জসীম উদদীন ও জননীর স্মৃতি || মৃণাল সেন

জসীম উদদীন ও জননীর স্মৃতি || মৃণাল সেন

ঋত্বিকবাবু যেমন বাংলাদেশ বলতেই আকুল হয়ে উঠতেন আমি তেমন হই না, যদিও আমার জন্ম বাংলাদেশে। মানে বাংলাদেশ বলতেই আমি উত্তেজিত হয়ে উঠি না। তবে হ্যাঁ, একবার আমি বাংলাদেশকে অনুভব করেছিলাম খুব সাংঘাতিকভাবে। সেটা, সময়টা, আমার ঠিক মনে নেই, তবে মুক্তিযুদ্ধের পরে। কবি জসীম উদদীন এসেছিলেন কলকাতায়। তার আগে বলি, কবি জসীম উদদীন কিন্তু আমাদের পরিবারের অনেক পুরনো বন্ধু। মনে আছে, ছোটবেলায়, যখন তিনি কেবলই জসীম উদদীন, একটা কবিতা লিখেছিলেন, সেটা এনে বাবাকে দেখিয়েছিলাম। বাবা বললেন, — ছেলেটিকে ডেকে আনিস তো! বাবা তখন জসীম উদদীনকে বলেছিলেন, — কবিতাটি তো চমৎকার লিখেছ, কিন্তু এত বানান ভুল কেন? বানান শুদ্ধ করে লিখবে।

সেই থেকে শুরু। এরপর থেকে জসীম উদদীনের নিয়মিত যাতায়াত ছিল আমাদের বাড়িতে। আমরাও ওঁর বাড়িতে যেতাম। আত্মীয়তা জমে উঠল। পুজোপার্বণে যেমন জসীম উদদীন আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে আসতেন, তেমনি ঈদ-উৎসবেও ওঁদের বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন ছিল বাঁধা। আমার মা জসীম উদদীনকে খুবই স্নেহ করতেন। জসীম উদদীনও মাকে খুব ভালোবাসতেন এবং আমার মাকে মা বলেই ডাকতেন।

একবার, খুব সম্ভব পুজোর সময়, মা সবাইকে খেতে দিয়েছেন। আমরা সবাই রান্নাঘরে বসে খাচ্ছি আর জসীম উদদীনকে মা তাঁর নিজের ঘরে আসন পেতে খেতে দিয়েছেন। জসীম উদদীনের এটা ভালো লাগেনি। তিনি মাকে বললেন, — মা, আমিও তো তোমার একটা ছেলে, ওরা সবাই একসঙ্গে রান্নাঘরে খাচ্ছে আর আমাকে এখানে আলাদা করে খেতে দিলে কেন? মা তখন বললেন, আমি যদি তোমাকে ওদের সঙ্গে বসে খেতে দিই তাহলে কাল থেকে আর ঠাকুররা আমার রান্নাঘরে ঢুকবে না। তারচে এই তো ভালো, আমি নিজের হাতে বসে তোমাকে খাওয়াচ্ছি।

এরপর দেশভাগ হলো। আমরা ফরিদপুর থেকে কলকাতায় চলে এলাম। জসীম উদদীন তখন ঢাকায়। তারও অনেক পরে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার কিছু পরে জসীম উদদীন কলকাতায় এলেন কি-একটা ব্যাপারে। আমি তখন ছবির কাজে দিল্লিতে। আমার মা তখন খুবই অসুস্থ। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। তিনি কার কাছ থেকে যেন শুনলেন জসীম উদদীন কলকাতায় এসেছেন। ব্যস্, জসীম উদদীনকে তাঁর দেখা চাই-ই। আমার স্ত্রী তখন আমাকে ফোন করলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় চলে এলাম। আমার নিজেরও একটা আগ্রহ ছিল তাঁকে দেখার জন্য। কতদিন হলো দেখাসাক্ষাৎ নেই। এসেই ফোনে যোগাযোগ করলাম তাঁকে। তিনি বললেন, — মাকে আমার এক্ষুনি দেখা চাই। তুমি এক্ষুনি একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এসো, আমি তোমার সঙ্গে আসব।

ছুটলাম ট্যাক্সি নিয়ে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে নিয়ে ফিরে এলাম। আমার মা, যিনি নিজে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না, তিনি ট্যাক্সির শব্দ শুনেই ব্যাল্কোনিতে এসে দাঁড়ালেন। মৃদুভাবে শুকনো হাত নাড়লেন জসীম উদদীনের দিকে। জসীম উদদীনও তেমনি — গাড়ির জানালা দিয়ে শরীরের অর্ধেকটা বের করে — মাকে। এরপরে যে-ঘটনা ঘটল তা কখনো ভুলবার নয়। মা ব্যাল্কোনি থেকে এলোমেলো পায়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলেন। জসীম উদদীনও গাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে শুরু করলেন এবং সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় এসে দু-জনে দু-জনকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি শুধু শুনতে পেলাম, — ওরে জসীম, এসেছিস? উত্তরে জসীম উদদীনের আকুল-করা চিৎকার, — মা! এবং দু-জনের জড়িয়ে ধরে কান্না। এ-দৃশ্য ভোলা যায় না। তখন আমি খুব প্রচণ্ডভাবে অনুভব করলাম বাংলাদেশকে, কী আমি হারিয়ে এসেছি বাংলাদেশে!

গানপারটীকা
এই স্মৃতিখণ্ডটা আমরা নিয়েছি ইন্টার্ভিয়্যুভিত্তিক সুদীর্ঘ একটা লেখা থেকে। লেখাটা প্রায় পঞ্চাশপৃষ্ঠা লম্বা। মাহবুবুল আলম লিখেছেন ইন্টার্ভিয়্যুভিত্তিক অনুলিখিত রচনাটা, ছাপা আছে ‘ধ্রুপদী’ পঞ্চম সংকলনে। একঘেয়ে প্রশ্নমালার ছররা নয়, ইন্টার্ভিয়্যুটা আসলেই বিচিত্র গদ্যকৌশলে খচিত, ভূমিকা ছাড়াও রয়েছে প্রসঙ্গান্তরকালীন প্রয়োজনীয় সংযোজক অনুচ্ছেদগুচ্ছ, রয়েছে উত্তরকারীর দীর্ঘ মনোলগ-মতো বক্তব্য, ইত্যাদি। ভীষণ সুখপাঠ্য ও সম্পন্ন একটা পাঠোপকরণ। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে এই ইশ্যু ধ্রুপদী পাব্লিশড; সম্পাদক মুহম্মদ খসরু এবং সংযুক্ত সম্পাদক মাহবুবুল আলম, — উভয়েই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সংগঠক। এদেশে এখনও-অল্প-কলেবর চলচ্চিত্রসাহিত্যে এই ধ্রুপদী সংকলনগুলো অবদান রেখেছে ব্যাপক, বলতেই হবে, মুহম্মদ খসরুর নেতৃত্ব ও সাংগঠনিকতাও। ‘চলচ্চিত্রপত্র’ নামেও আরেকটি সিনেক্রিটিকম্যাগ সম্পাদনা করেছেন খসরু। আর, মৃণাল সেন? জসীম উদদীন? পরিচয় দেয়া আদৌ দরকার হবে কি? নিশ্চয় আমরা এই-রকম বিভিন্ন গ্রন্থ/রচনা থেকে উৎকলিত অংশ স্বতন্ত্র শিরোনামে এনে হাজির করব পাঠকের দহলিজে মাঝেমাঝে, যেন ফোকাস পড়ে একটা-কোনো উপজীব্য/প্রতিপাদ্যের উপর। অভিসন্ধি নাই বিশেষ এছাড়া।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you