গিটারিস্টের কিংবা ভায়োলিনিস্ট/পিয়ানিস্টের একটা গ্রাহ্য পরিচিতি যেভাবে ঝটপট তৈরি হয়ে যায় আমাদের শ্রোতাসাধারণের লোকালয়ে, সেই সাপেক্ষে একজন ড্রামার অত সাততাড়াতাড়ি নিজের শ্রোতা-দর্শক পান না। তাকে অপেক্ষা করতে হয়, নিজের জাত চেনানোর জন্য ধৈর্য ধরতে হয়, বাজনাটা আয়ত্তে আনতে যেয়েও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় একজন ড্রামারকে। ব্যান্ডের সঙ্গীসাথী সবার পেছনে প্রায় আড়ালে থেকেই একজন ড্রামার তার কর্তব্য সমাধা করে চলেন অনেকটা ধ্যানস্থ মূর্তির আদলে। এবং বাদ্য পরিবেশনের সময় কেবল যন্ত্রে নয়, নিজের মধ্যেও যন্ত্রীকে একটা আবিলতাহীন ছন্দের দোলা জাগাতে হয়। কাজটা আদৌ সহজ নয়। এবং এই কাজ নয় সাধারণ সকলের উপযোগীও। প্রচুর এনার্জি, ফিজিক্যাল্ স্ট্যামিনা, ইংরেজিতে যেটাকে বলে ভিগ্যর, ড্রামারের মাস্ট-হ্যাভ বৈশিষ্ট্যগুলোর শীর্ষ।
অথচ যতটা কাঠখড় পুড়িয়ে এই রিদম-অবতার ড্রামারদের বেড়ে-ওঠা, বিকাশ বা নির্মিতি যা-ই বলি, ড্রামস্ বাজিয়ে আমাদের দেশে অ্যাক্নোলেজমেন্ট সেভাবে এখনও হয় না পাওয়া। কারোরই হয় না অবশ্য, কোনো যন্ত্রীরই হয় না, যন্ত্রশিল্পীরা আমাদের দেশে এখনও কণ্ঠশিল্পীদের সমান মর্যাদা পান না। ব্যান্ডসংগীতে বা হালজমানার ভাষায় আমাদের রকসিনে অবশ্য যন্ত্রশিল্পীরাও অবিসংবাদিত প্রসিদ্ধি অর্জন করছেন দেখতে পাই। দৃশ্যটা আনন্দের, আমাদের গোটা সাংগীতিক ভুবন উন্নয়নের জন্য এই দৃশ্যবদল অত্যন্ত শ্লাঘার। মানুষ এখন পৃথকভাবে একটা ড্রামসবিটও অ্যাপ্রিশিয়েইট করতে শিখছে। গিটারিস্টের তারিফ আর কদর তো বলা বাহুল্য।
নব্বইয়ের দশকে বেশ-কয়েকজন ড্রামার আমাদের দেশে তারকাখ্যাতি পান, যাদের মধ্যে ফান্টি ছিলেন, টন্টি ছিলেন, টিপু তো রয়েছেনই। ধারাবাহিকতাটা আরও বহুদিন বজায় ছিল। সম্প্রতি লক্ষ করছি ইন্সট্রুমেন্ট-মিউজিশিয়্যানদের নিয়ে সেভাবে কথাবার্তা সাধারণ সমাজে অ্যাবসেন্ট। অবশ্য সিঙ্গারদের নিয়েও রম্য ধাঁচের কিছু রচনাপ্রয়াস ছাড়া অ্যানালিটিক্যাল লেখাপত্র কই? কিন্তু যারা হার্ডকোর রকশ্রোতা, তারা ঠিকই মিউজিকের এবং ইন্সট্রুমেন্ট-আর্টিস্টের হক্ কদর করছেন। ট্রেন্ডটা বাড়ছে। ট্রেন্ডটা নিয়া আমরা আলবৎ আশান্বিত হব।
অতি সাম্প্রতিকের একজন ড্রামার নিয়ে এই নিবন্ধ রচনায় নীত হয়েছি। ইন্ ফিউচার ড্রামসশিল্পী ছাড়াও অন্যান্য দেশবিদেশের ইন্সট্রুমেন্টশিল্পী, যারা আমার প্রিয় ও প্রণম্য, সিরিজ্ আকারে এদের কয়েকজন নিয়ে লেখার জন্য সঙ্কল্প করেছি হৃদয়ে। দেখা যাক, সংশয়ে সঙ্কল্প টলে যায় কি না। আজকে একজন ড্রামার আমার এই নিবন্ধে হাজির হয়েছেন। আসুন, শিল্পীর সঙ্গে একটা আড্ডা মাতাই! কিন্তু, সংবিধিবদ্ধ জ্ঞাতব্য হয় এ-ই যে, অত্যন্ত প্রাথমিক কিছু তথ্যালাপ ছাড়া এই নিবন্ধে তেমনকিছু সংগীত পর্যালোচনা আমার সাধ্যাতীত আজও।
ছোটবেলা থেকেই তালবাদ্যের সাথে খেলতে খেলতে তালযন্ত্রের প্রতি অগাধ ভালোবাসা জন্মে এই বাদকের। পড়ার টেবিলে বসে লেখাপড়ার ফাঁকে এতটুকু ফুরসত পেলেই শুরু করে দিতেন তালের খেলা। স্বপ্ন দেখতেন একজন ড্রামার হওয়ার। পড়ালেখার শত চাপাচাপির মাঝে নিজের স্বপ্নকে স্থান দিয়েছেন যেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। বিশ্বাস ও নিজের ইচ্ছাকে ধরে রেখে এগোতে থাকেন এই শিল্পী।
এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই ড্রামস শেখার প্রস্তুতি শুরু হয়। প্রথমে টনিভাই ও পরে সাজুভাইয়ের কাছে ক্লাস নিতে থাকেন। দীর্ঘদিন একনাগাড়ে কঠোর পরিশ্রম করার পর গন্তব্য খুঁজে পান এই ড্রামার। ২০১১-তে যুক্ত হন ‘সেল্ফ-পোর্ট্রেট’ নামক একটা ব্যান্ডে। ড্রামসজীবনের সূচনা হয় এখান থেকেই। স্টেজ-পার্ফোর্ম্যান্স করার পাশাপাশি টিভিচ্যানেলেও লাইভ ড্রামস প্লে করতে থাকেন এই ড্রামার।
কার কথা বলছি? কে এই শিল্পী? তিনি ইকরামুল হক (Ekramul Hoque)। বর্তমান সময়ের একজন ড্রামস-আইডল। পাগল করার মতো বিটস্ দিয়ে দেহমন তুঙ্গে তুলে নিয়ে যেতে এই শিল্পীর জুড়ি নেই। নিজেকে প্র্যাক্টিসের মধ্য দিয়ে তৈরি করেন, গড়েপিটে নেন, নবায়ন করেন নিজেকেই প্রতিনিয়ত। মনে করেন, অনুশীলনেই নিহিত প্রতিভা। আর অধ্যবসায় দিয়ে জয় করা যায় যে-কোনোকিছু।
বুকে দৃঢ় সাহস আর নিজের ইচ্ছাশক্তিটুকু কাজে লাগিয়ে এই স্পন্দিত গতির শিল্পী ছুটতে থাকেন ড্রামসের স্টিক্স দুইহাতে ঝলসিয়ে। ড্রামসের দুন্দুভি বাজিয়ে যেতে চান তিনি আরও বহুদূর। তিনি তার নিজের প্রতিষ্ঠা-করা ড্রামসস্কুলে শিখনেচ্ছু ড্রামসশিক্ষার্থীদের নিয়মিত ড্রামস শিখিয়ে চলেছেন।
… …
- এরেবাস বাই অমম || প্রান্তর চৌধুরী - November 24, 2024
- ঐরাবত ঐ আসছে… || প্রান্তর চৌধুরী - November 20, 2024
- আমার ড্রামার || প্রান্তর চৌধুরী - December 27, 2017
COMMENTS