তুরস্কের কবি ইউনুস ইমরে (১২৪০-১৩২১) প্রাচ্যের সর্বত্র পরিচিত মূলত সুফি দরবেশ হিসাবে। আনাতোলিয়ার লোককাহিনির প্রকরণে রচিত তাঁর কাব্যসম্ভারকে তুর্কি সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। আনাতোলিয়া অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রাম তাঁর জন্মস্থানের দাবিদার। ঠিক তেমনিভাবে নানা জায়গায় তাঁর সমাধির অবস্থান সম্পর্কে লোককাহিনি প্রচলিত আছে, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে তিনি ঠিক কোথায় সমাহিত হয়েছিলেন — সে-সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তাঁর রচনা নিয়ে চর্চা করেন এ-রকম বোদ্ধাদের ধারণা, তিনি ছিলেন আনাতোলিয়ার কারামান এলাকার বাসিন্দা।
ইউনুস ইমরের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে — ব্যক্তিগত মরমিবাদ, তীব্র মানবতাবোধ এবং স্রষ্টার প্রতি অশেষ ভালোবাসা।
ধারণা করা হয় যে — তিনি ছিলেন কবি জালালউদ্দীন রুমির সমসাময়িক, যিনি আফগানিস্তান ছেড়ে এক-সময় আনাতোলিয়ার কারামান অঞ্চলের বাসিন্দা হয়েছিলেন। তাঁদের দেখাসাক্ষাৎহয়েছিল বলেও লোককাহিনি প্রচলিত আছে। একই দর্শনের অনুসারী ও একই যুগে বসবাস করলেও তাদের কাব্যভাষা এবং প্রকাশভঙ্গিতে তফাৎ প্রচুর। বলা হয় যে — রুমির অসামান্য মসনবির উদ্দীষ্ট পাঠক ছিলেন উচ্চশিক্ষায় পরিশীলিত সুফিসমাজ। অন্যদিকে, ভ্রাম্যমান দরবেশ ইউনুস ইমরে রচনা করেছেন সরল লোকভাষায় তাঁর কবিতা, মূলত স্বল্পশিক্ষিত গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য।
এখানে কবি ইউনুস ইমরের পাঁচটি কবিতার ভাবানুবাদ উপস্থাপন করা হচ্ছে। কবিতাগুলো তুর্কি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন কবির হেলমিনস্কি ও রাফিক আলগান। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে কবিতাগুলো অনুবাদের জন্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
বধিরকে শুনতে দাও ভিন্ন বধিরের বচন
শ্রবণেন্দ্রিয় বিকল হওয়া মানুষের কাছে এসে কথা শুনছে বধির
দু-ভাবে অবগত হওয়া সম্পর্কে ওকিবহাল হওয়া আত্মার প্রয়োজন,
না শুনেও আমরা বুঝতে পারি বিষয়আশয় — হতে পারি ভাবে মদির
বুঝতে না পেরেও চলতে পারি পথ — খুঁজে নিতে পারি সুহৃদ স্বজন।
এ সরণীতে খুঁজে ফেরা মানুষের দরিদ্রতা হচ্ছে সম্পদ
ভালোবাসি আমরা — পরিণামে হই খাঁটি প্রেমিক,
নিমজ্জিত হই ভালোবাসায় — তাতে সমৃদ্ধ হয় প্রেমাষ্পদ
যখন প্রতিটি বস্তুনিচয় অবক্ষয়ে ধূলিস্যাৎ হয় নানাদিকে।
অপচয়ে ক্লান্ত হওয়ার সময় কোথায়
সৃজিত হয়েছে বাহাত্তরটি ভাষা — হরেক কিসিমের মনন,
তারপরে গড়ে উঠল সীমান্ত
দরিদ্র ইউনুস তামাম আকাশ ও পৃথিবী ব্যাপে খুঁজে বেড়ায়,
প্রতিটি পাথরের নিচে লুকানো পয়গাম্বর একজন
পায় না খুঁজে সে এ-রহস্যের আদিঅন্ত।
প্রত্যাবর্তনের অভিপ্রায়ে এসেছি এখানে
ঘরবাড়ি বসতি গেড়ে থিতু হতে নয়
এসেছি এখানে প্রত্যাবর্তনের অভিপ্রায়ে,
বণিক আমি — হরেক রকমের পশরা নিয়ে ভাসছি নায়ে
যে খরিদ করতে চায় আমার পণ্য — দিচ্ছি তাকে,
সমস্যা সৃষ্টি করতে আসিনি আমি
পড়তে চাই না ক্লেদাক্ত পাঁকে।
আমার আগমনের একমাত্র হেতু হচ্ছে ভালোবাসা
একটি হৃদয় সৃজন করতে পারে প্রিয়জনের জন্য সরণী এক প্রশস্ত,
তৈরি করতে পারে শোভন বসতবাড়ি
যেখানে বন্ধু নিরিবিলি খেলতে পারে পাশা,
এসেছি আমি মনের কয়েকটি মনোজ্ঞ মোহনা তৈরি করতে
বন্ধুত্বের সুরাপানে আমি আজ সামান্য নেশাগ্রস্ত,
এসেছি হৃদয়ের উষ্ণতায় ভ্রামণিক জীবনের ঝুলি ভরতে।
কী অবস্থায় আছি আমি — কেবল এক প্রেমিক করতে পারে তা অনুমান
এসেছি আমি — দুটি সত্তার বিনিময়ে হারিয়ে যেতে শুধু এক বৃত্তে,
নীলিমার অশেষ মূর্ছনায় মিশে যেতে আকাশের তান
নানা বর্ণের ফুল হয়ে ফুটি শুধুমাত্র একটি বীজের চিত্তে।
জানি … তিনি আমার শিক্ষক — আমি তাঁর নেহাত সাকরেদ
তাঁর বাগিচার বুলবুল আমি — তফাৎ নেই কোনো … নেই ভেদাভেদ,
ওস্তাদের বাগিচায় বেড়াতে এসেছি — সৌরভে হয়েছি সুস্মিত
সংগীতের ছন্দসুরে প্রমত্ত হয়ে নৃত্যকলায় মৃত্যুবরণ করব বলে,
আত্মারা এখানে বিজন পথের সাথী — পরষ্পরের অনাদিকালের পরিচিত
ভিন্ন ভুবনেও তারা চিনতে পারে একে অন্যকে — বিস্মৃত হয় না কোনো ছলে,
সান্নিধ্যে এসেছিআমি — তাঁর বিষয়ে অবগত হতে
আমি যা কেবলমাত্র তা তুলে ধরতে চাই —
তারপর চলে যাব নির্ধারিত পথে।
সম্পূর্ণ ভিন্ন আমাদের ধর্ম
আমাদের রীতিনীতি একেবারে ভিন্ন
আমাদের ধর্মও অন্য ধর্মের চেয়ে আলাদা,
বাহাত্তর মাজহাবের পথপরিক্রমা থেকে সুদূরে
রহস্যের রঙমহলে বসবাস করেও
আমরা তৈরি করি না তেমন কোনো ধাঁধা,
আমাদের গতিপথ নির্ধারিত হয় সম্পূর্ণ ভিন্নসুরে।
ওজুর জন্য জল ব্যবহার না করে আমরা হই পবিত্র
দৈহিক কোনো ভঙ্গি না করে রুজু হই উপাসনায়,
হৃদয়ে ধারণ করি না কাবাগৃহ কিংবা কোনো মসজিদের চিত্র
নিঃশব্দে নিমগ্ন হই অনাবিল বন্দনায়।
প্রত্যেকে বহন করে তাদের নিজস্ব অসুখবিসুখ
সুখের মোমদানে আঁধার হয়ে পোড়ে মানুষের নিত্যদিনের দুখ,
কার পরিচয় কী — কেউ জানে না … কী কারণে
কোনো কোনো মানুষ পরে নেয় রক্ষাকবচ … বর্ম,
আগামী দিনে পরিষ্কারভাবে জানা যাবে
কে পরিত্যাগ করেছে ধর্ম?
ইউনুস, আত্মাকে জাগ্রত করো পুনরায়
স্মরিত হও সুহৃদ হিসাবে,
সৌরলোকে দগ্ধ হতে হতে ভাসো জ্যোৎস্নার নৌকায়
সজাগ করো শ্রবণেন্দ্রিয়, শোনো প্রতিটি শব্দ গভীরভাবে।
সামান্য একটি শব্দে উজ্জ্বল হতে পারে মুখ
যে জানে শব্দের মূল্য — যেসব শব্দ নিখাদ ও নির্মল
সে-শব্দমালা উজ্জ্বল করতে পারে তার মুখমণ্ডল।
নীরবতায় পরিপক্ক হয়ে কেবলমাত্র একটি শব্দ
থামাতে পারে দ্বন্দ্বসংঘাত রক্তারক্তি
জোগাতে পারে কাজকর্মে প্রাণশক্তি,
শব্দের ব্যবহারে যুদ্ধের হতে পারে অবসান
শব্দ নিরাময় করতে পারে জখম — দিতে পারে ত্রাণ।
এমনকিছু শব্দ আছে যা বিষকে
মাখন ও মধুতে করে রূপান্তরিত,
শব্দকে পরিপক্ক হতে দাও তোমার অভ্যন্তরে
হও পরিণত।
কুসুমিত হয়নি যে ভাবনা — প্রকাশ কোরো না তা
বাগবৈদগ্ধ্যে হয়ো না অযথা উন্মুখ
অনুধাবন করো সেসব শব্দের অন্তর্হিত স্বরূপ,
যা বিত্তকে রূপান্তরিত করে ধূলিকণায়
শিখো — কখন ব্যবহার করবে একটি শব্দ
কখন পরবে জুতা খালিপায়।
আচারবিচারে হয়ে ওঠো নির্লোভ
জেনে নাও কখন পালন করতে হয় নীরবতা,
এমন শব্দের কথা ভাবো যা সংযত করে ক্ষোভ।
সামান্য একটি শব্দ নরককে রূপান্তরিত করতে পারে জন্নতে
যা তুমি জানো তার গরিমায় হয়ো না মূর্খ,
চলো সঠিক পথে
হও হুঁশিয়ার,
প্রতিফলনে নিমজ্জিত হও — মুখ খোলার আগে
স্পর্শে পরখ করে নাও শব্দের ধার।
ভাবনারহিত বাক্য ব্যবহারে অভ্যস্থ মুখ
করতে পারে আত্মাকে আহত,
ইউনুস — একটি অন্তিম বাক্য উচ্চারণ করে যাও সতত
শব্দের অভ্যন্তরে প্রচ্ছন্ন আছে প্রজ্ঞা — যার মহিমা অপরিসীম,
কেবলমাত্র একটি শব্দ‘আমি’
বিভাজিত করবে স্রষ্টা থেকে তোমাকে
যাঁর মহিমা নিঃসীম।
যাও — জ্ঞাত করো প্রত্যেক প্রেমিককে
যাও — বিষয়টি অবগত করো প্রত্যেক প্রেমিককে
আমি হচ্ছি সে-মানুষ — যার হৃদয় থেকে
ভালোবাসার রশ্মি ছড়াচ্ছে দিগ্বিদিকে।
আমি বাসনায় দগ্ধ হতে হতে পরিণত হয়েছি বুনোহাঁসে
উড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ি সরোবরে,
ঊর্মিমালা থেকে চঞ্চুতে তুলে নেই নোনাজল
নীড়হারা আমি — ফিরি না আর নিজস্ব ঘরে,
পালকের জলকণা ছড়িয়ে দেই উড্ডয়নের গতিপথে
আকাশ থেকে আকাশে।
মেঘের মতো উড়তে উড়তে আমি উঠে যাই
ঊর্ধ্বে নীলিমা বিপুল,
উড়ে যাই আমি মহাকাশে
মৃত্তিকার শিকড় ছিঁড়ে উন্মূল।
আমার পায়ের নিচে স্বর্গের সোপান
যে বলে — আমি দৃষ্টিবান,
সে আদতে দেখে না — যদিও সে করে দেখার ভান।
জ্ঞানের দাবিদার সে বস্তুত জানে না কিছু
তার সান্নিধ্য সময়ের অপচয় — ছুটে সে মরীচিকার পিছুপিছু।
কেবলমাত্র জ্ঞাত তিনি — দেখান আমাদের তাবৎ ভুবন
তাঁর প্রেমাঞ্জনে হয়েছি আমি
ভালোবাসার ক্রীতদাস অনুখন।
খাঁটি প্রেমিকের জন্য এ ভূমি স্বর্গবিশেষ
পথ চেনে যারা — খুঁজে পায় এখানে তারা প্রাসাদ এক
যার বাগিচায় ফোটে রকমারি কুসুম অশেষ।
বিস্ময়ে হতবাক আমি — মুসা নবির মতো তারিফে হই বিভোর
দাঁড়িয়ে সিনাই পাহাড়ে দেখি — দিগন্তে ফুটছে অরুণিম ভোর।
ইউনুস আমার নাম — আজ আমি ভাবে মাতোয়ারা
ভালোবাসার দিগনির্দেশনায় ছুটে যাই পর্বত-সমুদ্রে পাগলপারা।
সম্পূর্ণ একাকী আমি ছুটে যাই রাজকীয় সুহৃদের দরবারে
মৃত্তিকায় চুমো খেয়ে আমি হাঁটি
পৌঁছি অবশেষে প্রার্থিত প্রাসাদের দুয়ারে।
… …
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
- মাসুম পারভেজ : কবি, কাব্যগ্রন্থহীন || সরোজ মোস্তফা - February 7, 2025
- ছত্তার পাগলার সন্ধানে আহমেদ স্বপন মাহমুদ ও সরোজ মোস্তফা - January 28, 2025
COMMENTS