কবি জসীম উদদীনের প্রতি মুগ্ধতা সেই ছোটবেলা থেকেই ছিল। বাংলা সাহিত্য পাঠে তার কবিতাগুলি সারাবছরের খোরাকি ছিল আমাদের। হুমায়ূন আহমেদকে চিনেছি এসএসসির পরে। তার আগে জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসটাই জীবনে প্রথম পড়া কোনো উপন্যাস। কবি জসীম উদদীনের চিরায়ত গ্রামবাংলা, সহজ সরল মানুষ — এইগুলা এত গভীরভাবে ছেলেবেলায় ঢুকে গেল যে আজো তাদের অন্তরে-বাহিরে ধারণ করি।
২
‘বেদের মেয়ে’ নামে যাত্রাগানের একটা ছোটমোটো বই ছিল জসীম উদদীনের লেখা। গোটা কলেজলাইফে ওই বইটা কতবার যে পড়েছি! বেদেনি চম্পার জন্য বুকটা হু হু করে আজো। ঘুমোবার আগে প্রায় প্রতিদিনই নিয়ম করে গয়া বাইদ্যা আর চম্পার ডায়লগ পড়তাম। জসীম উদদীনের প্রতি মোহ আজো প্রবলভাবে সুপ্ত আছে। পিডিএফে গতকাল আনলাম তার ‘বোবা কাহিনী’ উপন্যাস। কী দুর্দান্ত লেখা রে ভাই! এই বই যদি সেইসময় ইংরেজিতে অনুবাদ হতো, আর.কে. নারায়ণ কিংবা চিনুয়া আচেবের সাথে জসীম উদদীনকেও আমরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেখতে পেতাম। যা-ই হোক, লেখকের কাজ শত শত বছর পরেও ইতিহাস হয়ে থাকে। জসীম উদদীন সে-অগ্রযাত্রায় সবার আগেই আছেন।
৩
দেবেশ রায় উপন্যাস আর আখ্যান নিয়ে যে-প্রবন্ধ লিখেছিলেন সেখানে যদি জসীম উদদীনের ‘বোবা কাহিনী’ নিয়ে একটা উদাহরণ দিতেন, অথবা যদি ফরহাদ মজহার ‘বেদের মেয়ে জোছনা‘ সিনেমা নিয়ে ৮/৯ পাতার মতো আরেকটা লেখা লিখতেন এটা নিয়ে — তখনই ঢাকার টনক নড়ত। এ-দেশের সাহিত্যর মান ঢাকার মিডিয়াই ঠিক করে দেয়। আপনি বিপ্লব দাশ, যদি প্রচলিত কথাসাহিত্যর পুটকি মেরে দিয়ে নতুন উপন্যাস খাড়া করেন, দেখবেন দিনশেষে আপনার পাঠক একজনও পড়ছে না। আপনি শহীদুল জহির, ইলিয়াস যদি আপনাকে নিয়ে দু-কথা না বলত আপনার খ্যাতি পেতে বিলম্ব হতো আরও।
জসীম উদদীন যে-উপন্যাসটা উপহার দিয়েছেন আমাদের, সেখানে দেখি আধুনিক উপন্যাস থেকে তার নির্মাণ আলাদা। সকালে বাদশা বিকালে ফকির — এই লোককাহিনির চরিত্র আজাহের। তার সিম্পল জীবনের বর্ণনা। এখানেও বশিরের ছোটবোন বড়ু মারা যায়। অপুর দুর্গার মতন। কিন্তু বর্ণনার কায়দাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেন পুঁথিপাঠের বিলাপ হাহাকার হয়ে গোটা জনপদে ছড়িয়ে পড়ছে। এখানেও খেলাফত আন্দোলনের মোল্লারা উঠে আসে। তারা বাউলগান নিয়ে বাধা দেয়। সারিন্দা ভেঙে ফেলে। বাউলদের চুল কেটে ছেড়ে দেয়। কিন্তু বাউলরা যে-সাধনা করে, যে-সৃষ্টিকর্তাকে মাশুক বলে গান বাঁধে সে অন্য জিনিস, এই ব্যাখা আধুনিক উপন্যাসে বিরল।
- জীবনের ঋতুসমুদয় || শিলামনি - July 20, 2025
- কেইটের কামাই - July 12, 2025
- অন্যদিন সিনেমাটি || তুহিন কান্তি দাস - July 12, 2025
COMMENTS