প্রাচীনকালে গ্রিকদের স্ত্রীসৌন্দর্য নিয়ে বিশেষ চিন্তাভাবনা ছিল না।
তাদের চিন্তার জগৎ জুড়ে ছিল পুরুষ দেবতা অ্যাপোলো। আদর্শ সৌন্দর্য। দিনের আলোর মতো ঝকঝকে। অ্যাপোলো শুধু চোখের দেখায় সুন্দর নন। তিনি মেধা। তিনি বুদ্ধির দীপ্তি। তিনি নির্ভুল।
এই পুরুষ দেবতাকে সরিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে এক নারীমূর্তি স্থান নিচ্ছে, দেখা গেল। এই নারীমূর্তির কোথা থেকে উদ্ভব হলো বলা কঠিন। সম্ভবত তিনি কোনো প্যাগান দেবী। বর্বর এবং অসভ্য এই ভিনাস।
প্লেটোর ডায়ালগে, পিন্ডারের কবিতায় বলা হয়েছে দুই যুবকের মধ্যে প্রেম ও বন্ধুত্বই সবচেয়ে মহান ও স্বাভাবিক। যুবক ও যুবতীর সম্পর্ক তত মহান নয়। সেই পুরুষরাজত্বে — স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে, পটচিত্রে — নবদেবতা অ্যাপোলোকে পরাস্ত করে সিংহাসনের অধিকার নিলেন ভিনাস।
.
পূর্ণ এক রমণীর মূর্তি তৈরি করা সহজ নয়। দেহ নিটোল এবং ছন্দময়। কিন্তু নিম্নাঙ্গ দুটিমাত্র থামের মতো। পায়ের উপর ঐ শরীর বা টর্সো কিভাবে দাঁড়াবে? মাইলোর ভিনাসমূর্তি দেখুন। পায়ের দিকটা কাপড়ে ঢেকে দিয়ে সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়েছে বটে।
অ্যান্টিক গ্রিসের এই শেষ ভিনাস মূর্তি। যিশু খ্রিস্টের সমসাময়িক।
আজও আমাদের কাছে চিরন্তন সৌন্দর্যের দেবী এই নারীমূর্তি। পেন্সিল থেকে আরম্ভ করে প্রসাধনদ্রব্য ও মোটরগাড়ি অব্দি, মানুষের সৃষ্ট হাজার জিনিসে ওই ভিনাস আজও পার্ফেকশনের প্রতীক।
প্রায় দেড় হাজার বছর পরের কথা। ফ্লোরেন্সের সামন্ত রাজা, সান্দ্রো বতিচেল্লিকে একটি কবিতার অনুকরণে সমুদ্র-থেকে-উঠে-আসা এক দেবীর ছবি আঁকতে বললেন। আবার যেন ভিনাস নতুনভাবে আবিষ্কৃত হলেন। আদি রেনেসাঁর ভিনাস। ঝিনুক-ভেঙে-উঠে-আসা চিরকিশোরী। তন্বী। চুলের দৈর্ঘ্য দেখবার মতো। মুখ সরল ও দৃষ্টি উদাসীন। কিন্তু সমুদ্র থেকে উঠে আসছে এক নারীমূর্তি বা আকাশ থেকে নেমে আসছে এক রূপবতী মহিলা। এ কী অস্বাভাবিক, অপ্রাকৃতিক ঘটনা নয়? ওসব ক্ল্যাসিক্যাল যুগের কথা। প্লেটোনিক চিন্তা।
শুরু হয়েছে তখন হাই রেনেসাঁর যুগ। ল্যান্ডস্কেপে, বনজঙ্গলের পটভূমিতে, অভিজাত সামন্ত রাজাদের শয়নকক্ষে তখন মানবী ভিনাসের দৈহিক উপস্থিতি। প্রসাধনরতা ভিনাস, সংগীতমুগ্ধা ভিনাস, শিশুসমাবৃতা ভিনাস, এমনকি পারিবারিক ভিনাস — রাফায়েল, বেলিনি, জিয়োর্জিয়ন, টিশিয়্যান — তারপর রুবেন্স, ওয়াতো, ইনগ্রে, রেনোয়া একে একে শিল্পীরা হরণ করে নিলেন ভিনাসের সেই স্বর্গীয় অপাপবিদ্ধ সৌন্দর্য।
চারশ বছর ধরে লুণ্ঠিত হলো ভিনাসের নগ্ন ও অলৌকিক যা-কিছু আবেদন।
ভিনাস প্রসঙ্গে লর্ড বায়রন একদা লিখেছিলেন :
বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি, ফিরাই নিজের মুখ
জানি না কাদের দিকে, কোন দিকে — কেননা আমার
রূপান্ধ দুই চোখ — ভাসে সৌন্দর্যপ্লাবনে —
আমরা বন্দীসম — স্তম্ভিত, বাকহীন।
স্থির মার্বেলের গান শুনি — বাচাল পণ্ডিতও নীরব হয়।
আজ শুধু দেখা — শুধু আমাদের চোখ ভরে দেখা।
চাষাড়ে কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ অবশ্য, কথিত আছে, উফিৎজি গ্যালারিতে ভিনাস মূর্তির দিকে পিছু ফিরে বেঞ্চিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
গানপারটীকা : লেখকের ‘গদ্যসংগ্রহ ১’ থেকে এই নিবন্ধ সংগ্রহ ও সংগ্রথন করা হয়েছে। এইটা ‘নান্দীমুখ সংসদ’ কর্তৃক প্রকাশিত। বই প্রকাশের সাল ২০০৫। কলকাতা থেকে।
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS