ট্রিবিউট টু উৎপল ও বঙ্গজ অন্যান্য তরুণকুমার

ট্রিবিউট টু উৎপল ও বঙ্গজ অন্যান্য তরুণকুমার

শেয়ার করুন:

‘ভোরবেলার রৌদ্রে বসে বাজার’ যেই দেশে, সে-দেশ হয়তো ‘অন্য দেশ, অন্য কোনো রাজার’, সেইখানে বয় ‘চিরদিনের নদী’ এবং ওড়ে মেঘবাহিতা ‘পাখি’, কিংবা কাকজ্যোৎস্নারাত্তিরের শেষে ‘ভোরবেলা গাভীর স্বননে’ জেগে-ওঠা মানুষ ও মোরগের যথাক্রমে গর্গল আর বাঙ, সেই দেশ রঙিন অথবা রঙহীন ধর্তব্য নয়, সেই দেশে ‘তোমার স্বর ধ্বনিজাল — প্রতিধ্বনিজাল — পাতায় শিশিরবিন্দু মুছে যায় — মুছে যায় পলাতক কিশোরের ভীরু কণ্ঠ, সমস্ত দুপুর ভরে শরবন ক্ষয়ে যায়’, এবং ‘আমার চেতনা শুধু শব্দের করস্পর্শে ভেঙে যায়’ যেই দেশে যেয়ে, সেখানে ‘নির্জন বালির বুকে পড়ে-থাকা নৌকাগুলি তোমাদের জানে’, এবং আমিও ‘তাদের ছায়ায় বসে’ গেয়ে গেছি বিরামহারা বাসনার গান ‘সারাদিন হৃদয়পণ্যের’, জন্মেছি ‘ময়ূর, বুঝি-বা কোনও সূর্যাস্তে’ ‘এবং মেঘের তলে উল্লাসে নতুন ডানাটিকে মেলে ধরে’ দেখেছি বিস্ময়ে বিপন্ন ‘নক্ষত্রে সাজানো ডানা’, আর ‘জেগেছি সন্ত্রাসে’ এইখানে ‘কেবল পাতার শব্দে আমি’ দীর্ণ মহাকাল ধরে, ‘ভেবেছি সমস্ত দিন এত লেখা এত প্রশ্ন, এ-কথন’, ‘অর্জুনগাছের মতো সমুদ্রছায়ায় বসে’ থেকে দেখেছি বিলীন দিগন্তদৃশ্যের নৈরব্যমুখর নৃত্য, ‘বহু সিগারেট-টিন নিয়ে উড়োপাতা, বালি, ছেঁড়া খবরকাগজ সমেত তোমাদের হৃদয়বত্তা নেড়ে’ দেখে গেছি দিনমান, ‘চতুর্দিকে গরাদের স্তব্ধ ছায়া’ আর তারপরও ‘তোমার মুখ চামচের মতন উজ্জ্বল’ প্রতিভাত হয়েছে এখানে চিরকাল, সমাপতনযোগে মনে পড়ে যায় চোখের সঙ্গে চামচের উপমায় দেখা আবুল হাসানের কবিতা, ‘জানু তুমি! তুমিই জানালা!’ — আমি চিৎকারচুপকথার আড়াল নিয়ে গেছি বিড়বিড়িয়ে একাগ্র, ‘দূরবীক্ষণ তুমি, চেয়ে আছ ঝঞ্ঝার মেঘে, ঐ নীলিমাবিথারে — সমস্ত সন্ধ্যা ভরে লুব্ধকের পিছু পিছু আরও বহু তারা — বনকুকুরের সারি জঙ্গলের মর্মে ছুটে চলে — সমস্ত সন্ধ্যা ভরে লুব্ধকের পিছু পিছু দেখা যায় সমুদ্রমন্দির’, জনান্তিকে সে এসে ‘এ-সব সমুদ্রতীর বারবার ব্যবহৃত হয়ে গেছে, লক্ষ করো’ বলে চেতনা জাগায়ে ফের চলে গেছে টুপ করে ঘুমে ডুবে, গেছে তেরোশত মহাদেশ উজিয়ে বেভুল বিদেশে, এবং আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখেছি বিভিন্ন দশক জুড়ে তরুণের স্তোত্রপত্রে কেবল তাঁরই ব্যবহৃত সমুদ্রতীর, সমুদ্রমন্দির, সমুদ্রকপাট, সমুদ্রবাতাস ইত্যাদি দৃশ্যকল্প ও শব্দচিত্রের হুবহু অনুকৃতি, তথা সূর্যাস্তমন্দির, বেদনামন্দির, বিষাদমন্দির প্রভৃতি বিপর্যয়কর উৎপলীয় গতের অনুগত শব্দজোড়াতালি, ঈশ্বর তথা উৎপলের জবানোক্ত ‘উদরাময়’ এই ভীষণ গড্ডালিকা-কাব্যাচার নিয়া বারামখানা-মাতানো কবিদিগেরে যেন সস্নেহ প্রশ্রয় দিয়া যান — নমাজান্তে এ-ই ত্রিভুবনের মুমিনের পাঁচবেলা প্রার্থনা, ‘হে ঈশ্বর, হে উদরাময়’ — তা, কে এই বিপুল নকলনবিশির ভিড়ে হেন সন্তধ্যানস্থ কবিটা? আমরা তার সৎকার করে যেতেই থাকব কী, নিছক মহাত্মনের কবিতা আমাদেরই নিজেদের নামে চালাইয়া? আঙুরক্ষেত, যব, তিসি, উট, ঘোড়া, মার্জারী, হেমন্ত ও ‘রণক্লান্ত মহাদেশ’, সোডাবোতল, কৃষিখামার আর চাঁদ, ‘সশব্দ প্রস্থান’ শুধু গ্রন্থে-গ্রন্থে বাছাদিগের ছাগনিরীহ ও ‘তৃণবেহালার মতো’, উৎপলকল্পনার সঙ্গে ‘জেলঘুঘু’ আর ‘নভছক’ আর ‘নৌচালনার ম্যাপ’ ও ‘কম্পাসকাঁটার খল নির্ভরতা’ আর অজস্র উল্লম্ফনসদৃশ আপাত-উদ্ভট প্রতিকল্পনাস্থাপনের পেছনে তার পূর্বপুরুষনির্দেশিত ‘পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান’ আর ‘ইতিহাসজ্ঞান’ জিনিশগুলোর রয়েছে টনটনে নাড়ির যোগ। তুমি, হে তরুণ কবি, ভঙ্গি দিয়াই বিশ্ব মারিছ মুখে এবং মরুমরিচীকার ন্যায় কিছু প্ররোচনামাখানো শব্দফাঁদের মাধ্যমে। এইসব তোমার চারপাশের খরগোশ ও কাকাতুয়া বন্ধুরা জানে, কেউ ধরায়ে দেবে না তোমারে ফ্যালাসির এই বৃথানুশীলন, পণ্ডশ্রম আর এই পাঁঠার অনুকারকৃত্য, সক্কলে সমস্বরে কেবল বাহবা দিয়া যাবে। আর তুমি বিস্ময়কর উৎপলস্বরে চেল্লায়া যাবা শুধু — ‘শোনো, কৃষিসমবায়ে আমার অনেক কথা বলবার ছিল — মৌ-প্রজনন নিয়ে পরীক্ষামূলক বাকশো আজ সকালেই আমি খুলে দিয়েছি মাঠের উত্তাল বায়ুর দিকে’ … এইসব উৎপলের পেশাজৈবনিক বাস্তবতা। তা, কারো কারো মনে নিশ্চয় পড়বে যে একদা বাংলাদেশে বেড়াতে এসে কবি গিয়েছিলেন বক্সীগঞ্জে, দেখেছিলেন মৌমাছিকৃষকের শিল্পখামার, ঘুরেছিলেন মৌমাছিগ্রাম, ফিরে যেয়ে লিখেছিলেন কবিতা ধারাবাহিক, হয়েছিল ‘বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে’ শীর্ষক পাণ্ডুলিপি। কিন্তু সকলেই নয়, কেউ কেউ বুঝতে পেরেছিল বক্সীগঞ্জফেরত কবির কাজবাজ দেখে, দেখা থেকে লেখার সময় লেখক কীভাবে একেকটা ব্যাপার নেন এবং নেন না, পাল্টে দেন কতটা বা রাখেন কতটা, আরশোলা-ব্যাঙ-মৌমাছি ইত্যাদি, ইতলবিতল ব্লা ব্লা। আরও অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য এ-ই যে, উৎপলের গদ্যসম্ভার থেকেও উনার কবিতাকৌশল সম্পর্কে যে-যার মতো করে একটা আন্দাজ করে নিতে পারি আমরা, তাঁর কবিতাকায়দা খানিকটা আন্দাজ করে নেয়া যায় স্কেচধর্মী অটোবায়োগ্র্যাফিক্ ছোট ছোট উইটি নিবন্ধগুলো পড়ে। এই তরিকায় যে-কোনো কবিরই কবিতা ডিকোড করার একাধিক রোডম্যাপ্ পেয়ে যাওয়া যায়। স্রেফ শব্দজব্দ নয় এইসব, শুধু জগৎ নির্মাণের গাজোয়ারি কাব্যিপনা নয়, কিংবা খামাখা নতুনের কেতন উড়াইয়া দেখাইবার বালখিল্য শৌখিনতাও নয় এসব উৎপলপঙক্তি নির্মাণকলা। আমি আর তুমি যেমন ভাবি এইসব স্রেফ শব্দের অবকল্পনা, তা না, আমরা আজও বিভ্রাটেই নিপতিত বহিয়া আমাদের বানান ও অন্যান্য বোঝা। আমাদের বেফায়দা ভাষাবারফট্টাই, বিলকুল বুজরুকি চিত্রকল্পোচ্ছলতা, আমাদের উৎরোল কল্লোলে বেদনানন্দগ্রন্থনা। আমরা কী উৎপলপ্রণালি বলতে কেবল বুঝব উৎকেন্দ্রিকতা? আদৌ উৎপলপ্রণালির গোপন রহস্যরেসেপি তিনি নিজের জবানে টায়ে টায়ে বলে যান নাই নিশ্চয়, কিন্তু একেবারেই কি বলেন নাই? বিভিন্ন কবিতায়, কবিতাবইয়ের ভূমিকায় কিংবা লাস্ট কাভারের জ্যাকেটে, ফ্ল্যাপকথনে বা ব্লার্বগ্রথনে উনি নিজের বাক্যে বেশকিছু সম্ভাব্য প্রণালির চাবিকাঠি দিয়ে গেছেন বৈকি। কিংবা ‘ধূসর আতাগাছ’, ‘সদা ভ্রাম্যমাণ’ অথবা তাঁর ‘গদ্যসংগ্রহ’ সংকলনে সেসবের খোঁজ মেলে এলোমেলো উড়ো-খড়ো ধূসরাভা পাতায়। তা, আজ আর নাই তিনি, নিজের মৌমাছিবিদ্যার তিনদশকপ্রভাববিস্তারী কাণ্ড দেখে মুচকি হেসে তরুণ স্তোত্রলিখিয়েদেরে অধিক হারে স্তোত্রবই রিলিজের বরাভয় দিয়া তিনি নিয়াছেন বিদায়, কিংবা ‘জরিপ’ করতে বেরিয়েছেন ‘অলাবুভক্ষণ’ নামের আজব দেশটা। তা, ‘আরেকটু সময়’ দেয়া যাইত না তারে? এই ধরো, খুব বেশি না, সে যেমনটে চেয়েছিল ওই ‘আর কয়েক মিনিট’? সমুদ্রে একটাবার নামতে চেয়েছিল, কতই তো হুটোপুটি করেছে সে এই বিকেলের দেবদারুনত সৈকতের ঝড়ে-ছেঁড়া ছাতাটার তলে, পেরেছিল পাৎলুন গুটায়ে নিয়ে শেষবারের মতো নামতে ফেনাপানিতে? এবং তখন তার তো কোনো ‘দায় নেই’ বলেই নিয়েছিল, ‘শুধু লেখার খাতাটি নিয়ে সমুদ্র ও বনের দিকে চলে যাওয়া ছাড়া’, তার ‘ঢেউ গোনা ছাড়া কোনো দরকারী কাজ নেই’ ডিক্লেয়ার করেছিল, বলেছিল ‘নির্জনতা আছে’, যেইটা আমাদের নাই, ছিল না, থাকবে না আমাদের হয়তো-বা, আগামী তিনটি ডিকেড অথবা চারটে সেঞ্চুরি হয়তো কবিতাপাণ্ডা আর কোবিদগুণ্ডার চ-বর্গজ ধ্বনির চোপাচালনায় চেপ্টে থাকব আমরা। আর নির্জনতার কোনো ঋতু হয়তো হবে না পাওয়া আমাদের বাদবাকি জিন্দেগিতে। সে ‘এই সৈকত মাপবার যন্ত্রখানি — এই খাতা — এই বোঝাপড়া’ নিয়াই কিন্তু সময়টা কাটিয়েছে। ফেসবুকে ফ্রেন্ডলিস্টে ছিল না তা-ও মহাকালের মাসাতো-ভাই এই আমি তারে নিয়া আরআইপি লিখতে চাইছি, কিন্তু পারছি না তা আলাদা কথা, দিকে দিকে দ্যাখো ‘ওড়ে হাল্কা মেঘের দিন, যেন প্রেম, যেন খতিয়ান’। তা, বাদ দাও, অন্য কথা বলো। ‘ভোরবেলাকার গানে কে আর জাগবে’, এখন, ‘বলো’? ‘কোথায় যাওয়ার কথা’ তা-সবই লিখে রেখেছে সে এবড়োখেবড়ো অক্ষরে, এহ বাহ্য, ‘বেলা পড়ে’ এসেছে দেখি ‘বিদায়বেলার রোদে’। এরপরও ‘কত কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেল’, শুনতে চেয়েছিল ‘শূদ্রের গান’, ‘পশুচারণের গীত’, বলেছিল — ‘কি হবে আমার গানে — এই বধিরের গানে, এই বোকা আমিত্বের গানে’, এইসব, থেকে-থেকে, মনে পড়ে। এবং ‘পরিত্যক্ত হয়ে থাকি’, বিবরণবহির মতো, ‘যতদূর সম্ভব’। বসন্তে, কোনো-এক, কত কত গণনাতীতকাল আগে, এনেছিল সে এক তাজ্জুব-করা ‘হাবা যুবকের হাসি’, প্রিটি স্টাউট অ্যান্ড স্ট্রং সেই ইয়াংম্যান, বৃদ্ধের প্রজ্ঞা আর তরুণের অতলান্ত রতি ছিল যুবকের হাবা ভাষাহাসির স্বভাবলব্ধ, ‘হস্তচালিত প্রাণ তাঁত’ আর তার ‘সেই আধোজাগ্রত মেশিনলুম’, ‘উচাটন উট’, ‘তানপ্রধান রেডিও’, ‘তাঁতকল’, ‘জন্মদিনে রিবনেবাঁধা রবীন্দ্রনাথ’, ‘ছিল ভালোবাসা’, ‘গ্রামোফোন’, ‘সেলাইমেশিন’, ‘কম্পাসের খল নির্ভরতা’, আরও অধিকন্তু ‘অনিশ্চিত রেলডাক’ আর ছিল ‘মেঘের গর্জন’, ঝোলাব্যাগে, ক্যাপের ভিতর মাথাবর্তী, এইসব উপাদান তার, আমাদের সময়ের অপূর্ব রৌশন অপেরাধিকারিক সেই ভিনগ্রহাগতা সার্কাসমাস্টার। কত কত অগণিত তরুণ শাগির্দ তাঁর! উস্তাদের কমন কিছু শব্দ চেটে চেটে ইয়াংস্টার পোয়েটদের কত কত মহামায়ামোহগ্রস্ত উড়োকাগজযান আর ছিপনৌকার মতো বই! কী তীব্র ‘উনিশশো বাষট্টি’, কী তীব্র ‘ফুল তাই গন্ধে আজ আমাদের সতর্ক করেছে’! ‘এবার শীতের বনে অপরাহ্ন দ্রুত পড়ে এল’, দ্যাখো, ‘অপরাহ্ন চলে যায় দ্রুত’, অনন্ত-অনাদিকালের এই রিয়্যালিটি শো। ‘তোমার ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি’ আর সেই চটিভরা ‘ঘাসের জঙ্গল’, খবরে প্রকাশ, চটিজোড়া ‘হারিয়েছ বাদামপাহাড়ে’, ‘ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা আমি হারিয়েছি’ ইন্ দ্যাট সেইম্ প্লেইস্, য়্যু ন্য। মনে পড়ে সেই-যে এক চিরুনি পেয়েছিনু, ‘নতুন চিরুনি’, ভুলি নাই কভু ভুলি নাই তার ‘দাঁতে এক স্ত্রীলোকের দীর্ঘ কালো চুল লেগে আছে’, এই ফাঁকে ভেবে রাখি আমি, লিখে রাখি সেই বিমনা ভাবনাও — ‘সম্ভবত আর বছর কুড়ি কি বাইশ টিকে যাব তোমাদের এই চমৎকার আতিথ্যময় পৃথিবীতে’, ভেবে ভেবে এই বিবৃতিতেও অনিচ্ছায় সায় না-দিয়া পারি না — ‘আমি স্তব্ধতাকে ভালোবাসতে শিখব আরো বেশি কথা বলে’, এবং হ্যাঁ, দিনাবসানে ‘গভীর উদ্বেগ নিয়ে শুয়ে’ পড়ব বিছানায়, ‘সাতখানি ঘুম’ আমাকে ‘গভীর উদ্বেগ থেকে ভয়াবহ সুষুপ্তির দিকে’ টেনে নিয়ে যাবে। এবং মনে হয় ঠিক তখনই রিয়্যালাইজ্ করতে পারব ‘সত্য-মিথ্যার যমজজন্মের আগে গান ছিল’ কথাটায় কতটুকু সোনাপান্নাপাকিজা লুকানো। ‘হল্কার কাছাকাছি’ গিয়ে, অবশ্য পৌঁছাতে পারলে তবেই, দেখব ‘বাঁশপাতা’ আমার আগে যেয়ে বসে আছে, আগুপিছু সমস্যা আমার নাই, ছিল না কোনোদিন, সংগোপন ও সরল স্বীকারোক্তি এ-ই, ধর্মাবতার! তখন নিরালায় দেখব ভোরের আলোটা ‘হাসান-উজ্জ্বল’ না ‘হুসেন-হত লাল’, তখনও কী হাতে থাকবে আমার আজিকার ন্যায় সভ্যতাপ্রাহরিক ‘মানুষ মারার ফাল’? না, ভুবনব্যাপী শিশুখাদ্যে অবরোধ দেয়া, আমি যেন তখন ‘রক্তমাখা জামায়’ প্রেতের মতন ভূতলোত্থিত সটান সড়কে থামাই ‘দুধের ট্রাক’। তারপর যদি সময় থাকে বেঁচে কিছু, সময়মতো, ফুলডুঙরি পাহাড়ের কথা যাবে না-হয় ভাবা। ‘শ্বাসকষ্ট উঠলেই বুঝতে পারি ফুলডুঙরি পাহাড় আর বেশি দূরে নয়’, এতক্ষণে ফুলডুঙরি পাহাড়টাতে পৌঁছে গেছ তো প্রায়, চেপারামের ঘরটা আবছা ওই তো দেখা যায়। হ্যাঁ, একেবারে পাহাড়ের মাথায়, সানুদেশে, এইবার ‘শান্তি বেগম’ চুড়িহাতে একগুচ্ছ কবুতর ও কবিতা ওড়ায়। আর হাঁপাতে হচ্ছে না, দ্যাখো, পুরানা হাঁপানির টানটাও উধাও, ওষুধের দরকার চুকেবুকেছে যেন। ‘আশ্চর্য! আবার ভুল হল’, বিকজ্, ‘বস্তুত, বনের মধ্যে, নির্বাসনে, কাঠের বাড়িতে সমসাময়িক বলে কিছু নেই —’

পোস্টস্ক্রিপ্ট

উৎপলকুমার বসু প্রয়াণের অব্যবহিত পরে এই নিবন্ধটি লিখিত ও উত্তোলিত হয়েছিল বর্তমান নিবন্ধকারের ফেসবুকনোটে। একটানে একটামাত্র অনুচ্ছেদে। এরপরে এইটা ছাপা হয় হোসেন দেলোয়ার সম্পাদিত ‘কবিতাপত্র’ ছোটকাগজে এবং আল ইমরান সিদ্দিকী ও হিজল জোবায়ের  সম্পাদিত ‘নকটার্ন’ ওয়েবম্যাগে। এই নিবন্ধে এন্তার শব্দ, শব্দাংশ, পঙক্তিচূর্ণ কোট-আনকোট ব্যবহৃত হয়েছে যা প্রায় সর্বাংশ উৎপলকুমার বসুর কবিতাবাহিত, বা, উৎপলের কবিতা থেকে আহৃত। অতদিন খেয়াল করি নাই, মৃত্যুর পরে খেয়াল করেছি এমন গুটিকয় কবিজীবন-রিলেটেড কনফিউজিং তথ্য নিয়া দুইটা মামুলি খটকা না-প্রকাশিলেও চলে অবশ্য। প্রথমত জন্মসাল। ১৯৩৯? না ১৯৩৭? উনার কবিতাবইগুলো তো বেশিরভাগ চটি কলেবর, একফর্মা-দুইফর্মা, সেগুলোতে কবিতথ্য সাঁটা নাই। কিন্তু উনার বড় কলেবর সংকলনগুলোর মধ্যে যেমন ‘স্বনির্বাচিত কবিতা’ (মডেল পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, ১৯৯৮), ‘গদ্যসংগ্রহ ১’ (নান্দীমুখ সংসদ, কলকাতা, ২০০৫), ‘সুখ-দুঃখের সাথী’ (সপ্তর্ষি, কলকাতা, ২০০৬) ইত্যাদি কিতাবে লেখা আছে জন্মসাল ১৯৩৭। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ এবং ‘কবিতাসংগ্রহ’ প্রভৃতিও, অনুমান, ১৯৩৭ নির্দেশ করছে। ডেইট অবশ্য, জন্মডেইট, কবি জীবদ্দশায়-ছাপানো বইগুলোতে ব্যবহার করেছেন বলে দেখি নাই। কিন্তু জন্মসালটা তার অভিপ্রেত ১৯৩৭ মনে করব কি না, ভাবা যাবে এক-সময় একটু খোঁজখবরান্তর নিয়া। তা, এইসব তথ্যহেরফের অত দুশ্চিন্তাকর কিছুও তো নয় নিশ্চয়।  কিন্তু উৎপলপ্রয়াণের পরে ফেসবুকে-ওয়েবপোর্টালে-ব্লগগুলায় সাঁইত্রিশ আর উনচল্লিশ এই দুই সালের আনাগোনা লক্ষ করা গেল। কবি ইন্তেকাল করেছেন ২০১৫ অক্টোবরে। এরই মধ্যে আধযুগ অতীত। উইকিপিডিয়া দেখি দ্বিধা কাটাতে পারে নাই এখনও। কবির উপর উইকি-ওভার্ভিয়্যু ইংরেজি ভার্শনে দেখি পয়লা লাইনে উনচল্লিশ আর তার পরপরই ঠিক দোসরা লাইনে সাঁইত্রিশ। যদিও বাংলা ভার্শনে কেবল উনচল্লিশ লক্ষ করব। বঙ্গজন্মা সাহিত্যিক-প্রাতিস্বিক সারস্বত ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে এহেন ঘটনা, বার্থইয়ারের এবং জন্মতারিখের এহেন দ্বৈত্ব, হামেশা দৃষ্ট। দুনিয়ায়-আখেরে ওই ডিজিট্যালাইজেশনের আগে, ওই অতীতকালে, একটু ডাঙর হবার পরেই সন্তানাদি ইশকুলে দেয়া হতো। হলেও, স্কুল-অ্যাডমিশনের সময় দেড়-দুই বা তারচেয়েও অধিক বছর দরকারমতো বয়স কমায়া নথিবদ্ধ করাটাই ছিল দস্তুর। রুজিরোজগার-চায়চাকরিতে একটু সময়জনিত সুবিধা পাওয়া যেত। ফলে, প্রকৃত জন্মসাল আর সার্টিফায়েড জন্মসাল দুইটা ব্যাপার বঙ্গজন্মা সাহিত্যিকদের কমন অদৃষ্ট। তবে ব্যক্তির মৃত্যু-পরবর্তীকালে এহেন তথ্যদ্বৈত্ব সম্পর্কে একটা ফায়সালা সারতে হয় উত্তরসুরীদের। উৎপল যেহেতু জীবদ্দশায় সাঁইত্রিশ ব্যবহার করেছেন একাধিক বইয়ের পরিচয়লিপিকায়, এ-ব্যাপারে কবির অভিপ্রায় কাজেই ক্লিয়ার। তবু আমাদের দেশের ও ভাষার কাজিরা গোয়ালের খবরে তেমনটা আস্থা রাখতে পারেন না, রাখেন যতটা খাতায়পত্রে তথা সার্টিফিকেটে।

জাহেদ আহমদ  *রচনাকাল ২০১৫ অক্টোবর গানপারপ্রকাশ ২০২৫ অগাস্ট


উৎপলকুমার ও সন্ধেবেলার শ্রাবণঝরা বাজার
গানপারে উৎপলকুমার বসু

জাহেদ আহমদ
Latest posts by জাহেদ আহমদ (see all)
শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you