দিনলিপিতে সেলিম আল দীন

দিনলিপিতে সেলিম আল দীন

মৃত্যুর অব্যবহিত পরপর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল সেলিম আল দীনের দিনলিপি। শিরোনাম ছিল, যদ্দুর মনে পড়ে, ভাঙা প্রেম অশেষ বিশেষ । পরে ‘দিনলিপি’ শিরোনামেও বই বেরিয়েছিল, ওইটা আর হাতায়ে দেখি নাই অবশ্য। প্রথমোক্ত বইটার কথাই বলব। মোটা ঢাউস কলেবর হয়েছিল বইখানা, হাদিয়াও ওইরকম মোটা অঙ্কের। অবশ্য খরিদ করার দরকার বোধ করিনি তখন, কারণ ততদিনে একটা সাপ্তাহিকী মারফতে সেলিমের প্রায় সবটুকু দিনলিপি নিয়মিত পড়ে ফেলতে পেরেছিলাম। দীন জীবিতাবস্থাতেই সেই হপ্তাহিক সাময়িকপত্রে দিনলিপিটি ছাপা হচ্ছিল প্রতি হপ্তায়। সেই কারণেই সাপ্তাহিকীটি নিয়মিত রাখতে শুরু করি হকারকে বলে। এবং দীন লোকান্তরিত হবার পর লক্ষ করি, আরেকটি তৎকালে-নতুন-বেরোনো সাপ্তাহিক পত্রিকাও শুরু থেকে ফের একই দিনলিপি ছাপতে আরম্ভ করে। একসঙ্গে দুটোতেই চলেছিল ছাপা এবং একসময় শেষও হয়েছিল। অনুমান হয়েছিল যে, এই দিনলিপি ও এর লিপিকার নিয়ে সেই পত্রিকাদ্বয়ের মধ্যে একটা চাপা লড়াই চলছে তখন অধিকারবোধ প্রচারের। জাবি থেকে বেরোনো স্টুডেন্টদের মধ্যে সেইসময় দীনপুত্র বলিয়া দাবিদাওয়া কার-না মুখে শোনা যেত? শতকরা সাত ভাগ কবিতা-করা পোলাপান তখন ক্লেইম করত দীন তার আব্বা, আল্লার কিরা! যা-হোক, কথিত সাহিত্য ও সাহিত্যিক বিষয়ক ওইরকম আলাপ-প্রলাপের আড়ম্বর অনুপস্থিত বলেই দিনলিপিটা আমি স্বস্তির সঙ্গে শান্তিতে স্বচ্ছন্দে পড়ে যেতে ও খতম দিতে পেরেছিলাম। উনার নাট্যজীবনের নায়িকাদের অনেকেরই বিষয়াশয় ইঙ্গিতে-ভঙ্গিতে এসেছে, উনাদের কারো কারো ললিতকলাকারুকৃত মুখ-দেহ অল্পবিস্তর চেনা বা ছায়াচেনাও মনে হয়েছে পড়ে যেতে যেতে। সেসব এখন আর খামাখা কে মনে করে? অ্যানিওয়ে। সেলিম আল দীন অন্তত তাঁর দিনলিপিতে দেখলাম আমার মতোই ছোট ছোট জিনিশের গাথাকার, তুচ্ছাতিতুচ্ছের ইন্টারপ্রেটার, সহজের ঈশ্বর। যে-জিনিশটা তাতে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে তা হলো, ওই দিনলিপিটায়, মানে ‘ভাঙা প্রেম অশেষ বিশেষ’ নামের বইটায়, দিনানুদৈনিকতার একটা আদল/রূপ যেমন ছিল, পাশাপাশি ছিল দৈনিকতাকে খানিকটা উর্ধ্বে নিয়া যাওয়ার চেষ্টা। দৈনিকতা ও চিরকালিকতার মিশেল দিয়া যা তৈরি, তা কী আর ভালো না-লেগে পারে! কথিত সাহিত্যিকেরা লিখতে বসলেই ভুলে যান দিনানুদৈনিকতা, যার ফল বেশিরভাগ সময়ই ভালো হয় না। অ্যাজ অ্যা রেজাল্ট সাহিত্য হয় খালি, বিস্তর সাহিত্যপনা হয়, নিখিলবাংলায় বেহুদা সাহিত্য হয় দেদারসে, হ্যাঁ, সাহিত্যেরও উচ্চতর দরকার নিশ্চয় আছে। এদিক থেকে দীনের দিনলিপি আমার কাছে গুরুত্ববহ। ওই দিনলিপিরই কোথাও এক-জায়গায় সেলিম একটি কথা লিখে গিয়েছেন, যেটি আরেকবার মনে পড়ে গেল বলেই আজ এখানে এই শূন্যায়তনে সেলিম আল দীন স্মরণ করছি। দীনস্মরণের অন্যান্য কারণও অধিকতর দরকারি। বিশেষত নাট্যকাজে তার কন্ট্রিবিউশন। কিন্তু ওসব দরকারি কাজের জন্যে দেশে ম্যালা কাজি তো রয়েছেনই। কিন্তু ওই, ঠিক উদ্ধৃতি তো টুকতে পারছি না, আদ্যিকালের পত্রিকাগাট্টি খুলে বিছড়াইতে তো পারব না, বা বাজারে অ্যাভেইলেবল দীনরচনাসমগ্র খরিদেরও নাই ক্ষ্যামতা; আল দীন বলেছিলেন, — বন্ধুবান্ধবদের প্রাত্যহিক খারাপ আচরণগুলো, ভুলত্রুটিগুলো, তাদের চারিত্রিক স্খলনগুলো, দুর্বলতাগুলো খোলামেলা লিখে রাখলে দিনলিপি সম্মানিত হবে না, খর্ব হবে বরং। কথাটা আমারে বেশ ভাবিয়েছিল তখন।

লেখা / জাহেদ আহমদ ২০১৩

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you