মহাযান বৌদ্ধ দর্শনের একটি শাখা জেন, যার উৎপত্তি চীনে, আনুমানিক পঞ্চম শতকের দিকে। একে তাওবাদের সাথে মহাযানের সুসমন্বিত মিশ্রণও বলা যেতে পারে। চীনে এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যার নাম পাওয়া যায় তিনি এক ভারতীয় ভিক্ষু, তাঁর নাম বোধিধর্ম। জেন মতবাদের জন্ম চীনে হলেও এটি একটি জাপানি শব্দ। সংস্কৃত ‘ধ্যান’ থেকে চীনা ভাষায় হয়েছে ‘চান’ আর ‘চান’ জাপানে প্রচারিত ও প্রসারিত হয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ‘জেন’ হিসেবে। এটি মানুষকে শাস্ত্র ও তত্ত্বীয় জ্ঞানচর্চার বোঝা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মোন্নয়নের পথ দেখায়।
বুদ্ধের শিক্ষা প্রচারের প্রায় শুরুর দিক থেকেই গল্প একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আসছে। জাতক তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ‘কোয়ান’ বা জেনগল্প জেন মতবাদের এক অনন্য অপরিহার্য অংশ। ‘কোয়ান’ হলো প্রাচীন চীনা আচার্যদের জেন বা বুদ্ধ-বিষয়ক ছোট ছোট গল্প বা কথোপকথন। এ আলাপচারিতা বা গল্পগুলো অনেকটা ধাঁধার মতো। কোনও মানে নেই মনে হয়, কিন্তু ভাবতে গেলে অনেক মানেই বেরিয়ে আসে।
‘কোয়ান’ বা জেনগল্পের ঘটনাগুলোকে যতই অর্থহীন বা খামখেয়ালিপনা মনে হোক না কেন এগুলো মোটেই তা নয়। কারণ এসবের মধ্য দিয়েই জেনসাধকের সত্যদর্শন বা সিদ্ধিলাভ ঘটে যাকে জেন পরিভাষায় বলা হয় ‘সাতোরি’। এসব কিছু বাদ দিলেও জেনগল্পের সাহিত্যমান অনেক উঁচু দরের। যে-কোনও দেশের, যে-কোনও কালের পাঠকের আত্মভ্রমণের অসাধারণ খোরাকও বলা যায় নিঃসন্দেহে।
১১ জেনগল্প ।। ভূমিকা ও ভাষান্তর : জয়দেব কর
ইঙ্গিত
জেন-গুরুর কুকুরটি সন্ধ্যায় তার প্রভুর সাথে খেলা করতে ভালোবাসত। প্রভু শলাকা ছুঁড়ে দিতেন আর সে দৌড়ে গিয়ে ফেরত নিয়ে আসত। এরপর লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে পরবর্তী নিক্ষেপের অপেক্ষা করত। এই রকম এক বিশেষ সন্ধ্যায় গুরু তাঁর ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটিকে ডেকে নিয়ে আসলেন।
ছেলেটি খুবই মেধাবী ছিল। বৌদ্ধ মতবাদের বিভিন্ন অসংগতি নিয়ে সে বেশ বিরক্ত ছিল।
গুরু বললেন, “তোমাকে অবশ্যই বুঝতে হবে ঐ সমস্ত কথাগুলো শুধু পথনির্দেশক স্তম্ভ মাত্র। সত্যের পথে কখনওই কোনও কথা বা প্রতীককে সার ভেবে ফেলো না। এখন তা আমি বুঝাবো।”
সাথে সাথে তিনি তাঁর উৎফুল্ল কুকুরটিকে ডাক দিলেন।
পূর্ণিমার পূর্ণচাঁদের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে তিনি কুকুরটিকে নির্দেশ দিলেন — ‘চাঁদ এনে দাও।’
এবার শিষ্যকে জিজ্ঞেস করলেন, — ‘আমার কুকুর কোনদিকে তাকাচ্ছে?’
— ‘আপনার আঙুলের দিকে তাকাচ্ছে।’
— ‘ঠিক। আমার কুকুরের মতো হতে যেয়ো না। নির্দেশক তর্জনী আর নির্দেশিত বস্তু গুলিয়ে ফেলো না। অপরাপর মানুষের কথার মধ্য দিয়ে মানুষ আপন পথে সংগ্রাম করেই নিজস্ব সত্যের সন্ধান পায়।’
নদীর মতো বয়ে যাও
গল্পটি এক তরুণ মার্শালআর্ট শিক্ষার্থীর, যে কিনা একজন বিখ্যাত গুরুর শিষ্য ছিল।
একদিন গুরু মন্দির-চত্বরে একটি অনুশীলন পর্ব দেখছিলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন যে, অন্যান্য ছাত্রদের উপস্থিতি তাঁর তরুণ ওই শিষ্যটির সুনিপুণ কৌশল প্রয়োগে বাধা দিচ্ছিল।
গুরু তরুণটির হতাশা অনুভব করতে পারলেন। তিনি তরুণটির কাছে গিয়ে তার কাঁধে মৃদু স্পর্শ করে জানতে চাইলেন, ‘সমস্যাটি কী?’
তরুণটি অনীহা প্রকাশের মধ্যে দিয়ে বলল, ‘আমি জানি না। আমি যতটুকু চেষ্টা করি কিছুই হয় না, আমি যথাযথভাবে পদক্ষেপ চালনা করতে পারছি না।’
গুরু প্রত্যুত্তর দিলেন, ‘গুরুর দেখানো কৌশল আয়ত্তে আনার পূর্বে, তোমাকে অবশ্যই ঐকতান বুঝতে হবে। আমার সাথে আসো, আমি তোমাকে তা ব্যখ্যা করব।’
গুরু-শিষ্য ভবন থেকে বেরিয়ে গিয়ে কিছুটা দূরের অরণ্যের ভেতর এক জলপ্রবাহের নিকট আসলেন। কিছুক্ষণ নীরব দাঁড়ানোর পর গুরু বললেন, ‘জলপ্রবাহের দিকে তাকাও, এর গতিপথে পাথর ছড়িয়ে আছে। জলের ধারা কি ওই পাথরগুলোর উপর হতাশায় থেমে যাচ্ছে? শুধু বয়ে যাচ্ছে নিজের গতিপথ তৈরি করে, তা উপর দিয়ে হোক আর পাশ দিয়ে হোক! জলের মতো হয়ে যাও, তাহলেই তুমি জানতে পারবে কাকে বলে ঐকতান।’
তরুণটি গুরুর উপদেশ হৃদয়ে ধারণ করল। দ্রুতই সে তার চারপাশে কদাচিৎ অন্য ছাত্রদের উপস্থিতি লক্ষ করল। কিছুই তার নিখুঁত পদক্ষেপ ফেলার পথে আর আসতে পারল না।
না-বাস্তব জগৎ
একসময় একজন সন্ন্যাসী ছিলেন যিনি বৌদ্ধিক নিয়মনীতিতে ছিলেন বিশারদ এবং সেগুলো নিজের জীবনে রক্ষা করে চলতেন। একদিন রাতে, হাঁটার সময়, হঠাৎ কিছু-একটার উপর তার পা পড়ে যাওয়ায় বিশ্রী একটা আওয়াজ হলো। তাঁর মনে হলো যে, তিনি একটা ডিম্ববতী ব্যাঙকে পিষ্ট করে ফেলেছেন।
এই ব্যাপারটি তাকে সীমাহীন ভীতি ও অনুতাপের মধ্যে ফেলে দিলো। জীবন ধ্বংস না-করার বৌদ্ধিক অনুশাসন রক্ষা করতে না-পারায় তিনি দগ্ধ হচ্ছিলেন। অতঃপর একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন এবং স্বপ্ন দেখলেন শত শত ব্যাঙ এসে তাঁর জীবন দাবি করছে।
সাধু খুবই মর্মাহত হয়ে পড়লেন। কিন্তু যখন সকাল হলো তখন তিনি দেখতে পেলেন যে তিনি আসলে একটা অতিপক্ক বেগুন পিষ্ট করেছিলেন। সাথে সাথে তাঁর অনিশ্চয়তার বেদনা থেমে গেল, এবং প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলেন ‘কোনও বাস্তব জগৎ নেই’ কথাটির মানে। অবশেষে তিনি আয়ত্ত করতে পারলেন কীভাবে জেন অনুশীলন করতে হয়।
মিতাচার
একজন প্রবীণ সন্ন্যাসী যিনি দীর্ঘ কর্মবহুল জীবনে মেয়েদের একটি প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। দলীয় আলোচনাগুলোতে তিনি প্রায়শই ‘ভালোবাসা’ বিষয়টি মুখ্য হিসেবে পেতেন। তরুণীদের সতর্ক করতে তার সাবধানবাণী :
‘তোমাদের জীবনে অতিরিক্ত যে-কোনোকিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হও। লড়াইয়ের সময় অতিরিক্ত ক্রোধ প্রমত্ততা ও মৃত্যু নিয়ে আসতে পারে। ধর্মবিশ্বাসে অতি উৎসাহ করে তুলতে পারে বদ্ধমনা ও নিপীড়ক।
প্রেমে অতিরিক্ত আবেগ প্রণয়ীর কল্পনামূর্তি গড়ে তোলে — এই প্রতিমূর্তিগুলো শেষমেশ মিথ্যায় পর্যবসিত হয় এবং ক্রোধের জন্ম দেয়। অতিরিক্ত প্রেম ছুরির অগ্রভাগ থেকে মধুলেহন সদৃশ।’
এক তরুণী জিজ্ঞেস করলো, ‘একজন অকৃতদার সন্ন্যাসী হয়ে আপনি কী করে নরনারীর প্রেম সম্পর্কে জানেন?’
প্রৌঢ় সন্ন্যাসী উত্তর দিলেন, ‘প্রিয় সন্তানেরা, একসময় আমি তোমাদের আমার সন্ন্যাসগ্রহণের গল্পটি বলব।’
স্বর্গের দরোজা
একদিন সন্ন্যাসী হাকুইনের কাছে নবুশিজ নামের এক সৈনিক এল। তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যিই কি স্বর্গ-নরক আছে?’
‘তুমি কে?’ — হাকুইন জিজ্ঞেস করলেন।
সৈনিক উত্তর দিলো, ‘আমি একজন সামুরাই।’
হাকুইন খুব বিস্ময়ের সাথে বললেন, ‘তুমি সৈনিক!’ ‘তিনি আবার কেমন রাজা যিনি তোমার মতো লোককে রক্ষী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন? তোমার চেহারা দেখে তো ভিখারির মতো লাগছে।’
কথাগুলো শুনে নবুশিজ রেগেমেগে তরবারি বের করতে লাগল। কিন্তু হাকুইন বলেই যাচ্ছেন! — ‘তাহলে তোমার একখানা তলোয়ারও আছে! তলোয়ারে তো আমার মাথা কাটার মতো ধার আছে বলে মনে হয় না!’
এবার ক্রুদ্ধ নবুশিজ যখন তার তলোয়ার সম্পূর্ণ বের করে ফেলল, হাকুইন মন্তব্য করে উঠলেন, ‘এই তো নরকের দরোজা খুলে গেল।’ এই কথা শোনার পর সামুরাইয়ের সম্বিৎ ফিরে এল। লোকটি জেনসাধুর শিক্ষা উপলব্ধি করতে পারল। সাথে সাথে তলোয়ার খাপে প্রবেশ করিয়ে তাঁকে প্রণতি জানাল। এবার হাকুইন বলে উঠলেন, ‘এই তো স্বর্গের দরোজা খুলে গেল।’
একদান দাবা
এক হতাশ যুবক বহু পথ পাড়ি দিয়ে একটি মন্দিরে পৌঁছে প্রধান সন্ন্যাসীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হলো এবং তাঁর সাথে আলাপের মধ্য দিয়ে নিজের অভিপ্রায় জানাল।
‘আমি আমার এই জীবন নিয়ে ক্লান্ত ও হতাশ। আমি বোধিপ্রাপ্তির ও সকল যন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভের উপায় অনুসন্ধান করছি। কিন্তু আমার দ্বারা অবিরাম ধ্যান-সাধনা সম্ভব না। যদি আমি এসবের চেষ্টা করি, তাহলে আমাকে পূর্বের জীবনে ফিরে যেতে হবে, সে-জীবন যন্ত্রণাপূর্ণ জানার পরেও। বোধিপ্রাপ্তির কি কোনও সহজ পথ আছে?’
গুরু জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, আছে, যদি তুমি সত্যিই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হও। তুমি কি এমন কিছু শিখেছ বা পারো যা তুমি একাগ্রতার সাথে সম্পন্ন করতে পারো?’
‘আসলে আমি তেমন কিছুই পারি না। ধনীর দুলাল ছিলাম। কোনও কাজকর্ম কখনও করতে হয়নি। তবে একটা বিষয়ের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহবোধ হতো, তা হলো দাবা। এতে আমি বহু সময় ব্যয় করতাম।’
গুরু তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘গ্যোসিইকে এখানে পাঠাও। তাকে দাবার বোর্ড ও ঘুঁটি নিয়ে আসতে বলো।’
‘ভান্ত, গ্যোসেই তো দাবা খেলতে পারেন না।’
‘ওহ! তাহলে তো ভালোই হলো। তাকে ডেকে নিয়ে আসো।’
সন্ন্যাসী গ্যোসেই এলে গুরু নিজে দাবার ঘুঁটিগুলো বোর্ডের ওপর সাজালেন। তিনি সহকারীকে দিয়ে একটা তরবারি আনালেন এবং সেটি গ্যোসেইকে দেখালেন। ‘সন্ন্যাসী, তুমি আমার প্রতি অনুগত থাকতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছ এবং আমি এখন এর জন্যই ডেকেছি। আগন্তুক অতিথির সাথে তোমাকে একদান দাবা খেলতে হবে; যদি তুমি হেরে যাও তবে আমি এই তরবারি দিয়ে তোমার ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে ফেলব। আর যদি তুমি জিতে যাও তবে আমি আগন্তুক অতিথির মুণ্ডু ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলব।’
গুরুর চোখের দৃঢ় দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বোঝা গেল যে তিনি যা বলেছেন, তা করেই ছাড়বেন।
খেলা শুরু হলো। আগন্তুক যুবক অনুভব করল তার পিঠ বেয়ে অঝোরে ঘাম পড়ছে। সে তার জীবন বাঁচানোর জন্য খেলছে। চারপাশের কথা একদম ভুলে গেল, দাবার বোর্ডটাই হয়ে উঠল তার সমস্ত জগৎ। তার প্রতিপক্ষ ভুল চাল দিলেই সে শক্তিশালী আক্রমণ করে বসছে। যখন গ্যোসেই একটা বড়ে হারালেন, আগন্তুক চোরা চাহনি দিয়ে তাঁকে প্রত্যক্ষ করল। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত চোখের মুখমণ্ডল বহুবর্ষের তপস্যা ও অপূর্ব পবিত্রতায় জড়ানো। এমনকী মৃত্যুর ভয়ও তাঁকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করেনি।
গ্যোসেই আরেকটি ভুল চাল দিলেন। আগন্তুক তার অতীত জীবনের নিরর্থকতা ও অকৃতির কাছে পরাজিত। সে ভাবল, ‘আমি এই মানুষটিকে মরতে দিতে পারি না। আমি মারা গেলে পৃথিবীর কোনও ক্ষতি হবে না। আমি শুধু সময়ের অপব্যয় করেছি, আমার কোনও অর্জন নেই। সন্ন্যাসী কঠোর পরিশ্রমী ও নিয়ামানুবর্তী জীবন যাপন করেন। তাঁর মৃত্যু একটি অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হবে।’ তার মধ্যে করুণার এক অপূর্ব তরঙ্গ জেগে উঠল। ইচ্ছে করেই সে ভুল চাল দিলো, তার অবস্থান প্রতিপক্ষের সহজ আক্রমণের জন্য উন্মুক্ত করে দিলো যেন সে।
হঠাৎ, গুরু সামনে ঝুঁকে এসে খেলা ভেঙে দিলেন। প্রতিযোগীদ্বয় তাঁর দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। গুরু ঘোষণা দিলেন, ‘এখানে কেউ জয়ী নয়, আবার কেউ পরাজয়ীও নয়।’ তিনি আগন্তুক যুবকের দিকে ঘুরলেন : ‘বোধিলাভের জন্য তোমার দুটি জিনিস প্রয়োজন — সম্পূর্ণ মনোযোগিতা ও করুণা। আজ তুমি দুটোই শিখেছ। প্রথমে খেলার মধ্যে পুরোপুরি নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিলে। এই একাগ্রতার কারণে করুণার জন্ম হয়েছে। এটি তোমাকে তোমার জীবন উৎসর্গের জন্য প্রস্তুত করেছে। আমাদের সাথে কয়েক সপ্তাহ থাকো, একই চেতনায় আমাদের নিয়মনীতিতে নিজেকে সংযুক্ত রাখো — তোমার বোধিলাভ সুনিশ্চিত। যুবক সম্মত হলো এবং অবশেষে বোধিলাভ করল।
আপনি যা-ই করেন না কেন তাতে সম্পূর্ণ নিমগ্ন হয়ে যান। করুণা স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেবে — তা যে একাগ্রতার বিশ্বস্ত সহচর এবং তা অনুশীলন করা যায় না। এটাই বোধিলাভের পথ।
বিড়ালের মাথা
সোজান নামক এক চীনা জেনগুরু তাঁর কবিতা ও ক্যালিগ্রাফির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। একদিন ছাত্রদের সাথে কথা শুরু করতে যাচ্ছেন, ঠিক এমন সময় এক ছাত্র তাঁকে জিজ্ঞেস করে বসল, “গুরুদেব,পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি কী?”
কোনও ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে না পড়ে তিনি খুব সাবলীলভাবে উত্তর দিলেন, “একটি মৃত বিড়ালের মাথা।”
ছাত্রটি হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। ভাবল গুরু বোধহয় তার প্রশ্ন ঠিকমতো শোনেননি। তাই প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করল।
“গুরুদেব,আমি জানতে চেয়েছি যে পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস কী?”
গুরু এবারও তড়িৎ উত্তর দিলেন, “একটি মৃত বিড়ালের মাথা?”
এবার সোজানের সকল শিষ্য ধাঁধায় পড়ে গেল।
একজন ছাত্র জানতে চাইলো, “এ পৃথিবীতে একটি মৃত বিড়ালের মাথা কেন সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু?”
সোজান খুব সহজেই উত্তর দিলেন, “কারণ কেউই এর দাম নির্ধারণ করতে পারবে না! কোনও বস্তুর চাহিদা ও ব্যবহার কি এর প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করতে পারে?”
ভাগ্য
এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ । জাপানি জেনারেল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একটি আক্রমণ পরিচালনার, যদিও দুঃখজনকভাবে তার সেনাসংখ্যা ছিল অপর্যাপ্ত। তিনি বিজয় লাভে আত্মবিশ্বাসী হলেও তার লোকেরা ছিল সন্দিগ্ধ। যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার পথে, তারা একটি ছোট মন্দিরে থামলেন। সেখানে সবাই প্রার্থনা সারার পর, জেনারেল তার পকেট থেকে একটি ধাতব মুদ্রা বের করলেন এবং বললেন, “আমি এই মুদ্রা টস করে দেখতে চাচ্ছি আমাদের ভাগ্যের কী আছে! যদি ‘মাথা’ ওঠে তবে আমরা বিজয়ী হব। আর যদি ‘লেজ’ ওঠে, আমরা হারব।”
সৈন্যরা খুব মনোযোগ সহকারে জেনারেলের কার্যক্রম দেখতে লাগল! জেনারেল মুদ্রাটি বাতাসে ছুঁড়ে দিলেন এবং পড়ন্ত মুদ্রাটি আবার দুই হাত দিয়ে লুফে নিলেন। বাম হাত মুদ্রার নিচে, আর ডান হাত মুদ্রার উপর। যেই জেনারেল ডান হাত সরালেন তৎক্ষণাৎ তার বাম হাতে ভেসে উঠল মুদ্রায় অঙ্কিত ‘মাথা’! আনন্দে উৎফুল্ল সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রসর হলো এবং বীরত্বের সাথে লড়াই করে শত্রুপক্ষকে পরাজিত করল।
পরে, একজন লেফটেন্যান্ট যিনি অনেকটা গভীর ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলেন যুদ্ধজয়ের দিনের ঘটনা নিয়ে, তিনি জেনারেলকে বেশ গম্ভীরভাবে বললেন, “কেউই নিয়তি খণ্ডাতে পারে না, স্যার।”
“তাই নাকি? কতটুকু সত্য এই কথাটি?” বলে জেনারেল প্রত্যুত্তর দিয়ে তার অধঃস্তন কর্মকর্তাটিকে সেই মুদ্রাটি দেখালেন। মুদ্রাটির উভয় পৃষ্ঠেই ‘মাথা’ অঙ্কিত।
রাগ নিয়ন্ত্রণ
এক জেন শিষ্য তার শিক্ষকের কাছে গিয়ে বলল, “আচার্য, আমি এক নিয়ন্ত্রণহীন মেজাজের অধিকারী হয়ে উঠেছি। আপনি কি আমাকে এ থেকে উত্তরণের পথ বাৎলে দিতে পারবেন?”
“হুম, এটা এক অবাক-করা কাণ্ড। তুমি কি তা আমাকে এখন দেখাতে পারবে?” গুরু জিজ্ঞেস করলেন।
“এখন পারব না।”
“কেন পারবে না?”
“এটা হঠাৎ ঘটে।”
“তাহলে এটি তোমার প্রকৃত স্বভাবের অংশ হতে পারে না”, আচার্য বললেন। “যদি তা-ই হতো, তাহলে তা দেখাতে তোমার জন্য কঠিন হতো না! যা-কিছু তোমার না সে সমস্ত বিষয়কে কেন তুমি নিজের দুশ্চিন্তার কারণ হওয়ার সুযোগ দাও?”
তারপরে, যখনই ছাত্রটির ক্রোধের জন্ম হতো তখনই তার সামনে গুরুর কথাগুলো ভেসে উঠত। শীঘ্রই সে তার ক্রোধ দমন করা ও শান্ত মেজাজ ধরে রাখার কৌশল আয়ত্ত করে ফেলল।
আপনি কি আমাকে আপনার অনুগত করতে পারবেন?
বিখ্যাত জেন আচার্য বাঁকেইর বাগ্মিতার জন্য বেশ সুনাম ছিল। সকল সম্প্রদায় ও শ্রেণির লোক তাঁর কথা শুনতে আসত। তার কারণ, তিনি তাঁর হৃদয় থেকে কথা বলতেন। বাঁকেই যেমন ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয়, তেমন তাঁর ধর্মদেশনা ছিল সর্বজননন্দিত।
বাঁকেইর এমন জনপ্রিয়তায় অন্য ধারার এক আচার্য খুব রেগে গেলেন। কারণ তাঁর অনুসারীরা দলে দলে তাঁকে ত্যাগ করে আচার্য বাঁকেইর নিকট যাচ্ছিল তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য। যাজক বেশ বিস্মিত হয়ে ভাবছিলেন, কী করে বাঁকেইর এত সমর্থক জুটল, সে তো পাণ্ডিত্যপূর্ণ শাস্ত্রীয় উদ্ধৃতি দেয় না! যাজক যতই তা ভাবছিলেন, ততই তাঁর ক্রোধ বাড়ছিল। এর এক বিহিত করার জন্য ঝড়োবেগে যাজক ছুটলেন মন্দিরের দিকে, যেখানে বাঁকেই দেশনা প্রদান করেন।
মন্দিরে পৌঁছা মাত্রই যাজক বাঁকেইকে বের হয়ে আসতে ডাক দিলেন।
“হে জেন আচার্য!” যাজক চিৎকার করে ডাক দিয়ে বললেন, “আপনি মনে করেন যে, ওই লোকদের মাঝে আপনার গ্রহণযোগ্যতা আছে, কারণ তারা আপনার কথা শুনতে আপনার কাছে চলে আসে। তারা আপনার অনুগত, কারণ তারা আপনাকে সম্মান করে; কিন্তু আমি আপনাকে সম্মান করি না।” বাঁকেইকে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “আপনার এত শক্তি! আমাকে আপনার অনুগত করার সামর্থ্য আছে আপনার? পারবেন অনুগত করতে?”
যাজকের রাগ দেখে বাঁকেই বেশ কৌতুক বোধ করলেন। প্রত্যুত্তরে বললেন, “প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে অবশ্যই আপনাকে আমার পাশে আসতে হবে।” গর্বিত যাজক ভীর ঠেলে বাঁকেইর আসনের দিকে গেলেন।
বাঁকেই তাঁকে বললেন, “আমার বামদিকে আসেন যাতে আমি আপনাকে ভালো করে দেখতে পারি।” যাজক বাঁকেইর বাম পাশে হেঁটে গেলেন।
“না, তা ভালো দেখাচ্ছে না! আপনি যদি আমার ডান পাশে থাকতেন তবেই তা শ্রেয় হতো”, বাঁকেই বললেন।
যাজক আবার জেন সাধুর ডান দিকে গেলেন।
বাঁকেই স্মিত হাসি দিয়ে বললেন, “দেখেছেন, আমি এখন আপনাকে যা যা বলেছি, আপনি তা তা করেছেন। আপনার এমন সুন্দর আচরণে আমার মনে হয়েছে আপনার মতো উন্নত স্বভাবের উদার লোকটি আর দ্বিতীয়টি নেই।”
যাজক তাঁর বাজে আচরণের জন্য লজ্জা পেলেন এবং বাঁকেইয়ের পাশে বসে পড়লেন উপদেশ শোনার জন্য।
আমিত্ব
ট্যাং রাজবংশের এক প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতা হিসেবে সাফল্যের জন্য জাতীয় বীর হিসেবে খ্যাত ছিলেন। কিন্তু তাঁর খ্যাতি, ক্ষমতা ও সম্পদ থাকা সত্ত্বেও, তিনি নিজেকে একজন নম্র ও শ্রদ্ধাশীল বৌদ্ধ বলে মনে করতেন। প্রায়ই তিনি তার প্রিয় জেনগুরুর অধীনে অধ্যয়ন করতে যেতেন এবং তাঁদের একত্র হওয়া বেশ ভালোই লাগত। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব এমন সম্পর্কের উপর বিন্দুমাত্র কোনও প্রভাব ফেলত না, বরং মনে হতো একজন সম্মানীয় গুরুর কাছে একজন শ্রদ্ধাবান ছাত্র মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করতে আসেন।
একদিন, তাঁর স্বাভাবিক ভ্রমণের সময়, প্রধানমন্ত্রী গুরুকে জিজ্ঞেস করলেন, “শ্রদ্ধেয় ভন্তে, বুদ্ধমতবাদ অনুযায়ী আমিত্ব কী?” গুরুর মুখটা লাল হয়ে গেল এবং খুব কর্কশ ও অপমানকর স্বরে বললেন, “কী ধরনের ফালতু প্রশ্ন এটি!?”
এই অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া প্রধানমন্ত্রীকে এতটাই হতাশ করে তুলেছিল যে এতে তাঁর মুখ কালো হয়ে গেল এবং ক্রোধে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। জেনগুরু তারপর হেসে বললেন, “মহামান্য, একেই বলে আমিত্ব।”
- কথাফুল অথবা ফুটন্ত ম্যাক্সিম ১ || জয়দেব কর - May 30, 2025
- ছুরির ডগায় মধু / শিন ইউন :: ভাষান্তর / জয়দেব কর - May 16, 2025
- মুক্তির পথে বুদ্ধ : অভাজনের ভাবনা || জয়দেব কর - May 11, 2025
COMMENTS