সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার চরবাড়া গ্রামে বাংলা ১৩৫৪ সনে সুফিবাদী জ্ঞানে লোকায়ত ঘরানায় এই মাটির খাঁটি কবি মকদ্দস আলম উদাসী জন্মগ্রহণ করেন। মুর্শিদজ্ঞানের এই কবি ২০২২ সালের ১৪ জুলাই ইহলোক ত্যাগ করে মুর্শিদের কাছে ফিরে গেছেন।
উদাসী আত্মাকে পাখি জ্ঞান করতেন। দেহকে বলতেন ঘর, পাখির বাসা। মৃত্যু বিষয়ে আলাপে তিনি বলতেন, “মৃত্যু আর কী? ঘর পুরান হইয়া গেলে পাখি তো আবর্জনারে ফালাইয়া যাইব অউ।” আত্মা উড়ে যাওয়ার মুহূর্তে স্বজনেরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কষ্ট হচ্ছে? পানি খাইবা? তিনি উত্তর করলেন, “না, বাসা ভাঙ্গিলায় রে…বাসা ভাঙ্গিলায়!” বাসা ভেঙে একজন সাধকের পাখি বলে-কয়ে চলে গেলে। মাটির দেহ মাটিতেই মিশে গেল।
মাটির পৃথিবীতে তিনি প্রকৃত মাটির মানুষ ছিলেন। বেশভূষায় নয় ফকিরিটা ছিল তাঁর অন্তরে। ভাবের বাজারে সুরাসুরে তাঁর বিচরণ।
ফকির কে? শিরায় শিরায় যার পরমের বসবাস তিনিই ফকির। যিনি সব টানাপোড়নকে অতিক্রম করে পরমে বাঁচেন, গানে গানে যিনি পরমের তরে প্রেমের জিকির করেন। তাঁকে যখন সরকার থেকে জায়গাজমি এবং বাড়ি করে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো তখন তিনি বললেন —
: আমার তো বাড়িঘর জমিজমার দরকার নেই।
: আপনি তো ভাড়া বাড়িতে থাকেন?
: অসুবিধা কী? যার বাড়ি হে দেখব। আমি খালি থাকমু।
এইসব দান-দক্ষিণা ত্যাগ করে উপজেলা প্রশাসন থেকে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত পুত্রের জন্যে একটি হুইল চেয়ার নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “তারে বইতে বইতে আমার জান শেষ! হুইল চেয়ার জানটা বাঁচাইছে।” এমন মানুষ কী আর মিলবে! দুচোখে অশ্রু ও শান্তি নিয়ে পরমের পথে হেঁটেছেন। মৃত্যুকালে তিনি ছরকাত চেয়েছিলেন। জীবনের শেষ ইচ্ছা কী? — শেখ লুৎফরের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমি মুর্শিদরে কই, মরণকালে যেন আমার হুঁশ ঠিক থাকে। তখন যেন আমি কলিমাটা সঠিক করে পড়তাম পারি। ছরকাত হইত না।” ছরকাত তিনি পেয়েছিলেন। মৃত্যুর আগের দিন সারারাত না ঘুমিয়ে সুর ও কথায় স্বজনদের সঙ্গে মিশে ছিলেন। শেখ লুৎফরের কথায় জানতে পারি :
মৃত্যুর আগের দিন সারারাত তিনি ঘুমালেন না। চারপাশে অনেক নারী-পুরুষ তাঁকে ঘিরে বসে আছে। কথা চলছে। খালি গলায় নরম সুরে গান চলছে। সবই উদাসীভাইয়ের লেখা গান। গভীর রাতে তিনি নিজের লেখা গান চোখের জলে ভেসে ভেসে নিজেই গাইলেন :
১.
আমায় শান্তি তো দিলে না রে বন্ধু, পাইলাম না তোমার দেখা
তোমারও পিরিতির দাগ কলিজাতে আঁকা।…
২.
না করলে সাধন, হলো না ভজন, হইলে না তুই বন্ধুয়ারই দাস।
এক দমের নাই ভরসা, করো তুমি কার আশা…
দুই
সামনাসামনি বসে উদাসীর চক্ষু দেখিনি আমি। আসরের সুরলহরিতে বসে সাধনার আশ্রমে ঘুরে আসতে পারিনি। কবি মোস্তাক আহমাদ দীনের বিচরণজ্ঞান এবং কথাশিল্পী শেখ লুৎফরের সাক্ষাৎকারের বিভূতিতে উদাসীর সাধনাআশ্রমে অনেক ঘুরেছি, দেখেছি সাধকের ঘর ও মরমি বৃত্তান্ত। ঘাস প্রকাশন থেকে প্রকাশিত কবি মোহাম্মদ জায়েদ আলী সম্পাদিত ‘মকদ্দস আলম উদাসী স্মরণপুস্তক’-এ ২২ জন লেখকের লেখায় আরো বিস্তারিতভাবে উন্মোচিত হলো উদাসীর সাধনাবৃত্তান্ত।
কবিরাজ বাবার টানাটানির সংসারে তাঁর বেড়ে ওঠা। ভাটিবাংলার ভাবুকতা আর সুরমা নদীর মুক্ত প্রবাহের সুরই উদাসীর জ্ঞানের উৎস। শৈশব-কৈশোর জুড়ে মাটি ও জলের বিচিত্র প্রকৃতিতে বিকশিত হয়েছে তাঁর জ্ঞান ও ব্যাকুলতা। ফসলের মাঠের রঙ আর পাখপাখালির নৈসর্গিক মিতালিতে তাঁর সংগীতচর্চার সূত্রপাত। প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তাই তাঁকে সুরের পথে ধাবিত করেছে। তাঁর সাথে মিশেছে জগজ্জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা।
জিজ্ঞাসা ও মরমি জ্ঞানই তাঁর সংগীতের উৎসভূমি। সৈয়দ শাহনূর, রাধারমণ দত্ত, দীন ভবানন্দ প্রমুখ সাধক কবির ভাবপরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠার মধ্যেই ধাবমান গতিতে তৈরি হয় জিজ্ঞাসা। সুরের প্রতি প্রেম ও জিজ্ঞাসাতেই ভাবসংগীতের প্রতি অনুরাগ জন্ম নেয়। আত্মমগ্নতার এই পর্যায়ে সুনামগঞ্জের ছাতকের দুর্বিনটিলায় গিয়ে সাধক দুর্বিন শাহের গানের দলে যোগ দেন। দুর্বিন শাহের নিকট তিনি সুরের শিক্ষা গ্রহণ করেন। মকদ্দস আলম উদাসী বাউলের ঘর ও ঘরানায় দাঁড়িয়ে বলেন, “সংগীতের বড়ো বাউলগান, গাইলে বৃদ্ধি করে জ্ঞান / যার অপর নাম বিজ্ঞান — বুঝিয়ো জ্ঞানীর কাছে।” [বাষট্টি সংখ্যক গান : উদাসীসংগীত, পৃ. ৪৬]
.
তিন
সাধনগুরুর কাছেই শিখতে হয় বাউলগানের তত্ত্বতালাশ। প্রকৃত জ্ঞানমার্গের শিক্ষা বিজ্ঞজনের কাছেই উপলব্ধি। নিজেকে নিজেই চিনতে হয় আর স্রষ্টাকে চিনতে হলে উপায় খুঁজতে হয়। গুরু সে-উপায় বলে দেন। সহজসাধনা ও নিগূঢ়তত্ত্বের মাধ্যমে মুখ্য লাভ মোক্ষলাভের নিশানা পাওয়া যায়। এই লক্ষ্যে উদাসী সুফিসাধনায় দীক্ষা নেন। তিনি সুনামগঞ্জের বিখ্যাত সুফিসাধক সুকুর আলী চিশতির কাছে দীক্ষা নেন। উদাসীর এই মুর্শিদ সুকুর আলী চিশতির বাবা ছিলেন আরেক বিখ্যাত সুফিসাধক শাহ ছাবাল আলী। জানা যায়, শাহ ছাবাল আলী জন্মান্ধ ছিলেন। এঁরা প্রত্যেকেই গানের সাথে বসবাস করেছেন। লিখেছেন, গেয়েছেন। গুরুপরম্পরায় নিবেদিত হয়েছে পরমকে পাওয়ার ভাবসংগীত।
যারে যার একিনেতে, ওজন করো জ্ঞানীর মতে
ইনসানি রুহানিতে — রবে না কোনো সন্দয়॥
ফে কাফ ইয়া-রে, ভাববিশ্বাসে আসে যারে
এরপরে আপন ঘরে — হবে রে চন্দ্রের উদয়॥
পরিষ্কার করিলে ছাতি, জ্বলবে রে নূরের বাতি
সিরাতুল মুস্তাকিম পথি — মকদ্দসে ভেবে কয়॥
সুরের জননী যাকে ডাকে তাকে ঘর ছাড়তেই হয়। সৈয়দ শাহনূর, রাধারমণ দত্ত, দীন ভবানন্দ, জালাল উদ্দিন খাঁ, দুর্বিন শাহ-র গান ও ঘরানা তাঁকে ডাক দিয়েছিল। সেই ঘরানাতেই অবগাহন করেছেন তিনি। পৈতৃক ঘর রেখে ফকিরি ঘরের দিকে নেমে গেছেন। যে-ঘর রেখে গেছেন সে-ঘরে আর ফেরেননি। কীভাবে ফিরবেন! — পরমের সুরত খুঁজতে খুঁজতেই হয়রান তিনি।
রং ছুরত তার জানলে বলো
নীল সাদা না সবুজ কালো
জলপবন না আঁধার আলো
না দেখলে কি হয় সত্যতা॥
.
চার
ভোগী মানুষের পৃথিবীতে উদাসী একটা সুরের পৃথিবী রচনা করেছেন। বুকভরা অভিমান নিয়ে একদিন আত্মপথে, সুরের পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন। সুর তাঁকে বঞ্চিত করেনি; দেখিয়েছে পরমের পথ। গুরুই শিখিয়েছেন জ্ঞান। দেহতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, মুর্শিদজ্ঞানের শুভ্র তরিকায় সারাজীবন বিচরণ করেছেন। যা বুঝেছেন, অনুভব করেছেন — তা-ই লিখেছেন।
মকদ্দস আলম উদাসীর স্মরণপুস্তকে উদাসীকে পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যায়। স্মরণিকাতে লেখকবৃন্দ ভাবুক-দার্শনিক-ফকির-মরমি-সুফি ও মাটির কবি উদাসীকেই খুঁজেছেন। মোহাম্মদ সাদিক, আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, নন্দলাল শর্মা, ফকির ইলিয়াস, সাইমন জাকারিয়া, জফির সেতু, ফজলুররহমান বাবুল, মালেকুল হক, জাহেদ আহমদ, সুমনকুমার দাশ, এনামুল কবির, প্রণবেশ দাশ, সেজুল হোসেন, শামস শামীম, পারভেজ রশীদ মঙ্গল, ওয়াহিদ রোকন, মুহাম্মদ শাহজাহান, আলফ্রেড আমিন, মেকদাদ মেঘ, মোহাম্মদ জায়েদ আলী, মোস্তাক আহমাদ দীন, শেখ লুৎফর — লেখকক্রমের মাধ্যমে আমরা প্রেমিক-ধীমান-মরমিজ্ঞানের উদাসীকেই খুঁজে পাই।
উদাসী লিখেছিলেন, ‘মরিলে কলঙ্কের গান কে গাইবে দেশে দেশে’। তাঁর গানই তাঁর জ্ঞান; অন্তর-বাহির। গানের ভিতরে সংগুপ্ত আছে উদাসীর জীবন ও পরমের প্রতি জপমালা —
আমি যে প্রাণবন্ধুর পাগল
সে যদি ভিন্ন বাসে
মরিলে কলঙ্কের গান
কে গাইবে দেশে দেশে…
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপারে উদাসী
গানপার বইরিভিয়্যু
- ভাট কবিতার দিনলিপি || সরোজ মোস্তফা - June 1, 2025
- ফকিরের রত্নরাজি || সরোজ মোস্তফা - May 21, 2025
- মুস্তাফা জামান আব্বাসী : অবদান তাঁর অবিনাশী - May 14, 2025
COMMENTS