মুহাম্মদ শাহজাহান : অগ্রন্থিত প্রস্থান

মুহাম্মদ শাহজাহান : অগ্রন্থিত প্রস্থান

শাহজাহানভাইরে আমি চিনতাম। তবে এই চিনাজানার রেইঞ্জ এতদূর নয় যে জীবনালেখ্য না হোক উনারে কেন্দ্র করে একটি স্মৃতিনিবন্ধ মুসাবিদা করা যায়। তাই বলে একটু স্মরণও করতে পারব না? কারো প্রয়াণের ইমিডিয়েইট পরে তার সম্পর্কে একটি জীবনতথ্যভিত্তিক রচনা প্রাথমিকভাবে যেমন প্রচারিত হতে দেখি প্রয়াতের ইয়ারদোস্তদের জবানে, এক্ষেত্রে তেমনকিসুই খিয়াল করেও গোচরে আসে নাই। কিন্তু আমি ঠিক করসি, যা হয় নাই তা নিয়া হায়হায় না করে উনারে এই নিবন্ধে একটুকুনি ইয়াদ করব শুধু।

পুরা নাম মুহাম্মদ শাহজাহান। উনার লেখাজোখায় এই নামটা হাজির ছিল। রচনালগ্ন মুহাম্মদ শাহজাহান নামটা ছাড়াও উনার সার্টিফিকেইটনাম অন্য হয়া থাকলে সেইটা আমার জানা নাই; যেমন আমি জানি না উনার জন্মসাল ও অন্যান্য ব্যক্তিক বৃত্তান্ত। অনুমান করতে পারি কিছুটা। তারপরও অপেক্ষা করসি কিসুদিন, জিগাইসি মিউচুয়্যাল দুইয়েকজনেরে, শাহজাহানভাইয়ের জন্মসাল এবং তার লাইফের ক্রনোলোজিক্যাল টাইমলাইনটা জানবার গরজে।

ফেসবুকহ্যান্ডেলে তেমন কিসুই বিছড়ায়া পাই নাই। কিন্তু, তা সত্ত্বেও, শাহজাহানভাইরে নিয়া আমি ট্রিবিউটগদ্যটি লিখতে চাই। কী যে লেখাঅন্তপ্রাণ একটা মানুষ ছিলেন মুহাম্মদ শাহজাহান, এইটা তার সংলগ্নজনেরা সাক্ষি দিবেন নিশ্চয়। লেখাজোখার পরিমাণ উনার খুব-যে বেশি, এমনও নয় মনে হয়। তারপরও লোক্যাল পত্রপত্রিকায়, দিবসকেন্দ্রী স্মরণিকায়, ছিটায়াছড়ায়া থাকতে পারে এমন অনেক লেখাজোখা যা হয়তো অনেকের/আমার অগোচরে থেকে গেসে।

গানপার-এর জন্যে লেখা চাইবার সুবাদে উনার সঙ্গে আমার সংযোগ তৈয়ার হয় আজ থেকে বছর-চাইর আগে। লেখা উনি দিসিলেন। পয়লা ‘শাহ আবদুল করিম ও তাঁর মদনমাঝির সুলুক সন্ধান’, পরে ‘মকদ্দস আলম উদাসী ও তাঁর গান’ এবং শেষে ‘বেদেমঙ্গল’ নামে একটা। তারপরে একাধিক লেখার প্ল্যানপরিকল্পনা করেও ময়দানে নামানো হয়া ওঠে নাই। প্যান্ডেমিক এসে যায় এবং ভরা মারীর সময়টায় ক্যান্সার ধরা পড়ে উনার শরীরে। ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট গ্রহণকল্পে উনি ইন্ডিয়ায় যাওয়ার সময়টায় সেলফোনে কথা হইসিলো আমাদের, হতভম্ব হয়া সাহসের সাপ্লাই দিতে যেয়ে দেখসিলাম উনি ভীত নন। শুধু ইন্ডিয়ার ওই চিকিৎসালয়ে অ্যাক্সেস করবার ইজি ওয়েআউট নিয়া আলাপ করতেসিলেন। অন্য কোনো অর্থানর্থ সহায়তা না।

শাহজাহানভাই ছিলেন সজ্জন, শুভবাদী, স্থিরধীর অথচ আমুদে মানুষ। কুল্লে ২ কি ৩ বার সশরীর সাক্ষাৎ হইসিলো আমাদের। শান্তিগঞ্জ বাজারে, উজানীগাউ মানুষ উৎসবে, সুনামগঞ্জে। শান্তিগঞ্জ বাজারের একটা ম্যানশনে উনার কম্পিউটারমুদ্রণের দোকান ছিল। যতবার আমি মিট করতে গেসি উনার সঙ্গে, অনাড়ম্বর দোকানটায় আড্ডা দিসি, টিব্যাগের চারপাশ থেকে ছড়ানো সুগন্ধা চা খাইসি, সন্ধ্যা থেকে রাইত এগারো অব্দি আড্ডা দিসি মনে পড়ে। যে-কয়টা সাক্ষাৎ হইসিলো মর্ত্যলোকে আমাদের, এর প্রত্যেকটায় এনামভাই তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক এনামুল কবির উপস্থিত ছিলেন। অভিন্নহৃদয়, হরিহরআত্মা … এই-রকম কিসু শব্দ আছে বাংলায়, শাহজাহানভাই-এনামভাই সম্পর্কটা কালেভদ্রে দেখে তেমনই লাগসে আমার কাছে। এমনিতে শাহজাহানভাই প্রিয় ছিলেন সর্বসাধারণ্যে, এইটা বাজারের টঙদোকানগুলায় বিড়ি কিনবার সময় হাল্কা টোকায় টের পাওয়া যেত।

গানপারে লিখসেন উনি ৩টা লেখা, আগের একটা প্যারাগ্র্যাফে লেখাত্রয়ের লিঙ্ক দিসি, আরও অনেক অনেক লেখার প্ল্যান নিয়া আলাপ করতেসিলেন লাস্টটাইম সাক্ষাতের সময়। এর মধ্যে একটার উল্লেখ আফসোস নিয়া আমি করতে চাইতেসি এই জায়গায়। ‘বেদেমঙ্গল’ লেখাটা গানপারে আপ করবার কিয়ৎকাল পরে একটা কাজে শান্তিগঞ্জ গেলে দেখা করি শাহজাহানভাইয়ের লগে। সেইসময় উনি বলতেসিলেন যে বেদেদেরে কেন্দ্র করে উনি লিখতে চান বড়সড় পরিসরে। এবং ভালো লাগে উনার মধ্যে এই কনফিডেন্স দেখতে পেয়ে যে বেদেসম্প্রদায়/বেদেপেশাজীবীদেরে নিয়া অ্যাভেইলেবল বইপত্রগুলা এই জনগোষ্ঠীর থোড়াই ক্যাপ্চার করতে পারসে। বেশিরভাগের বর্ণনা বানোয়াট, মুখস্থ, তথ্যখটখটা। শাহজাহানভাই বলতেসিলেন উনি নিজে সেই পিচ্চিবেলা থেকে দেখে দেখে বেড়ে উঠসেন গাঙপারে বেদেনাওয়ের বহর। এদের ভাষা, বাচিক ঢং, এদের লোকাচার কিসুই ঠিকঠাক ধরতে পারে নাই বাংলাবাজারে অ্যাভেইলেবল বইগুলা। শাহজাহানভাই বলতেসিলেন উনি নিজে লিখবেন, বড়সড় পরিসরেই লিখবেন, প্রস্তুতি নিতেসেন। ফলোআপ না-রাখলেও আন্দাজ করি উনার ইচ্ছাটা অপূর্ণই থেকে গেসে। এখন তো উনি এমন জায়গায় গেসেন যে একটু খবরান্তর করবার উপায়টা নাই।

কিন্তু প্রয়াণসংবাদ শ্রবণের পরপরই ইহলোকে রয়া যাওয়া আমাদের মধ্যে একটা দায়িত্ব বর্তায় প্রয়াতের আধুরা কাজগুলা নিয়া আলাপালোচনা করবার। দরকার মুহাম্মদ শাহজাহান রচনারাশি কম্পাইল করে একটা অ্যান্থোলোজি পাব্লিশ করবার। সম্ভব হলে মুহাম্মদ শাহজাহান স্মরণগ্রন্থ প্রকাশের আয়োজন করবার। উভয় কাজেই প্রয়াতের আযৌবন সহচরেরা আগুয়ান হবেন আশা করি।

অপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ করতে চাইতেসি যে এই নিবন্ধ মুসাবিদাকালে মুহাম্মদ শাহজাহান বাংলায় টাইপ করে একটু গ্যুগলসার্চ দিসলাম যদি কিসু জেনেরিক তথ্য, অন্তত প্রয়াতের মৃত্যুসংবাদ, খবরকাগজে পেয়ে যাব। মুঘলসম্রাট শাহজাহানের মৃত্যুদিন নিয়া আলেখ্য লভ্য হলেও অনলাইন গাদাগুচ্ছের পত্রিকামাস্তানির এই মুল্লুকে এমনকি সুনামগঞ্জী লোক্যালেও প্রয়াতের নামনিশানা পাই নাই। অথচ মৃত্যুর মাস-দুই পরে বেরোনো লাল শাহ সম্পাদিত ‘শান্তিগঞ্জ সুরসম্প্রীতি’ শীর্ষক সংকলনে একটা লেখা পড়লাম ‘সাম্প্রদায়িকতার সেকাল একাল’ নামে, যে-লেখাটা আগেই দিয়া রাখসিলেন উনি সংকলনকর্তা বাউল লাল শাহেরে, লেখক মুহাম্মদ শাহজাহান সবসময় লিখতে চাইসেন নামজাদা না-হয়েই।

টাইমআউট। জন্ম কবে তা জানতে/বলতে না-পারলেও, কোনো লোক্যাল পত্রিকা তা জানাতে/বাৎলাতে না-পারলেও, লেখক মুহাম্মদ শাহজাহান ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ইন্তেকাল করেন। পরলোকযাত্রায় তাঁর শান্তি কামনা করি।

জাহেদ আহমদ / মার্চ ২০২৩ 

COMMENTS

error: