আসামের বোড়ো অঞ্চল থেকে এসেছেন প্রদীপ মহন্ত।
সঙ্গে তার নিজের বানানো গোটা আঠারো মুখোশ। প্রদর্শনী চলছে লিটিল গ্যালারিতে। জায়গাটা হলো লেকমার্কেটের উল্টোদিকে। ট্রামরাস্তার ওপর।
এককথায় বলা যায় এই মুখোশের মেলা না দেখলে জীবন বৃথা।
এমনও বলা যায় আমরা দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্য যেসব মুখোশ পরে থাকি — ভদ্রতার, জ্ঞানের, মিথ্যা আনন্দের বা বানানো দুঃখের — সেগুলির প্রতিদ্বন্দ্বী এই ট্রাইবাল মুখসজ্জা।
এগুলি চামড়া, কাঠ ও নানা ধাতু দিয়ে তৈরি। ভাস্কর্যের মতো। অথচ ভাস্কর্য নয়। সুন্দর অথচ ভয়ঙ্কর। অস্বস্তিকর মনে হয়েছে কি? হ্যাঁ। মুখোশগুলি চুপ করে থাকে, তবু মনে হয় কিছু বলছে। এরা চক্ষুহীন অথচ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। এরা সেই জগতেরই লোক যেখানে জীবন শেষ হয়েছে অথচ মৃত্যু শুরু হয়নি। এরা জীবন্মৃত। এরা ধূসর।
এ-রকম নকশা প্রকৃতিতে তৈরি হয়।
গাছের বাকলে, মাঠের প্রান্তে পড়ে থাকা গোরুর কঙ্কাল-মাথায়, কসাইয়ের দোকানে সাজিয়ে রাখা কাটা ছাগল-করোটিতে। আমরাও এগুলো বানাতে পারতাম একদা। যখন আমরা ছিলাম প্রকৃতির সন্তান।
তখন আমাদের ছিল কুসংস্কার, ছিল ম্যাজিক, ছিল গভীরতর অন্ধকারের পর অত্যুজ্জ্বল দিন।
আজ আমাদের জীবন লেপা-মোছা। সবই যেন আলোয় আলোকময়। দশটা-পাঁচটা অফিস, ছেলেমেয়ের স্কুল কলেজ, ছুটিছাটায় দীঘা।
মধ্যে মধ্যে এসে পড়েন প্রদীপ মহন্তর মতো মানিক-পীর, ভূতের ওঝা, শতমুখ শাম্মান, আদি শিল্পী।
আমাদের চিকিৎসা হয়।
গানপারটীকা
এই ক্ষীণকায় নিবন্ধটা অ্যাজ্-ইট-ইজ্ পুনর্মুদ্রিত হলো উৎপলকুমার বসু ‘গদ্যসংগ্রহ ১’ থেকে। এইটা কবেকার লেখা তা না-বলতে পারলেও অনুমান হয় আশির দশকের শেষাশেষি কিংবা নব্বইয়ের শুরুদিকে লেখা, আমরা নিচ্ছি যেখান থেকে অর্থাৎ গদ্যসংগ্রহ প্রথম খণ্ডটা ‘নান্দীমুখ সংসদ’ ছাপিয়েছে কলকাতা থেকে ২০০৫ জানুয়ারিতে। দ্যাট মিন্স দুই দশকেরও উপরে হতে চলল চমৎকার এই নিবন্ধ ভূমিষ্ঠ হয়েছে। এখনও বৈশাখ এলে মুখোশশোভিত মঙ্গলমিছিল হয়, ‘এসো, মুখোশ’ রচনাটার পাঠস্মৃতি ইয়াদ হয়। এইবার তা গানপারে রেখে দেবার একটা ব্যবস্থা যা-হোক হলো। অল্প কতিপয় পাঠক যারা গানপারভ্রমণে রেগ্যুলার তাদের অনারে এই নিবন্ধ বৈশাখ ১৪২৫-এর বিশেষ উপহার বলা যায়। এমন স্বল্পভাষী নিবন্ধের শাদামাটা সাঙ্কেতিকতা, আড়ম্বরহীন এলিগ্যান্স, পাঠকের ভালো লাগবে নিশ্চয়।
ইন্তেকাল করেছেন উৎপল ২০১৫ অক্টোবরে। বেশ লম্বা হায়াৎ পেয়েছিলেন, পঁচাত্তর পুরায়ে গেছেন। কলকাতায় জন্ম ও ওখানেই জীবনাবসান। মধ্যিখানে লেখাবিরতি গিয়েছে একলপ্তে বছর-পনেরো, প্রবাসী ছিলেন দীর্ঘ এই লিখনবন্ধ্যাত্বকালে, অবশ্য সময়টাকে স্বেচ্ছাচয়িত রচনাবিরতিও বলেন কেউ কেউ। পরে ফের পুরো দমে লেখা শুরু করেছেন এবং একটানা লিখে গেছেন আমৃত্যু। কবিতা, গল্প, নিবন্ধপ্রবন্ধ, অনুবাদ। ইত্যাদি। কিন্তু কবিতাই লিখেছেন তিনি সবচেয়ে বেশি এবং বৈচিত্র্যে বেশভূষায়। তার কবিজীবন দীর্ঘায়ত হোক। হচ্ছেও; গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এবং পরবর্তী শতকের প্রথম দশকে বাংলাদেশে যে বিপুল কবিতাস্ফূর্তি তার উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে উৎপলেরই নির্দ্বন্দ্ব অনুকৃতি হয়েছে। এখন একেবারেই থিতিয়ে না-এলেও অল্পবিস্তর কমেছে।
এইখানে গৃহীত গদ্যটা তার সংগ্রহগ্রন্থের ২২০ সংখ্যাসূচক পৃষ্ঠায় আছে, ‘বিবিধ’ শীর্ষক অধ্যায়ের আওতায়, ফার্স্ট প্রিন্ট নান্দীমুখ সংসদ কলকাতা বইমেলা ২০০৫। গানপারের যারা পাঠক এবং যারা পাঠক-নন সকলেরই জীবন হোক শুভেচ্ছামুখর, বৈশাখে এইটুকু দোয়া।
… …
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
- আর্কের হাসান ও নব্বইয়ের বাংলা গান - January 23, 2025
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
COMMENTS