিগন্তে ক্ষীণ শশাঙ্ক বাঁকা।
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
[দুঃসময় / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you