বিশ্ববিখ্যাত জেনসাধু ও কবি তিক নাত হান ১৯২৬ সালে ভিয়েতনামে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ষোলো বছর বয়সে তিনি হুয়ের তু হিয়ু মঠে প্রবেশ করে সন্ন্যাসজীবন শুরু করেন। তরুণ বয়সেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে বৌদ্ধধর্ম কেবল ধ্যানমগ্ন থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার বিষয় নয়, বরং সমাজের দুঃখকষ্ট লাঘবেও সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার বিষয়ও। এই চেতনা বুকে নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামে তিনি ক্ষুধার্ত ও গৃহহীন মানুষের পাশে দাঁড়ান। আর জন্ম দেন ‘এনগেজড বুড্ডিজম মুভমেন্ট’-এর—যেখানে করুণা আর কর্মই আসল।
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েতনামের সাইগনে ভান হান্ বুড্ডিস্ট ইউনিভার্সিটি, লা বোই প্রকাশনা সংস্থা এবং একটি প্রভাবশালী পিস অ্যাক্টিভিস্ট ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়ে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং পরে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে করেন শিক্ষকতা । ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘অর্ডার অব ইন্টারবিয়িং’ এবং একই বছরে তাঁর সাক্ষাৎ হয় ড. মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের সাথে। লুথার কিং তাঁকে ‘শান্তি ও অহিংসার প্রেরিত দূত’ বলে আখ্যা দেন এবং নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন। কিন্তু এই কার্যকলাপের ফলে তিক নাত হানকে দেশে ফেরার পর সরকারের রোষানলে পড়তে হয়। যার ফলে তিনি স্বদেশ থেকে নির্বাসিত হন দীর্ঘ উনচল্লিশ বছরের জন্য।
দীর্ঘ নির্বাসনে হান ফ্রান্সে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলেন এবং ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন প্লাম ভিলেজ মঠ। ধ্যান, সচেতনভাবে হাঁটা, নিঃশব্দ আহার, শান্তভাবে শ্বাস নেওয়া—এই সরল কিন্তু গভীর অনুশীলন তিনি ছড়িয়ে দেন বিশ্বের নানা প্রান্তে।
তাঁর সাহিত্যচর্চা ছিল সমৃদ্ধ ও বহুমুখী। জীবদ্দশায় তিনি একশরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন, যার মধ্যে বৌদ্ধ দর্শনের সহজ ব্যাখ্যা, প্রবন্ধ, আধ্যাত্মিক নির্দেশনা ছাড়াও ছিল কবিতা। তাঁর কবিতাগুলোয় ফুটে উঠেছে প্রকৃতির প্রতি মমতা, জীবনের অনিত্যতা, আর সচেতনতার দীপ্তি। সহজ অথচ গভীর ভাষায় তিনি লিখেছেন মানুষের অন্তরের ব্যথা ও মুক্তির গান। একই সঙ্গে তাঁর ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্মও ধ্যানের এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ হয়ে উঠেছিল।
তরুণদের জন্য তিনি গড়ে তোলেন Wake Up আন্দোলন, শিশুদের জন্য Wake Up Schools, আর সবার জন্যই প্রণয়ন করেন Five Mindfulness Trainings।
২০১৪ খ্রিস্টাব্দে এক গুরুতর স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তিনি প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে যান, তবুও তাঁর উপস্থিতি সকলকে অনুপ্রাণিত করে গেছে। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফিরে আসেন তাঁর শৈশবের আশ্রম তু হিয়ুতে, যেখানে জীবনের শেষ দিনগুলি অতিবাহিত করেন। ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি ভোরে মহাপ্রয়াণ ঘটে এই মহাত্মা সন্ত ও কবির।
সন্ত কবি তিক নাত হানের দুইটি কবিতার অনুবাদ এইখানে রইল, সঙ্গে একটি কবিতার অন্তরালের কাহিনি তিক নাত হানের মুখে।
জ. ক.
১৯/০৬/২৪

ভূমিস্পর্শ
মৃত্যু এসে হাজির হয়
তার মনোরম কাস্তে নিয়ে
আর বলে,
‘তোমার আমাকে ভয় পাওয়া উচিত।’
আমি জিজ্ঞেস করি চোখ তুলে,
‘কেন ভয় পাবো তোমায়?’
‘কারণ তোমাকে মেরে ফেলব আমি।
করে ফেলব অস্তিত্বহীন।’
‘অস্তিত্বহীন? কীভাবে করবে তুমি?’
মৃত্যু নিরুত্তর।
সে তার মনোরম কাস্তে নাড়ে।
আমি তাকে বলে উঠি, ‘আমি আসি, আবার যাই।
তারপর আবার আসি। আবার যাই।
আমি বারবার আসি ফিরে।
তুমি আমাকে কিছুই করতে পারো না—
না অস্তিত্ববান, না অস্তিত্বহীন।’
সে জিজ্ঞেস করে,
‘কী করে জানো তুমি ফের আসবে ফিরে?’
আমি বলি,
‘আমি জানি, কারণ আমি তা করেছি অসংখ্যবার,’
ভ্রুকুটিতে শুধায় সে,
‘কীভাবে বুঝব তুমি যা বলছ তা সত্য?
কে হবে সেই সাক্ষি?’
ভুমিস্পর্শ করে জানাই,
‘এই পৃথিবীই সাক্ষি। তিনি আমার মা।’
হঠাৎ করেই, মৃত্যুর কানে বাজে সুর—
হঠাৎ করেই, মৃত্যুর কানে বাজে চারদিকের কূজন।
হঠাৎ করেই, মৃত্যুর চোখে ভাসে গাছগুলোর প্রস্ফুটন
মৃত্যুর সামনে পৃথিবী নিজেকে মূর্ত করে তোলে
আর প্রেমভরা হাসি দিয়ে তাকানো পৃথিবীর
প্রেমদিঠিতে মৃত্যু গলে যায়।
হে আমার প্রিয়,
ভয় পেলে তুমি প্রতিবারই কোরো ভূমিস্পর্শ।
কোরো গভীর স্পর্শ তাকে,
তাহলে গলে যাবে তোমার দুঃখ।
কোরো গভীর স্পর্শ তাকে,
তাহলে তুমি পাবে স্পর্শ—মৃত্যুহীনতার।

দয়া করে আমাকে আমার প্রকৃত নাম ধরে ডাকো
বলো না যে আমি কাল চলে যাব—
বরং আজকেও আসছি আমি।
গভীরভাবে তাকাও : প্রতি মুহূর্তে আসছি আমি
হতে কুঁড়ি এক বসন্ত-শাখায়,
হতে শান্ত-পলকা ডানা সহ একটি ছোট পাখি,
শিখছি আমার নতুন নীড়ের গান,
হতে ফুলের হৃদয়ে এক শুয়োপোকা,
—পাথরে গুপ্ত রত্ন এক।
আমি এখনও আসি হাসতে আর কাঁদতে,
পরশ পেতে ভীতি আর আশার।
আমার হৃদয়ের ছন্দে খেলে
সকল জীবিতের জন্ম ও মরণ
নদীপৃষ্ঠে রূপান্তরিত মাছিটি আমি।
এবং—আমিই সেই পাখি
যে ছোঁ মেরে গিলে ফেলে মাছি।
পুকুরের স্বচ্ছ জলে সুখে সাঁতারকাটা ব্যাঙটি আমি
এবং আমিই সেই সবুজ সাপ
যে চুপে চুপে খেয়ে ফেলে ব্যাঙ।
আমি উগান্ডার অস্থিচর্মসার শিশুটি
আমার পাগুলো বাঁশের কঞ্চির মতো সরু।
এবং আমিই সে অস্ত্রব্যবসায়ী
যে উগান্ডায় করছি বিক্রি মারণাস্ত্রের।
আমি—সেই বারো বছর বয়সি বালিকাটি,
উদ্বাস্তু, ছোট নৌকায় ভাসা,
সাগরের অতলান্তে যে ছুঁড়ে দেয় নিজেকে
জলদস্যুর হাতে হারিয়ে সম্ভ্রম।
এবং আমিই সেই জলদস্যু
ভালোবাসা ও প্রেক্ষণে যার হৃদয় অক্ষম।
আমি সেই অসীম ক্ষমতার মালিক এক পলিটব্যুরোর সদস্য,
এবং আমি সেই মানুষটি যাকে তার শোধতে হয় রক্তের ঋণ
জোর করে পাঠানো শ্রমশিবিরে ধীরে ধীরে মরতে বসা আমার জনতার।
আমার আনন্দ বসন্তের মতো, খুব উষ্ণ
সারা পৃথিবীতে ফোটায় ফুল।
আমার বেদনা এক বিশাল অশ্রুনদী
অনায়াসে চার চারটি সাগর করে পূর্ণ।
দয়া করে আমাকে আমার সঠিক নাম ধরে ডাকো,
যাতে আমি আমার সকল কান্না-হাসি শুনতে পারি তৎক্ষণাৎ,
যাতে আমি দেখতে পারি আমার আনন্দ ও বেদনা এক।
দয়া করে আমাকে আমার প্রকৃত নাম ধরে ডাকো
যাতে করে আমি জেগে উঠতে পারি
আর আমার হৃদয়ের দরোজা,
করুণার দরোজা, খোলা রাখতে পারা যায়।

‘দয়া করে আমাকে আমার প্রকৃত নাম ধরে ডাকো’ কবিতাটির পটভূমি নিয়ে তিক নাত হানের বক্তব্যরচনাটির ভাষান্তরও নিচে দেওয়া হলো :
ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর প্লাম ভিলেজে অসংখ্য মানুষ চিঠি পাঠাতেন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইন থেকে প্রতি সপ্তাহে আমরা শ’খানেক চিঠি পেতাম। সেগুলো পড়া বেশ যন্ত্রণার ছিল, কিন্তু আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে হচ্ছিল। আমরা সাহায্য করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু দুর্ভোগটা ছিল প্রচণ্ড, এবং মাঝে মাঝে আমরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছিলাম। ভিয়েতনাম থেকে নৌকা দিয়ে পালানোর পথে অর্ধেক মানুষই সাগরে মারা পড়েছিল; কেবল অর্ধেক লোক পেরেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপকূলে পৌঁছতে।
নৌকায় পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করা অনেক তরুণী জলদস্যুদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল। এমনকি জাতিসংঘ এবং অনেক দেশ ঐ ধরনের জলদস্যুতা প্রতিরোধে থাইল্যান্ডের সরকারকে সাহায্যের চেষ্টা করেছিল। একদিন আমরা একটি চিঠি পেয়েছিলাম এক তরুণী সম্পর্কে, যে কিনা থাই জলদস্যুদের দ্বারা ছোট একটি নৌকায় ধর্ষিত হয়েছিল। তার বয়স ছিল মাত্র বারো বছর, সে পানিতে ডুবে আত্মাহুতি দেয়।
এরকম বিষয় প্রথম জানার পর আপনার জলদস্যুদের প্রতি ক্রোধ জাগবে। আপনি স্বভাবতই মেয়েটির পক্ষ নেবেন। কিন্তু আরও গভীরভাবে দেখলে আপনি তা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেখতে পারবেন। আপনি যদি ছোট মেয়েটির পক্ষ নেন, তাহলে তা সহজ হয়। আপনাকে কেবল একটি বন্দুক নিতে হবে এবং জলদস্যুটিকে গুলি করতে হবে। কিন্তু আমরা তা করতে পারি না। ধ্যানে আমি উপলব্ধি করেছিলাম, যদি আমার জন্ম ওই জলদস্যুটির গ্রামে হতো এবং তার মতো একই পরিবেশে বেড়ে উঠতাম, আমিও এখন জলদস্যু থাকতাম। আমার জলদস্যু হয়ে ওঠার অনেক সম্ভাবনা থাকত। আমি সহজে নিজেকে নিন্দা করতে পারি না। ধ্যানে আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে, থাই উপসাগরে প্রতিদিন শত শত শিশুর জন্ম হয়, এবং যদি আমরা, শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী, রাজনীতিক, ও অন্যান্যজন এই পরিস্থিতে কিছু না করি, পঁচিশ বছরের মধ্যে তাদের একটা অংশ জলদস্যুতার খাতায় নাম লেখাবে। তা নিশ্চিত। যদি আপনি বা আমি ঐসব জেলেগ্রামে জন্মগ্রহণ করতাম, আমরা হয়তো পঁচিশ বছরের মধ্যে জলদস্যু হয়ে যেতাম। এখন আপনি যদি বন্দুক দিয়ে দস্যুটিকে গুলি করেন, আপনি আমাদের সকলকেই গুলি করলেন, কারণ আমরা সবাই এই অবস্থার জন্য কিছুটা হলেও দায়ী।
দীর্ঘ ধ্যানের পর আমি এই কবিতাটি লিখেছিলাম। এতে তিনজন লোক : বারো বছর বয়সি বালিকা, জলদস্যু এবং আমি। আমরা কি পরস্পরের দিকে তাকাতে পারি এবং নিজেদেরকে অন্যদের মধ্যে চিনতে পারি? কবিতার শিরোনাম ‘দয়া করে আমাকে আমার প্রকৃত নাম ধরে ডাকো’। কারণ আমার অনেক নাম। যখন আমি এইসব নামের একটিতে ডাক শুনি, আমাকে ‘হ্যাঁ’ বলে জবাব দিতে হয়।
জয়দেব কর রচনারাশি
- ধরিত্রীর নিকট প্রেমের চিঠি-৩ / ধরিত্রীমায়ের বুকে কোমলভাবে হাঁটা || তিক নাত হান || ভাষান্তর : জয়দেব কর - October 14, 2025
- ধরিত্রীর নিকট প্রেমের চিঠি-২ / তোমার বিস্ময়, সৌন্দর্য ও সৃজনশীলতা || তিক নাত হান || ভাষান্তর : জয়দেব কর - October 9, 2025
- ধরিত্রীর নিকট প্রেমের চিঠি-১ :: সকল কিছুর প্রিয় মা || তিক নাত হান || ভাষান্তর : জয়দেব কর - October 4, 2025

COMMENTS