ওস্তাদের জন্যে গান || বিজয় আহমেদ

ওস্তাদের জন্যে গান || বিজয় আহমেদ

নবারুণের গল্পের সাথে আমার পরিচয় শিবু কুমার শীলের হাত ধরে। এক সন্ধ্যায় আজিজ মার্কেটে শিবুদা কইলেন — ‘বাপ্পি, নবারুণের গল্প পড়ছ? না পড়লে পইড়া ফালাও।’ তারপর ১৩/০৬/২০১১ তারিখে সন্ধ্যা ৭.৩০টার দিকে  বোধয়  নবারুণের শ্রেষ্ঠ গল্পটা কিইনা ফালাই প্রথমা  থেকে। অবশ্য তার আগেই সুমন মুখোপাধ্যায়ের হারবার্ট  দেইখা ফালাইছি রুদ্র আরিফের বদান্যতায়। বলে রাখা ভালো, এই মহাপৃথিবীর অল্প যে-কয়েকটা অসাধারণ ফিল্ম দেখছি আমি তার সিংহভাগই রুদ্র আরিফ তুলে দিয়েছে আমার হাতে। তখনো কিন্তু হারবার্ট  পড়া হয় নাই। হারবার্ট  পড়েছি অনেক পরে। তার মানে নবারুণকে না-চিনেই হারবার্ট  দেখার চেষ্টা করেছি আমি। সুমন আরেকটা মাস্টার এইটাও কিন্তু বইলা রাখতে হয় এই সুযোগে। যে-কারণে নবারুণের হাতে হাত রেখেও সুমন,  সুমন হয়ে উঠতে পেরেছেন। সুমনের ঐ সিনেমা, রুদ্র আরিফ ও শিবু কুমার শীল আমাকে ঐ নবারুণ নামের লোকটার দিকে ঠেলে দিয়েছে ভীষণ। এরপর যখন তার শ্রেষ্ঠ গল্প  পড়েছি তখন থেকে আমি ভয় পেয়েছি আসলে। নত হয়েছি। উফ! সে এক ভয়ঙ্কর গদ্যকার! সে এক মহান স্টোরিটেলার আমার! মাস্তান ও মাস্টার আমার!

০২
তারপর জেনেছি নবারুণ বিপজ্জনক এক যোদ্ধা মানুষ। কলকাতার যে কাজটাকেই বা লেখক বা কবি বা ফিল্মমেকারকে অস্ত্রধারীর মতো বিপজ্জনক মনে হইছে খোঁজ নিয়া দেখি কি, সে-লোকও নবারুণের ভাইবন্ধু। আরো জেনেছি নবারুণ মহাশ্বেতা দেবীর ছেলে। অথবা কখনো-না-কখনো নবারুণের মায়ের নাম মহাশ্বেতা দেবী। হাজার চুরাশির মা  লিখেছেন ‍যিনি। আবার কখনো নবারুণের বাবার নাম বিজন ভট্টাচার্য। বিখ্যাত অভিনেতা ও গণনাট্য আন্দোলনের কর্মী যিনি। হায়, এভাবেই কখনো নবারুণ-আবিষ্কারে নেমে তার বাবা-মাকেও চেনা হয়ে যায়। অথচ আমরা কে না জানি মহাশ্বেতার নাম। কে না জানি বিজন ভট্টাচার্যের নাম।

তারপরেও নবারুণের হাত ধরে মহাশ্বেতা ও বিজন পরিচিতি পান আমার কাছে। এও এক নতুন পরিচয় যেন। মনে হতে থাকে এভাবেই মহান কোনো পুত্রের বিশ্বস্ত কাঁধ তাঁর বাবা ও মাকে বহন করে যায় আজীবন।

০৩
হারবার্ট  উপন্যাসটা পড়েছি যখন, নবারুণ সম্পর্কে আমার অনেক ভুল বা সঠিক জানাশোনা হয়েছে তার অনেক পরে। রোমহর্ষক ও অতিজান্তব একটা উপন্যাস। কোনো ভণিতা নাই। এ যেন কৃমি ও পেটে-পাকায়া-উঠতে-থাকা বমির সাথে জড়িয়ে থাকা। বেঁচে থাকা।

নাম হারবার্ট সরকার। পিতা ললিতকুমার। মা শোভারাণী। ললিতকুমার সিনেমায় টাকা খাটিয়ে বড়লোক হওয়া লোক। জিপদুর্ঘটনায় পিতা আর কারেন্টের শকে মায়ের মৃত্যুর পর হারবার্টের শুধুই ভয়, মুত্যু, আত্মহনন, ঠকবাজি, মৃতের সঙ্গে কথোপকথন, পিউ কাঁহা পিউ কাঁহার জ্যাঠামশাই, নকশালপন্থী বিনু, বিনুর ডায়েরি, মাতলামি, খিস্তিখেউড়, মৃতা পশ্চিমা নারীদের গান, পরলোক আর পরলোক, বাংলামদ, ক্ষুধা, কখনোই হারবার্টের সঙ্গে বেঈমানি না করা চিলছাদ আর আবোলতাবোল। উত্থান ও পতন। অদ্ভুত ও বিবমিষাময় এক জীবন। আর নবারুণের গদ্য — সে আরেক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আমাদের।

কিন্তু হারবার্টের উত্থান যেমন আমার কাছে যৌক্তিকতার চেয়েও বেশি সিনেম্যাটিক (নাকি জীবন, বাপের বাঞ্চোৎ ছেলে বলেই এমন সিনেম্যাটিক!) মনে হয়েছে তেমনি তার পতনকে মনে হয়েছে আরো করুণ। মানে হারবার্টকে ধরা খেতে হবেই যেহেতু নবারুণ চাচ্ছেন। হারতে তাকে হবেই। মরতে তাকে হবেই। কেননা নবারুণ চাচ্ছেন। উপন্যাসের চরিত্র এভাবেই বুঝি লেখকের ইচ্ছার কাছে হার মেনে নেয়। হায়!

বুঝি নবারুণ হলো পোড়খাওয়া  সেই ভাস্কর যে অতিকায় পাথরের ব্যক্তিত্ব অস্বীকার করতে পারেন। তারপর হাতুড়ি আর বাটাল দিয়ে ছেনে ছেনে শেপ দিতে পারেন নিজের আকাঙ্ক্ষার। প্রাণ দিতে পারেন পুনরায়। নতুন পরিচয়ও দিতে পারেন সেই পাথরখণ্ডকে। নিজের মতো করে। নিজের আকাঙ্ক্ষা বা ড্রিম তার চিরআরাধ্য আমরা জানি। তা যত প্রতিকূলেই থাকুক। তাহার পরেও। কেননা নবারুণ তো ঘোষণাই করেন, আশা-হতাশা জর্জরিত সাম্প্রতিক ইতিহাস আমার লেখক সত্তাকে কতটা আলোড়িত করেছে সেটা গল্পগুলোতে টের পাওয়া যাবে। মতাদর্শগত একটা যোগসূত্র খুব সরলীকৃত দৃষ্টিতে না হলেও থেকে গেছে বলে আমার বিশ্বাস। সময় যদি নির্মম হয় নির্দয় হয় তাহলে তার কাছে নতিস্বীকার করায় আমি বিশ্বাস করি না। আর নির্দয় সময়রাক্ষুসীকে চাবকাতে চান বলেই পশ্চিমবঙ্গ যুক্তিবাদী সঙ্ঘের কাছে কিংবা করুণাযোগ্য ডা. টিনার কাছে হার মানতে হয় অসীম ক্ষমতাবান (ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়্যান) হারবার্টকে। হারুকে। ‘দোবেড়েরে চ্যাং দেকাব’ লিখতে হয়, লিখতে হয় ‘চৌবাচ্চার তেলাপিয়া গঙ্গাসাগরে চলল।’ অথচ ঘাস্টলি ম্যানারে কিংবা ‘ভূতের জলসায় গোপাল ভাঁড়’ পড়তে পড়তে এইসব যুক্তিফুক্তিকেও চুদে দিতে পারত আমাদের অন্তরের হারু। ভুখা হারু। নিমেষেই পশ্চিমবঙ্গ যুক্তিবাদী সঙ্ঘেরও পাছার কাপড় উদোম করে দিতে পারত লোকটা। এই ক্ষমতা উপন্যাস জুড়ে হারুর ছিল। ব্যক্তিত্বেও ছিল এই জোর। হায়, তবু আরো কোনো শাণিত আক্রমণ দেখাবেন বলেই হেরে যেতে হয় হারুকে, হারবার্টকে। রাষ্ট্রের ক্ষমতাকৌশলকে টেক্কা দিয়ে নিজের প্রতিরোধকৌশলকে জারি রাখতেই  বুঝি হারুর নিয়তিতাড়িত ক্যারাভানের লেজ টেনে ধরেন নবারুণ। এমনটাই মনে হয়। (কেননা নবারুণ তো আর শ্যামল গাঙ্গুলী নন যে কুবেরের নিয়তিতাড়িত জার্নির সাথে নিজেকেও ভাসিয়ে দেবেন। তারপর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবেন ক্যারেক্টারের নিজস্ব সুষমা!) আর এই যে প্রতিরোধ শাণাতে গিয়ে মার খেতে হলো হারবার্টকে (অথচ আমি স্লোগান দিতে চেয়েছি যুগ যগ জিও হারবার্টদা) এখানেই একটা ছোট্ট কমার মতো আপত্তি  তৈরি হতে থাকে আমার (হায় সাহিত্যিক আকাঙ্ক্ষা!)। অথচ আমার এই আপত্তির জায়গাটাকে ওভারলুক করেই বিপ্লবী দাঁড়ায়ে থাকে সটান। দেখি  এই মোড়টা পার হয়েই বিপ্লবী ঘোষণা করেন, ‘কখন, কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা কে ঘটাবে সে-সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনো বাকি আছে।’

বুঝি অল্পপ্রাণ আমি। অল্পতেই খেই হারাই। অথচ গেইমটা নিরন্তর চলতেই থাকে। আর চলতে-থাকা গেইমে অংশ নিতে চাইলে এইভাবে অনেককিছু ওভারলুক ও ওভারটেক করে বিস্ফোরণটা ঘটায়ে ফেলতে হয়।

০৪
৩১ জুলাই, ২০১৪। নবারুণ, আপনি শরীরের ভার আর বইবেন না কখনো। ক্যান্সার হয়েছিল আপনার। কিন্তু এই পৃথিবীর ভার কিন্তু পৃথিবীকে সইতেই হবে। ‘বহিবে না আর অবিরাম অবিরাম ভার’ বলে তার মরে যাবার সম্ভাবনা বা সুযোগ কোনোটাই নাই। ফলে নবারুণ জেনে রাখুন ইজরায়েলি বোমা আবার ছুটে যাবে গাজার দিকে। ইরাক নাই হয়ে যাবে ভ্রাতৃঘাতী হননপিপাসায়। নরেন্দ্র মোদীদের সাম্প্রদায়িক পালের হাওয়া বেগবান হবে। হিন্দু আরো হিন্দু হয়ে উঠবে। মুসলিম আরো মুসলিম হয়ে উঠবে। ইহুদি আরো ইহুদি হয়ে উঠবে। খ্রিশ্চান আরো খ্রিশ্চান হয়ে উঠবে। চিটাগাঙের বুড্ডিস্ট ক্রমেই হয়তো মায়ানমারের বুড্ডিস্ট হয়ে উঠবে। কালশীর বিহারীরা হয়তো নাই হয়ে যাবে একদিন। চট্টগ্রামের রাউজানে যে রোহিঙ্গা ছেলেটা পান খাওয়াত সে বেদম মারা পড়বে একদিন আমাদের হাতেই। হয়তো আরো শত শত তুবা গার্মেন্টস এই শহরে নিদারুণ করুণা করবে আমাদের।

শুধু মানুষ শব্দটা ছোট একটা কীটের মতন এদিক-ওদিক ডানা ঝাপ্টাবে। আর কেউ হয়তো চিৎকার করে বলবে ‘সিনেমায় মার্ডার দেখতে বেশ লাগে। ‍আমরা এত খুনখারাবি দেখছি ‍কিন্তু সব বেঁচে আছে।’

যেন ফূর্তির পিউ কাঁহা পিউ কাঁহা। ঢেঁপের কেত্তন শাল্লা!

আজ বুহস্পতিবার। ৩১ জুলাই,  ২০১৪। আজ থেকে স্মৃতিচারণের ‍অংশ আপনি, নবারুণ। বহু দূর ও দূরত্বের ঐ নীল কচ্ছপের দেশে, ভাবি, নবারুণের নক্ষত্রখচিত উর্দি এতক্ষণে পত পত করে উড়তে শুরু করেছে নিশ্চয়ই।

০৫
আমার অন্তহীন ও বোকা বোকা প্রণয়ের নাম সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। লোকটা সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসে আছেন আমার কাঁধে। গল্পকার বা ঔপন্যাসিক সন্দীপন যতটা না তারচে অধিক গদ্যকার সন্দীপনের প্রতি মোহ প্রেম আমার। অন্ধ স্কুলে কখন ছুটির ঘণ্টা বাজবে। বিড়ালের হায়ের ভিতর মাথা-পেতে-রাখা ইঁদুর ও বিড়ালের সে কী অপেক্ষা কখন অন্ধ বাচ্চাগুলা আসবে। কখনই-বা ভুল করে মাড়িয়ে দেবে বিড়ালের লেজ। আর বিড়ালের হা বন্ধ হয়ে আসবে। সাঙ্গ হবে ইঁদুরের ইঁদুরজীবন। আহা কী ভয়ানক গল্প! কিংবা বিজনের রক্তমাংস!

আর উপন্যাসে সন্দীপন সীমাহীন আইডিয়া বা চাতুর্যের খেলাই খেলতে চেয়েছেন মনে করি। এমনকি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে উপন্যাসে বারবার ব্যবহার করেছেন কবিতা ও যৌনাচার। প্রেম আর নারী। আমার ব্যক্তিগত বোঝাপড়ায় গল্পে সন্দীপনকে মনে হয়েছে ঈশপের বাণীর মতো নিজের আকাঙ্ক্ষা প্রচার করছেন। আর উপন্যাসে মনে হয়েছে একগাদা আইডিয়া, কবিতানিঃসৃত নিজস্ব গদ্যভঙ্গি ও স্টোরিটেলিঙের চমৎকারিত্ব দিয়ে মাৎ করতে চাইছেন সবকিছু। আর এসব কারণে গল্প বা উপন্যাসের চেয়ে সন্দীপনের গদ্যকে আমার এক ভয়ানক পর্বতচূড়ার মতো মনে হয়। এই পর্বতচূড়া অকপট সন্ত্রাসী। দুঃসাহসী। দাম্ভিক। অভিজাত ও চিন্তাশীল।

আজ ৩১ শে জুলাই, ২০১৪, রোজ বৃহস্পতিবারে সন্দীপনের মতো আরেকটা লোককে আমি ভালোবেসেছিলাম মনে হচ্ছে। আর সেই লোকটির নাম নবারুণ ভট্টাচার্য। আজ লোকটি দেহত্যাগ করেছেন। যাচ্ছেন এক নীল কচ্ছপের দেশের দিকে।


এই নিবন্ধটা লাল জীপের ডায়েরী   পত্রিকায় পাব্লিশ হয় ২০১৪ অগাস্টে। নবারুণপ্রয়াণের অব্যবহিত পরেই জীপ  একটা স্পেশ্যাল ইশ্যু করে, সেইখানেই লেখাটার ফার্স্ট অ্যাপিয়্যারেন্স। গানপারে এইটা ছাপানোর আগে লেখকের যথাবিহীত সম্মতি সংগ্রহ করে নেয়া হয়েছে। — গানপার


… …

বিজয় আহমেদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you