জফির সেতুর ভাষাঅঙ্গ পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশকের কালসীমায় আবির্ভূত কবিদের ন্যায় সাবলীল। এই কবি রক্তমাংসে রূপবুভুক্ষু এবং তাঁর কবিতারা সেখানে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে বেড়ায়। পুরুষ-প্রকৃতির মিলন থেকে উৎসারিত যেসব সুর মানুষকে জীবনের প্রতি রন্ধ্রে স্ফূর্তিব্যাকুল আদিম শিহরণের প্ররোচনা যোগায় সেতুর কবিতায় তার অনুরণন চোখে পড়ে। নব্বইয়ে সক্রিয় সময়ঘূর্ণির ছাপ অল্পাধিক থাকলেও এমিলি জোলা ও ডি. এইচ লরেন্সে মুখরিত আদিপ্রাকৃত পৌরুষ, প্রাচীন কালপর্বে সচল কামমুদ্রা আর আরণ্যিক সভ্যতায় ঠিকরে-পড়া জগতে কবি মূলত নিজের প্রস্থানভূমি তালাশ করেন :—
হয়তো আমরা দুজনেই কোপাই …
একটি শস্যের দানা যেমন আলের পাড়ে থাকে অবহেলায়
রাতের তারার কাছেই কেবল স্পষ্ট ও অর্থবহ হয়ে ওঠে
আমাদের সম্পর্কের কোপাইও তেমনই নীরব ভাষায় কথা বলে
মানুষের রক্তের ভেতরে
মানুষের ঘামের ভেতরে
পাখিদের ঝলসানো জামার ভেতরে
অসমাপ্ত, ভঙ্গুর।
(ময়ূর উজানো ভাসো : ৮)
…
হে ঘোটকী, আপেলের কলি এসেছে গাছে গাছে
তার পাশে তোমাকে খুব বিমর্ষ লাগছে
কী ভাবো তুমি এই চাঁদজ্বলা রাতে?
এই গভীর স্তব্ধতায় আমি শুধু তোমাকে দেখি
মৃত অরণ্যের ভেতর যেমন বাঘ উৎকর্ণ থাকে
তেমনই পেছনে মৃত্যু নিয়ে তুমি একাকী হয়েছ?
(সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী : ১১)
…
আমরা দুজনে পুরোনো তলোয়ারের খাপ
মানুষের সম্পূর্ণ পোশাক এখনো দেখিনি…
(প্রস্তরলিখিত : ১২)
…
তোমার ছোট্ট ডিম্বানুর ভিতর আমি টলমল আতাফল।
(প্রস্তরলিখিত : ৩১)
…
তোমার ভিতরে আমি গুপ্ত ফুল
ফুটে আছি জন্মমুহূর্ত থেকে অজ্ঞান জোছনা
বকুল গাছের গাঢ় অন্ধকারে
এমনকি তোমার রঙিন অন্তর্বাসের নিচেও।
(বার্তা : জাতক ও দণ্ডকারণ্য)
…
গাছ ও মৃত্যুর মধ্যে কাকে তুমি নেবে?
গাছ হচ্ছে এক উন্মাদ প্রেমিক কেঁচো হয়ে যে আজ কিম্ভূত
মৃত্যু হচ্ছে তোমার পিতার পাঁজরের দুই রূপালি আভোগ…
(একটি জিজ্ঞাসা : জাতক ও দণ্ডকারণ্য)
জফির সেতুর কবিতা সূচনালগ্ন থেকে রুশো-র প্রবাদপ্রতিম উক্তির প্রতিধ্বনি,— ‘জন্মের মুহূর্ত থেকে মানুষ স্বাধীন হলেও সর্বত্র শৃঙ্খলিত।’ পরিপার্শ্বে বিদ্যমান ট্যাবুবন্দি অস্তিত্বের কারাগারে সচল মাংসপিণ্ড রূপে কবি নিজেকে সেখানে আবিষ্কার করেন। এই ট্যাবুজাল ছিন্ন করা অসাধ্য বুঝতে পেরে তাঁর মন সাঁতার কাটে ইতিহাসের সুদূর দূরত্বে বিলীন স্থানিকতায়! মিথ ও বিশ্বাসের জাল দিয়ে বোনা ওইসব স্থানিকতা সারাখন বুনো বাসনায় আদিম ও শরীরী হয়ে বিরাজ করে কবির চেতনায়। তাঁর কবিতার পুরুষপ্রকৃতি সে-কারণে শিশ্নপরায়ণ হলেও কামুক নয়। রমণীপ্রকৃতি যৌনতাড়নার অনুষঙ্গে মোড়ানো হলেও তাকে প্রেমিকা ও স্বৈরিণীর দ্রবণ থেকে জাত কামসামগ্রী ভাবতে মন আপত্তি জানায়। কবি ও রমণী উভয়ে সেখানে আদিপ্রাকৃত ইতিহাসের অংশ। আদি মানব-মানবীর ভুলের কারণে এই ইতিহাসের সূচনা হয়তো একদিন নন্দনকাননে ঘটেছিল! সভ্যতার ঊষালগ্নে হয়তো-বা সচল ও সহজাত ছিল সেই ইতিহাস। এখন, কংক্রিটের নগরে বসে নিজ পুরুষত্বে আদিপ্রাকৃত ইতিহাসের উষ্ণতা কবি টের পান এবং নিজেকে সেখানে উত্তেজিত ও শিশ্নাতুর রাখেন।
জফির সেতুর কবিতায় সরব কামুকতা অধুনা মনোবিশ্বে সক্রিয় লিবিডোর স্মারক নয়! এর জন্ম সভ্যতার সন্ধিক্ষণে যখন মানব-মানবী গুহা, অরণ্য আর ঝর্ণা ছেড়ে শানবাঁধানো সড়কে উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাঁর কবিতায় আত্মসচেতনার সঙ্গে অবচেতনার বিরোধ বড়ো বিষয়। অবচেতনায় সক্রিয় প্রাগৈতিহাসিক কামপিপাসা কবিতার ভাষা ও গতিপথকে নির্ধারণ করে যায়। কবির মনোজগতে সক্রিয় কামপিপাসার সঙ্গে ইরোটিক বলতে লোকে যেমনটি বুঝে থাকে এর বিলক্ষণ তফাৎ রয়েছে এবং পাঠকের সেটি খেয়াল রাখা প্রয়োজন। বিগত কয়েক শতাব্দীর ঐতিহাসিক ঘটনাপরম্পরায় ইরোটিক প্রভাবিত ‘কামবাসনা’ লোকসমাজে স্থায়িত্ব লাভ করলেও প্রাচীন মানব-ইতিহাসে সক্রিয় কামবাসনা নিছক আদিপ্রাকৃত বাসনার বিস্ফারে স্বচ্ছন্দ ছিল। জফির সেতুর কাব্যভাষাকে এই অঙ্গে পাঠপ্রাসঙ্গিক করে নিলে তবে বোঝা যায় কেন তাঁর ভাষায় যুগপ্রবাহের টানাপোড়েন থেকে সৃষ্ট কামবাইয়ের দ্বন্দ্ব পাঠক তীব্র হতে দেখে না! যেমনটি লরেন্স বা জোলা এক-সময় করেছেন, কবি জফির সেতুও নিজ সময়পরিধিকে ‘বহুবর্ণ রক্তবীজ’ লেখার দশকে প্রত্যাখ্যান করে বসেছিলেন :—
নগ্ন কমালুলেবুর পাশে যৌনতাবিহীন
তুমি কেমন নিরুত্তাপ গম্ভীর সাদা এই রাতে…
(নগ্ন কমলালেবুর পাশে)
…
আমার সকল রাজহাঁস ধূসর কি সাদা, মন্দ্র কি কোমল
আদিবাসী মেয়েদের মতো দিনমান শুধু গুল্মে ও বনে
তাদের নিরন্তর চলা কেবল আদি উৎসের দিকে…
(আমার রাজহাঁসেরা)
…
আমাকে বেহুদাই যাজক ভেবেছিলে বরং প্রাকৃত এই জীবনযাপন
ব্রহ্মচর্যে বিগতপ্রাণ নাভিমূল থেকে উদ্ভিন্ন পরমায়ু নিয়ে
আমি সোহংবাদী…
(ক্ষতগল্প)
‘বহুবর্ণ রক্তবীজ’-এ শিশুবিষয়ক পঙক্তিমালায় (দ্রষ্টব্য : শরীরের সব তির খুলে) ফ্রয়েডিয় লিঙ্গগূঢ়ৈষা হানা দিলেও সামগ্রিকভাবে জফির সেতুর অবচেতন সত্তায় এই গূঢ়ৈষার প্রকোপ দীর্ঘস্থায়ী কোনো তরঙ্গ নয়। তাঁর বয়ানভঙ্গির মধ্যে সুতরাং ফ্যানি হিল ও লারস ভন ট্রায়ারের নিম্ফোম্যানিয়ার গাঁথুনি জোরদার হওয়ার পথ পায় না। হেনরি মিলার বা মোরাভিয়া সেখানে আধিপত্য ধরে রাখতে বিফল হয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও জগদীশ গুপ্তের প্রাকৃত জীবনবীক্ষণ থেকে উৎসারিত কামবাইয়ে উপরতলা ও নিচুতলার যেসব দ্বন্দ্ব সরব থাকে সেতুর প্রাকৃতজন নিরীখনের বয়ানে সেটি পিছলে সরে যায়। তাঁর কবিতাবয়ান কামসূত্র ও কালিদাসে নিজেকে শিলীভূত রাখে; সে হয়তো ফিরে যেতে চায় চর্যা ও মহাভারত-এ বিরাজিত দণ্ডকারণ্যের বৃত্তে।
অবদমন ও কামবাইয়ের সঙ্গে নিজের লড়াই জারি রাখতে ইতিহাসের ধূসর প্রদোষকালে নিষ্ক্রমণ কবিকে নব্বইয়ের ভাষাবৃত্ত থেকে ছিটকে বাইরে নিক্ষেপ করে। এই সময়ের কামবাইয়ের চরিত্র অঙ্কনের জন্য উপযুক্ত ভাষাভঙ্গি বা সে-রকম মেটাফোর তাঁর বয়ানে অচিহ্নিত থেকে যায়। সেতুর কাব্যঅঙ্গে সিনথেটিক মেটাফোরের দেখা কদাচিৎ মিলে যারা থাকলে পরে শব্দের অভ্যস্ত অবয়বে বিকার ঘনায় এবং কবিতাকে সাম্প্রতিক প্রবণতার স্মারক গণ্য করতে পাঠক বাধ্য হয়। ‘সহস্র ভোল্টের বাঘ’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত ‘মিডিয়া’ কবিতাটি গণ্য ব্যতিক্রম যেখানে কবি জৈব ও বায়বীয় যৌনতার তুলনা ও মিলকে একীভূত বলে ভেবেছেন :
আসলে সেক্স একটা মৌলিক বিষয় যা অনাদিকালেও ছিল
যখন ফেনসেক্স ছিল না তখন মেঘসেক্স ছিল, কালিদাস
মেঘসেক্স করতেন…
টেলিফোনই আমাদের ভিজায় বেশি আর আমরা প্রস্তুতি নিই
কাদামাটির বদলে আমাদের শরীর ভরে যায় শস্যের আঘ্রাণে
তুমিও কেমন বৃষ্টিভেজা কামিনী হয়ে ওঠো
বহুজন আমাদের এনজয় করে…
(মিডিয়া)
এ-রকম আরো কিছু বয়ান থাকতে পারে তবে সময় ও সাম্প্রতিকে জফির সেতুর বিচরণ দূরত্ব ও নিষ্ক্রমণের ছকে বাঁধাই করা। কৃত্রিম অথবা বায়বীয় নয় বরং সভ্যতাবিলগ্ন জৈব ও আরণ্যিক যৌন-অস্তিত্বে তাঁর পুরুষপ্রকৃতি মিলনবাসনায় রমণীপ্রকৃতির সঙ্গে অভেদ হয়। এর ব্যতিহারে যা থাকে তার সঙ্গে কবির সংযোগ এহ বাহ্যিক। ‘ছাতিম গাছ’ কবিতায় মুদ্রিত সংবেদন সম্ভবত এই কবির তিন দশকের জার্নির নিষ্ক্রমণবিন্দু বুঝতে পাঠককে সাহায্য করে :—
আমি চেয়েছিলাম ছাতিম গাছটির অন্ধকারে সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকুক
নগ্নপায়ে দাঁড়িয়ে শুনতে পাক পৃথিবীর অশ্রুতকালের কাহিনি
চেয়েছিলাম তার ভেতরকার অদ্ভুত ছাতিম গাছটি সে স্পর্শ করে দেখুক
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অনুভব করুক আদিমাতার আর্তি কতটা মৃত্যুঘন ছিল
ওসবের কিছুই না-করে সে পালকের উদ্গার নিয়ে উড়ে গেল
অনেক দূরে, আর আমি হতবাক আদমের মতো অন্ধ ছাতিম গাছটির
নিচে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকলাম, একা। …
(ছাতিম গাছ : জাত ও দণ্ডকারণ্য)
এই মনোবাসনায় শরিক হওয়ার পর জফির সেতুর জার্নিকে কোন দশকি ছকে আলোচনা করা সম্ভব সে এক প্রশ্ন বটে! নব্বই ও পরবর্তী কালপর্বে সচল ভাষাপৃথিবীর মধ্যে কবির বিপর্যাসহীন শব্দপ্রয়োগ আপাত পাঠে অস্বস্তিকর মনে হয়, কিন্তু আদিপ্রাকৃত অতিকল্পনা দিয়ে মোড়া সভ্যতায় গমনের তাড়নাকে নজরে নিয়ে আসলে তারা বেশ মানিয়েও যায়! তাঁর কবিতার অন্তর্গত ফিজিক ও সেখানে নিহিত শিরা-উপশিরায় বহমান ক্ষুধা সকল যুগের নাগরিক চৈতন্যে নিরবধি বহে। এহেন ক্ষুধায় শামিল হওয়ার মনোবাসনা একদিক থেকে এই কাব্য ঘরানাকে পরিবেশ বিজ্ঞানী জেমস লাভলকের ‘গাইয়া’ তত্ত্বে (GAIA Hypothesis) মূর্ত জীবনবেদে একীভূত করে। লাভলকের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব পাঠককে গ্রিক ধরিত্রীদেবী গাইয়ার নামে নামাঙ্কিত পৃথিবীর খবর জানায়। একইসঙ্গে দেবী, জননী, প্রেমিকা ও ভার্যা ‘গাইয়া’ হলো স্ব-নিয়ন্ত্রিত (Self-regulated) রমণী। লোকে তাকে পরমাপ্রকৃতি নামে সম্ভাষণ করে। রমণী কারো মুখাপেক্ষী নয়। নিজ রমণীয়তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংরক্ষণের পৌরাণিক মহিমায় সে গরিয়ান। মানুষ থেকে শুরু করে জৈব ও অজৈব উপায়ে সৃষ্ট সকল বস্তুরাজি ‘গাইয়া’-র অংশ এবং দেবীর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে তারা পূর্ণতা লাভ করে। নিজের রমণীয়তায় কী করে অটল থাকতে হয় দেবী ‘গাইয়া’-র সেটি অজানা নয়। ওদিকে শিশ্নপরায়ণ মানুষের কামবাই রমণসুখের ছলে শত সহস্র বছর ধরে তার ইজ্জত লুণ্ঠন করে চলেছে এবং ঘটনার পরিণতি সম্পর্কে দেবী সজাগ। বিকারগ্রস্ত কামুকতা এখন অন্তিম দশায় উপনীত হতে চলেছে। লাভলক মনে করেন মানুষের হয়তো সময় হয়েছে দেবী ‘গাইয়া’-র সেই রূপ সচক্ষে দেখার যেই রূপে কালবিনাশিনী কালী শিবের বুকের ওপর চড়ে চণ্ড কালী হয়ে নাচে আর জগৎ সংহারের ডমরু বাজে দিকচক্রবালে। ধ্বংসের পর শান্তিপর্ব নামবে বৈকি! পৃথিবীর বায়ুস্তরে কার্বন ও মিথেনের ঘন আস্তরণ আর পারমাণবিক বিস্ফোরণের ভয়াল যজ্ঞ শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেকে নিরাময়ে সক্ষম ‘গাইয়া’ পুনরায় তার আদি রূপে সংস্থিত ও যৈবতী হয়ে উঠবে। আফসোস, যৈবতী ‘গাইয়া’-র অমলিন রমণীয়তায় পুনঃপ্রবেশের জন্য কামবাইয়ে উতলা একটি মানুষ সেদিন বেঁচে থাকবে না!
অনিবার্য এই মারণ ঠেকানোর উপায় কি নেই? বিগত চার দশকের গবেষণায় লাভলক সে-উপায় বাতলে চলেছেন। তাঁর মতে একুশ শতক জুড়ে বিকাশমান প্রযুক্তিকে সঠিক উপায়ে কাজে লাগাতে পারলে ‘গাইয়া’-র ইজ্জত লুণ্ঠন না করেও তার রমণীয়তায় বিহার করা সম্ভব। তবে এর জন্য সেই পুরুষত্বে মানুষের ফেরত যাওয়া প্রয়োজন যার কাছে ‘গাইয়া’ হলো মহান রমণী! তাকে ভালোবাসতে পারলে সে রমণীয়তা নিঃসরণ করে, তবে কারো মনে ধর্ষণইচ্ছা জাগ্রত হলে চণ্ডীকালী হয়ে কাটারির কোপে ধর্ষকের শিশ্ন ছেদনে দ্বিধা করে না। বিজ্ঞানীমহলে নিজের তত্ত্ব উপস্থাপনের দিনগুলোয় বন্ধু ও প্রতিবেশী নোবেলজয়ী ইংরেজ লেখক উইলিয়াম গোল্ডিংকে লাভলক নিজের ভাবনাটি শুনিয়েছিলেন। গোল্ডিং তাঁকে গ্রিক ধরিত্রীদেবী ‘গাইয়া’-র কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও শুরুর দিনগুলোয় দেবীকে অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকৃতি প্রদানে বিজ্ঞানীমহলে দ্বিধা ও বিরূপতার অন্ত ছিল না। ‘গাইয়া’ নামক পৃথিবীর স্ব-নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা প্রবল সন্দিহান ছিলেন। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করতেন পৃথিবী ওরফে ধরিত্রী এবং সেখানে জায়মান প্রকৃতি হলো আকস্মিক দুর্ঘটনার ফলাফল! অণু-পরমাণু মিলে অবোধ্য সংস্থিতির মাঝে সক্রিয় পৃথিবীকে সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে জন্ম দিয়েছিল। বস্তুপুঞ্জে পরিপূর্ণ ধরিত্রী মোটেও অতটা কমনীয় নয় যেমনটি কবিরা ভেবে থাকেন! রূপে-গুণে মন হরণ করলেও নিষ্ঠুরতা তার মজ্জাগত। মানুষকে দয়াদাক্ষিণ্য দেখানোর ব্যাপারে সে ভাবলেশহীন। যোগ্যতার পরীক্ষায় পাশ দিয়ে তবেই তার রমণীয়তায় প্রবেশের পথ মানুষ খুঁজে পেয়েছে। পৃথিবীর রমণীয়তা কেবল অজেয় পৌরুষকে যোনিগর্ভে টানে আর আর কাপুরুষকে সে উপহার দেয় মৃত্যু। বড়ো কথা হলো তার নিয়তি বা পরিণাম ইত্যাদি নিয়ে মানুষের মাথাব্যথা থাকলেও ধরিত্রী স্বয়ং এ-ব্যাপারে উদাসীন!
শিলীভূত এইসব সংস্কারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে লাভলককে প্রমাণ করতে হয়েছিল মানুষের কেন বোঝা প্রয়োজন শক্তির মিলন-সংঘাত থেকে সৃষ্ট পরমাণু, পরমাণুর রাসায়নিক প্রতিফল অণুজীব আর অণুজীবের মিথস্ক্রিয়া থেকে জাত জৈবসত্তাকে ‘গাইয়া’ সচেতনভাবে লতাগুল্মে আচ্ছাদিত কবোষ্ণ বক্ষে স্থান দিয়ে থাকে। যে তাকে ভালোবাসতে জানে সেই প্রেমিকের সঙ্গে তার আচরণ একরকম হয়, আর লোভের উদগ্র বাসনায় অন্ধ প্রেমিক যখন সেখানে প্রবেশ করে তার ভাগ্যে খারাপ প্রতিফল জোটে। ‘ছদ্মবিজ্ঞানের প্রবক্তা’ উপাধি ঘাড়ে বহন করে শতবর্ষী লাভলককে বোঝাতে হয়েছিল ‘গাইয়া’-র ব্যাপারে মানুষের কামবাইয়ে পরিবর্তন ঘটা কী কারণে আবশ্যক :—
গাইয়া বিষয়ক এই তত্ত্ব তাদের জন্য যারা ধরিত্রীর বুকে পদচারণা করতে ভালোবাসেন অথবা নিছক সেখানে দাঁড়িয়ে পড়েন এই বিস্ময় অবলোকন ও অনুমান করতে…যে-জীবন ধরিত্রী বহন করে চলেছে সেখানে আমাদের উপস্থিতির পরিণাম আসলে কেমন হতে পারে। প্রকৃতিকে দমন ও জয় করার জন্য নৈরাশ্যবাদ তাকে আদিম শক্তি ভাবে আর এটি (*গাইয়া) হলো নৈরাশ্যের বিকল্প। উপরন্তু, আমাদের গ্রহ নিয়ে আঁকা হতাশাজনক ছবির বিকল্প, যে-ছবি গ্রহটিকে স্মৃতিভ্রষ্ট এক নভোযান মনে করে;— সূর্যে অন্তর্হিত চক্র ঘিরে যে নাকি চিরকাল ধরে চালক ও লক্ষ্যবিহীন ভ্রমণ করে চলেছে।
(GAIA: A New Look on Life at Earth By James Lovelock; ভাষান্তর : লেখককৃত)
জফির সেতুর কবিতায় আরণ্যক পরমাপ্রকৃতির আধার পৃথিবী অতিকল্পনা বা মিথের আধার রূপে বিবেচিত হলেও কবির পৌরুষ সেখানে গমনের জন্য যে-পথের সন্ধান করে সেটি লাভলকের ‘গাইয়া’ থেকে দূরবর্তী নয়। বহমান দেশকালে বিরাজিত কামবাই ও মনোদৈহিক জটিলতা সঙ্গে করে পরমাপ্রকৃতির দেহে প্রবেশ সম্ভব নয় বুঝে কবি তাকে যুগ-প্রাসঙ্গিক সংজ্ঞায় বি-নির্মাণের তাড়া বোধ করেননি। তাঁর পুরুষত্ব পরমাপ্রকৃতির লতাগুল্মে নিজেকে জড়ায়, এর কবোষ্ণ বক্ষ থেকে উৎসারিত দুগ্ধ পানে ব্যাকুল হয়, উরুসন্ধির গহন বাঁকে নিষাদ হয়ে ঢোকার পর খেই হারায় এবং নিজেকে সেখানে ক্রমশ অভিন্ন করে। পরমাপ্রকৃতির দেহে প্রবেশের উদ্দেশ্যে বিরচিত এইসব পঙক্তিমালা বিরোধের পরিবর্তে ঐক্য, বিচ্ছেদের বদলে মিলন, আর কূটাভাসে নিঃস্ব হওয়ার বদলে বন্য সমর্পণে রতিতৃপ্তি খুঁজে পায়। ভাষাঅঙ্গে পঞ্চাশ ও অনুবর্তী সময়ে বিরাম নেওয়ার প্রবণতা থাকলেও জফির সেতুর কবিতার অর্থস্তরে নিহিত যৌনতাড়না নব্বইয়ের যুগবিশ্বে বিদ্যমান মনোদৈহিক কূটাভাসের পাঁচালিতে নিজেকে নিঃশেষ করেনি। লাভলকের ‘গাইয়া’ তত্ত্বে বর্ণিত জীবনবেদের রোশনি ছলকানোর কারণে নিছক লিবিডোতাড়িত অনুষঙ্গের বাইরে বসেও তাঁর কবিতাকে পাঠ যাওয়া সম্ভব। আপাতদৃষ্টিতে অতীতমুখী বৃত্তে গমন করছেন মনে হলেও অর্থস্তরে নিহিত বৈশিষ্ট্য কবিকে বিগত তিন দশকে আদিপ্রাকৃত জীবনবোধ নিয়ে বিরচিত ভাবনায় শামিল হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। লম্বা এই জার্নি শেষে জফির সেতু অবশ্য খানিক ভিন্নকণ্ঠী। সাম্প্রতিক সময়ের স্ববিরোধী আর্তির অঙ্গে পাঠক তাঁকে সংযুক্ত হতে দেখছে। কাশ্মির বাখান নিয়ে বিরচিত ‘তিন ভাগ রক্ত’-এ লিপিবদ্ধ পঙক্তিমালা সে-প্রমাণ রেখে যায়।
রিলেটেড রচনারা
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আশির দশকের কবি, আশির দশকের কবিতা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS