[একই রক্তের বংশোদ্ভুত সংগীতশিল্পী হলেই যে একজন গাইয়ে-বাজিয়ে ঘরানাদার হয়ে যাবেন এমন কোনো কথা নাই। কিন্তু এই রচনায় এমন একটা ভ্রান্তি ঘটে গেছে দেখতে পাবো। অসুবিধা অল্পই অবশ্য, যদি মনে রাখি যে এইটা বাণিজ্যিক একটা বিনোদনপত্রিকার পাক্ষিক পাঠকখোরাক এবং এইখানে এই রিপোর্টে বাংলাদেশের সংগীতপরিবেশনাজাগতিক সেলিব্রেইটেড কয়েক পরিবারের পরম্পরা পাঠকসমক্ষে প্রেজেন্ট করা হতেছে। এইটা গত শতকের নিরানব্বই সনের প্রতিবেদন, কাজেই এখানে এই রিপোর্টে হালফিল ইনফো প্রত্যাশা করাটাও অতিশয় হবে।
এমনিতে এটিমোলোজি দিয়া ভাবলে দেখা যাবে যে ঠিকই আছে। কেননা ঘর থেকেই তো ঘরানা, আর ঘরানা থেকেই ঘরানাদার। কিন্তু শব্দগুলো/টার্মগুলো মুখ্যত প্রয়োগ হয় ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকে, যেইটাকে আমরা সাধারণত ধ্রুপদ বলি বা বলি হিন্দুস্তানী ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক, সেইখানেই ঘর-ঘরানা-ঘরানাদার কথাগুলো আকছার ব্যবহৃত হতে দেখব। লক্ষ করব যে সেখানে পিতার/মাতার/প্রপিতামহের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেদের পারিবারিক পরম্পরার বিশেষ একটা গায়ন/বাদন বহন করে নিয়ে চলেছেন সন্তানসন্ততি; যেমন আমরা বলি ‘গোয়ালিয়র ঘরানা’, ‘পাতিয়ালা ঘরানা’ … ইত্যাদি। কিন্তু ঘরের ভিতর সুরের/বাদনের সুদীর্ঘ পরম্পরা রেখেও অন্য ঘরের পানে আকৃষ্ট হয়েছেন এবং অন্য ঘরানাদার গুরুর কাছে যেয়ে নাড়া/গান্ডা বেঁধে ট্রেইন্ড-আপ্ হয়েছেন বা তালিম নিয়েছেন ও অন্তিমে সেই নিজগৃহবহির্ভূত ঘরানার নিশানবর্দার হয়েছেন এমন উদাহরণও দুর্নিরীক্ষ্য নয়।
কাজেই ‘ঘর’ শব্দ হইতে উৎপন্ন হলেও ‘ঘরানা’ শব্দটা ঘরছাড়ানোও বটে; অরিজিন থেকে প্রতিসরিত হয়ে সে ভিন্ন অর্থচিত্রই দ্যোতিত করে চলেছে প্র্যাক্টিক্যালি। কিন্তু প্রতিবেদকদ্বয় এখানে একেবারেই নায়্যিভ কনোটেশনে টার্মটা ব্যবহার করেছেন। একটা মারাত্মক ভ্রান্তি ঘটবার আশঙ্কা থাকিয়া যায় আরেকটা জায়গায়, সেইটে এ-ই যে, – ঘরানা ব্যাপারটার সঙ্গে রক্তসূত্র যতটা তারচেয়ে বেশি ডিসাইপ্যলসূত্র জড়িত; ঘর ও ঘরানা, গানে-বাদনে অন্তত, গুরু-শিষ্য সম্পর্কসংলগ্ন। পরিবারের পরম্পরা ব্যাপারটা ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকে বেহতর রয়েছে স্বীকার্য, তবে আক্ষরিক অর্থে ব্যাপারটা আগলবন্দি স্থিতাবস্থা ভাবলেই মুসিবত। অথচ বিনোদনবাণিজ্যের গানাবাজানায় স্ট্যাটাস-ক্যু প্রকট হয়ে থাকতে দেখেছি আমরা দশক-কাল আগেও, সমস্ত সেলিব্রেটিদের ছেলেমেয়ে-নাতিপুতি-ইয়ারবখশিই শিল্পীকলাকুশলী, বর্তমানের পরিস্থিতি রিপোর্টেড হয় নাই এখনও পর্যন্ত কোথাও।
তবে এই রিপোর্টপ্রতিম রচনাটা আমরা পাঠ করব স্রেফ বাংলাদেশের একটা-সময়-পর্যন্ত সংগীত (‘লঘু সংগীত’ টার্মটা ব্যবহার করেন অনেকেই এহেন ক্ষেত্রে, এই ব্যবহারের ভিতর দিয়া তারা তাদের আখাম্বা উচ্চম্মন্যতা জানান দেন শুধু) কয়েকটা পারিবারিক বলয়ের সেলিব্রেশন্যাল কার্নিভ্যাল ছিল কি না, আমাদের নিজেদের স্মৃতি নিযুক্ত করে ব্যাপারটা আরেকটু সম্প্রসারিতভাবে এক-সময় হাজির করব। বরং এখনকার গানবাজনা, ব্যান্ডসংগীত যদিও গোড়া থেকেই, বাংলাদেশজ রাজনীতির পরিবারতান্ত্রিক (অপ)অনুশীলনচক্রের বাইরে বেরোতে পেরেছে যে, এবং/বা আদৌ কতটুকু পেরেছে, এইসব হিসাবপত্রাদি কিতাবের পাতায় দেখবার সময় এসেছে বোধহয়।
সেইসঙ্গে এ-ও বলিয়া রাখা যাক যে বাংলাদেশের ও বাংলাবহির্ভূত দুনিয়ার গানবাজনার বিচিত্র ঘরানা নিয়া সুলুকসন্ধানী রচনার তালাশে ‘গানপার’ তার চিরুনি চালিয়ে চলেছে নিত্য। রক মিউজিকের হাজারেবিজারে ঘরানা, বাউলের এবং ফকির-ত্রুবাদুর-ডোমচাঁড়ালের গানঘরানা, ক্ল্যাসিক্যালের এবং ননক্ল্যাসিক্যালের বেশুমার ঘরানা নিয়া ‘গানপার’ ভালো/মন্দ উল্টাপাল্টা ঝাঁকানি-দেয়া লেখাপত্র সন্ধান করে চলেছে। পেসিমিস্টিক হবার কারণ নাই কোনো। যদি বাংলাদেশের গানের গতি কিছু হয় ইন-ফিউচার তো গানপারেরও হবে। একটু মন্থর হলেও গতি তো বস্তু মাত্রেই বিরাজে। লেখকদের সাড়া পেলে (এবং লেখাপ্রাপ্তির আশ্বাস সাপেক্ষে) ‘গানপার’ বিশ্বজোড়া বাংলা গানের গতি নিয়া আশায় তাঁবু গাড়তে গররাজি নয়।
নিচের এই লেখাটা আমরা ‘আনন্দভুবন’ তৃতীয় বর্ষ ২২-২৩ সংখ্যা (১৬ এপ্রিল ১৯৯৯, ৩ বৈশাখ ১৪০৬) থেকে নিতেছি। স্মৃতিময় আনন্দের হোক আমাদের যাবতীয় পড়াশোনা। – গানপার]
আগেকার মিউজিশিয়্যান মাপা হতো ঘরানা হিসেবে। সেইসব ঘরানার বংশতালিকা এক বিশাল ব্যাপার। এখনো সেবব ঘরানা আছে, বিখ্যাত ওস্তাদদের উত্তরসূরীরা গানবাজনাও করছেন নিয়মিত। কিন্তু আগেকার সেই জৌলুসটাই নেই।
বর্তমান বাংলাদেশের মিউজিকজগতে বেশকিছু খুদে ঘরানা সৃষ্টি হয়েছে, যারা বংশানুক্রমিক গান করছেন। কিন্তু এগুলো ঘরানা হিসেবে পরিচিতি পায়নি এখনো, হয়তো-বা পাবেও না। কেননা সেই ট্রেন্ডটাই আসলে উবে গেছে। তা না-হয় গেল, কিন্তু তাই বলে মিউজিশিয়্যানদের আত্মীয়তার ফিরিস্তি তো দেওয়া যায়।
লোকগীতিশিল্পী আব্বাসউদ্দিনের ছেলে মোস্তাফা জামান আব্বাসী ও মেয়ে ফেরদৌসী রহমান তো গান নিয়েই আছেন, আছেন নাতনি নাশিদ কামালও। মাহমুদুন্নবীর মেয়ে সামিনা চৌধুরী ও ফাহমিদা নবী এবং ছেলে পঞ্চম তিনজনই গান করেন। গান করেন লালনগীতিশিল্পী মনোয়ারা বেগমের তিন ছেলেমেয়ে – বাদশা বুলবুল, ডলি সায়ন্তনি, পলি সায়ন্তনি এবং নাতনী তানি। ফিরোজা বেগম ও কমল দাশগুপ্ত তো নজরুলসংগীতের প্রধান পরিবার। তাদের দুই ছেলে হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদ বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের জনপ্রিয় দুই ব্যক্তিত্ব। রুনা লায়লার বোন দিনা লায়লা এবং মেয়ে তানি লায়লাও গান করেন। নকিব খান, পিলু খান আর জিলু খান – এই তিনভাইও তো গান করেন। হ্যাপী আখান্দ, লাকী আখান্দ দুইভাইও আধুনিক গানের দুই কীর্তিমান। আজম খান আর আলম খানও দুই ভাই। এ-রকম দুই ভাইয়ের লিস্টিতে আরো আছেন ফান্টি-টন্টি, বিপ্লব-পল্লব, কমল-কনক, এবং সুবীর নন্দী ও তিমির নন্দী। শবনম মুশতারী আর ইয়াসমিন মুশতারীও দুই বোন। ভাইবোনের মধ্যে আছেন প্রবাল চৌধুরী ও নুমা খান। স্বামী-স্ত্রী আছেন – বোরহান সিদ্দিকী ও রেহানা সিদ্দিকী, চয়ন ইসলাম ও লিলি ইসলাম এবং সাজেদ আকবর ও সালমা আকবর।
পিতাপুত্র আছেন – ওস্তাদ বারিন মজুমদার ও বাপ্পা মজুমদার, সত্য সাহা ও ইমন সাহা, মনসুর আহমেদ ও মানাম আহমেদ, আব্দুল লাতিফ ও ফাইজুস সালেহীন এবং সোহরাব হোসেন ও খালিদ হোসেন। বাবা-মেয়ে আছেন – সৈয়দ আব্দুল হাদী ও তনিমা হাদী, মমতাজ আলী খান ও পিলু মমতাজ আর মা-মেয়ে আছেন খোশনুর আলমগীর ও আঁখি আলমগীর এবং জেবুন্নেসা জামান ও জিনাত রেহানা।
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS