ইচ্ছেঘুড়ি || শিরোনামহীন

ইচ্ছেঘুড়ি || শিরোনামহীন

[বাংলাদেশের ব্যান্ডধারা (বা বলা ভালো রকধারা) গানের গীতিভাগ সবসময় যেন পাঠকের অবহেলা পেয়ে এসেছে, হেলায়ফেলায় দেখা হয়েছে এই গীতাখ্য, কেবল পাঠকের উপেক্ষা হলে তেমন দুশ্চিন্তার কিছুই ছিল না, এমন বোধহয় ভাবলে বেশি হবে না যে এইধারা গানের গীতিকারেরাও বেখেয়ালে গান বেঁধে গেছেন বহুকাল। ফলে ব্যান্ডের গান সুরের পাখনা ছেঁটে কেবল পাঠবস্তু হিশেবে পড়তে যেয়ে হোঁচট খেতে হয় পদে পদে। একই গীতিভাগের কথা সাংগীতিক আবহে শুনতে কিন্তু কোথাও আটকায় না, বরং উৎরেই যায় বেশিরভাগ সময়। বেখেয়াল যারই হোক, গানলেখকের তরফে কিংবা গানপাঠকের তরফে, বহুদিন ধরে ব্যান্ডগানে এই দুর্ঘট লক্ষ করা যায় বিরাজ করছে। এর কিছু নগদ ফলও অবশ্য লভেছি আমরা, কাব্যিকতা হাজির রেখেও কবিতা-আঁটোসাঁটো কনভেনশন ভেঙে এক্সপ্রেসিভ একটা গানকাণ্ড সহস্রবর্ষ প্রথাঋদ্ধ বঙ্গে ব্যান্ডগানের দৌলতে এসেছে এখনও অনেকেই যা আমলে নিচ্ছেন না, প্রাকরণিক আপোসের পাশাপাশি কিছু মুক্তডানা ব্যঞ্জনাও জন্ম নিয়েছে এই লিরিকের মধ্যস্থতায়। এইসব নিয়া আমরা ‘গানপার’ থেকে সম্ভাব্য সমস্ত কৌণিক বোঝাপড়া চালাতে চাই। দেখতে চাই, এবং দেখাতেও চাই তো বটে, পদ্য বা পোয়েট্রি আর গান বা গীতি ঠিক কোন পয়েন্টে যেয়ে লেনাদেনা-মেলামেশা চালাতে পারে; এও বলতে চাই জোরেশোরে যে কবিতাসাদৃশ্য কম হবার বরাতে ব্যান্ডগানে আপনাআপনি কিছু অভাবিত অর্জন জুটেছে। সেসব ক্রমে দেখব এবং লিখব আমরা সবাই মিলেই, এই গানপারে, ডিমেরিট এবং মেরিট দুইদিকেই নজর রেখে। এই দীর্ঘপ্রসারী নিশানার দেখাশোনাজানাবোঝার ক্ষেত্র তৈয়ারে আমরা ব্যান্ডগানের গীতিভাগ চোখের সামনে রাখতে চাই। এবং চাই ইনফ্লুয়েনশিয়্যাল ব্যান্ডগুলোর গানকথা ধারাবাহিক যত্নে এইখানে ছেপে রেখে যেতে। এরই অংশ হিশেবে এইখানে বাংলাদেশের মেধাদীপ্ত সংগীতরচয়িতা ব্যান্ড ‘শিরোনামহীন’ তথা তাদের অত্যন্ত শ্রোতাপ্রিয় ‘ইচ্ছেঘুড়ি’ অ্যালবামের গীতিলেখাগুলো পরপর পড়ার জন্য রইল। কোন গানের গীতিকার কে, কিংবা কারা/কে সুরকার কোনটার, এইসব তথ্য উহ্য রেখে যাওয়া গেল বর্তমান সংকলনে। নেক্সট কোনো সংকলনে ভিন্ন অভিপ্রায়ের প্রয়োজনে অ্যালবামের খুঁটিনাটি ইনফো উপস্থাপন করা যাবে নিশ্চয়। কেবল এইটুকু মনে রাখা যাক আপাতত যে অ্যালবামের যাবতীয় কথা, সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন তুহিন, জিয়া, ফারহান ও তুষার — এই চারজনে মিলে; এককভাবে কখনো, অথবা ব্যান্ড মিলে কখনোসখনো।

পড়ি শিরোনামহীন ব্যান্ডের ইচ্ছেঘুড়ি অ্যালবামখানা। — গানপার]

বরষা

বরষা মানে না
ঝরছে জলধারা
জানি না, জানি না — কাটবে কি ঘনঘটা।

অনুনয় মানে না
অবারিত মনকথা,
জানি না, জানি না — থামবে কি ঘনঘটা॥

নিরিঝর গগনে, অপলক চেয়ে রই
বিস্মৃত কবিতা, আনকা পবনে —
মেঘলা কবেকার স্মৃতিময় বাতায়ন
বলে যায় “তোমায় আনব ভালবাসি”॥

দীপিকা সায়রে, অনিমেষ চেয়ে রই
মিথিলা বরষা, অলোক দহনে —
মেঘলা কবেকার স্মৃতিময় বাতায়ন
বলে যায় “তোমায় আনব ভালবাসি”॥

বরষা মানে না
ঝরছে জলধারা …

পাখি
একা পাখি বসে আছে শহুরে দেয়ালে
শিস দিয়ে গান গায় ধূসর খেয়ালে
ফেলে-যাওয়া আনমনা শিস, এই শহরের সব রাস্তায়
ধোঁয়াটে বাতাসে, নালিশ রেখে যায়॥

আমি দেখিনি আমি শুনিনি আমি বলিনি অনেককিছু
জানিনি আমি বুঝিনি তবু ছুটেছি তোমার পিছু

আনমনা বসে দেয়ালে, পাখি নির্বাক চোখ রাস্তায়,
ধোঁয়াটে শহরের উষ্ণতা বাড়ে না,
আনমনা চোখ অবুঝ চোখ মনের দরজায় আঙুল রাখে না
কিছু সুর তুমি এনে দাও পাখি নাগরিক কোলাহলে
গান গাও, তুমি শিস দাও, এই শহুরে দেয়ালে
ভুলে যাও এই শহরের যত ব্যস্ত জনকথা
আমি এসেছি তোমার কাছে এনে দাও স্বাধীনতা

দেখিনি আমি শুনিনি আমি বলিনি অনেককিছু
জানিনি আমি বুঝিনি তবু ছুটেছি তোমার পিছু
আমি দেখিনি আমি শুনিনি আমি বলিনি অনেককিছু
আমি জানিনি আমি বুঝিনি তবু ছুটেছি তোমার পিছু॥

ক্যাফেটেরিয়া
পড়ন্ত বিকেল…ক্যাফেটেরিয়া…উঁকি দিয়ে দেখি, —
এক কাপ চা, গরম তৃষ্ণায়
অজস্র এলোমেলো শব্দের ভিড়ে
তোমার শীতল চোখ ভিজিয়ে যায় আমায়।
যেখানে তোমার ঠোঁট ভালোবাসা
আমি বুড়ো কবিতার মতো চুপচাপ।
যেখানে তোমার চোখ খুনী
আর আমি খুন হই প্রতিদিন।

স্বদেশ
বলেছিলে তুমি আমায়
“এসো, নাও নূতন ভোরের আলো”
দিয়েছিলে শতাব্দীর অবগাহন,
এক মুক্ত সময়ের আহ্বান।

বলেছিলে তুমি আমায়
“জাগো, শোনো আমার কণ্ঠনিষাদ”
দিয়েছিলে অভ্র কোনো দিনে
রোদগন্ধমাখা জীবন।
বলেছিলে “অপেক্ষা করো, জেনো কাটবেই কৃষ্ণপ্রহর”

তবু জেগে দেখি কাঁদছে মানুষ পুড়ছে আমার স্বদেশ।
আর-একটিবার তোমায় দেখতে চাই, দেখতে চাই॥

জেনে রেখো অন্ধকার কোন কালে হারিয়েছি আমার অতীত
কবে পাবো অর্থময় নীরবতা, কবে আসবে স্বাধীনতা
কবে পাবো নীরজা তোমায়, আসবে আলোক প্রহর —
তবু জেগে দেখি কাঁদছে মানুষ পুড়ছে আমার স্বদেশ
আর-একটিবার তোমায় দেখতে চাই, দেখতে চাই॥

আঁধারভাঙা স্বপ্ন হতে জাগাই (তুমি) আসবে বলে মহাকাল স্তব্ধ
কাদের তরে (আমার) বাঁচা আমার লড়াই
এখনো তোমার প্রিয়মুখ আমায় বাঁচায়

জানি মুক্তি তোমাতে॥

ভবঘুরে ঝড়
চৌরাস্তার উঁচু ল্যাম্পপোস্ট ছাড়িয়ে,
নিঃশ্বাস নিয়ে একটু দাঁড়িয়ে
চারিপাশে বিমূর্ত রেখায়, আমি,
ভবঘুরে ঝড়, তোমাদের খুব কাছে
ছায়া হয়ে যাই,
তোমাদের ভালোবাসা …

শনশন উত্তাল হাওয়ায়,
চৌরাস্তার ল্যাম্পপোস্ট হাঁপায়
এককাপ গরম চায়ে,
আমি, ভবঘুরে ঝড়,
তোমাদের খুব কাছে
ভিজে একাকার,
তোমাদের ভালোবাসা …

কখনো তোমাদের অজানা জানায়
বাউণ্ডুলে ঝড় আমায় ভাবায়…
তোমাদের ছায়ায়,
নির্বাক ভালোবাসা
আমি আজন্ম ভবঘুরে …

ঝড় নিয়ে আসি॥

রূপসী নগর
আবার হবে দেখা,
তোমাদের এই অচিন নগরে
সহসা ধূসর ধুলোর ভিড়ে
অচেনা রূপসী নগরে …
আবার হতে পারে দেখা॥

আবার হবে কথা,
অনেকের এই প্রিয় নগরে
অনেক হারাবার প্রান্তরে
অজানা রূপসী নগরে …
আবার হতে পারে দেখা॥

রূপসী উষ্ণ এ-পথে,
নির্বাক সব কথার ভিড়ে
ধুলোয়-ধুলো প্রান্তরে,
দেখা আবার হতে পারে
হেঁটে যাই আমি।

ধূসর ছাড়িয়ে
দেখা হবে সবুজ আশায় …

নিঃসঙ্গ
দীর্ঘশ্বাস তোমার রুক্ষ দেয়াল ছুঁয়ে
বিবর্ণ রাত্রি কাটে বিমূর্ত সময়
প্রার্থনা তোমার হারিয়ে যায় অন্ধকারে
স্তব্ধ এই বদ্ধঘরে অস্পষ্ট স্বরে;
নিঃসঙ্গ একা তুমি
ক্লান্ত … জীর্ণ তুমি
অন্ধ দেয়াল জুড়ে
দুঃস্বপ্ন আছড়ে পড়ে॥

পারবে কি ভেঙে দিতে এই দেয়াল?
পারবে কি ছিঁড়ে যেতে এই বাঁধন?
ধুলোমাখা জানালার আলো ছাড়িয়ে
পারবে কি ফিরে যেতে আবার।

আর্তনাদ তোমার বিদগ্ধ এ-মন জুড়ে
প্রতিধ্বনি করে তবুও চুপিসারে
স্বপ্নগুলো কেন জড়িয়ে যায় এ-মায়াজালে
দুঃসহ যন্ত্রণাতে, অশান্ত ঝড়ে
অন্য কেউ
আমি না, অন্য কেউ নিয়ে যায় তোমায়
যেখানে অবিরত ভেঙে পড়ে সময়;
আমি না অন্য কেউ নীরবে বাঁচে
রক্তসিঁদুর আঁকে যেথা নবআশা;
আমি না অন্য কেউ নিয়ে যায়
আমার কণ্ঠ হতে প্রতিবাদপ্রলয়।

তুমি না অন্য কেউ মোর শয্যাতে
জেগে দেখি পুবকোণে তমসা ক্ষয়
তুমি না অন্য কেউ ফিরে আসে
আর ডেকে তোলে বৃত্তবন্দী মন।

সঙ্গী তুমি সোনালি ভোরে অজানা কোনো আলো
আলোয় ভরা আনন্দলোকে নিঃস্ব প্রাতে চলো
তবু জেগে ওঠো বেঁচে ওঠো গেয়ে ওঠো আমার এ-গান —
তুমি না অন্য কেউ শিয়রে কাঁদে,
অধরা ছায়া শূন্যমাঝে ভেঙে পড়ে
তুমি না অন্য কেউ মেলে দেয়
ভোরের আকাশ সোনালিডানা চিল
যাবে কি তুমি মোর সাথে?
আকাশ উর্ধ্বে ঐ নীলমাঝে,
(যেথা) অন্ধবিশ্ব খোঁজে তোমাকে
যাবে কি তুমি মোর সাথে?
অনেক আশা নিয়ে
অনেক সবুজের প্রান্তে তুমি থাকো একাকী
আমি ধূসর, ধূসর হয়ে জেগে থাকি।
অনেক মানুষের ভিড়েও তুমি থাকো একাকী
আমি অনেক আশা নিয়ে বসে থাকি॥

হেরে যেতে যেতে যদি থমকে,
একনিঃশ্বাসে সব পেরিয়ে রোদঝলমল এক দুপুরে,
যদি ঘুম সবঘুম ভেঙে যায়
আমি অনেক আশা নিয়ে জেগে থাকি॥

দরোজার বাইরে রঙিন পৃথিবী,
ধুলো-ধুলোমাখা দাঁড়িয়ে আছে
ঝড়ের আশায় তোমার শহরে,
শিরোনামহীন ফুটপাত ঘুমিয়ে গেছে॥

একদিন এই ঝড়, তোমার এই শহরে
ভেঙে যায় সব জানালা তবুও আমি বসে আছি।
অনেক মানুষের ভিড়েও তুমি থাকো একাকী।
আমি অনেক আশা নিয়ে জেগে থাকি॥

ইচ্ছেঘুড়ি
এই হাওয়ায় ওড়াও তুমি তোমার যত ইচ্ছেঘুড়ি
চুপিচুপি মেঘের মেলা তোমার আকাশ করছে চুরি
সূর্যে বসাও আকাশের নীল ইচ্ছের রঙ গোলাপী হলে
দিগন্তরেখায় সূর্য নামে, ব্যস্ত সময় যাচ্ছে চলে॥

হঠাৎ খেয়ালী এ-ঝড়োহাওয়ায়,
উড়ছে তোমার ইচ্ছেঘুড়ি
ওড়াও ওড়াও সুতোর টানে,
আকাশের নীল যাচ্ছে চুরি॥

শুভ্র সেই মেঘের ভিড়ে তোমার সব ইচ্ছে ওড়ে॥
আকাশ খেয়ালী মনে হারায় কিছুই না-জেনে॥

তোমার সুতোয় বাঁধা আকাশ,
ঝড়ো হাওয়ায় তার রঙ হারালে
নির্বাক ইচ্ছে আচমকা দিশেহারা …

এই আলোয় হাঁটছো একা
সঙ্গী করো আমায় তুমি॥
বেয়াড়া যত মেঘের ছায়া
করছে চুরি স্বপ্নভূমি

নীলের আকাশ গোলাপী হলে ইচ্ছেঘুড়ি যাচ্ছে চলে
সুতোয় বাঁধা ছাড়িয়ে আকাশ অন্যভুবন দেখবে বলে॥

হঠাৎ খেয়ালী এ-ঝড়োহাওয়ায়
ভাঙছে তোমার মেঘলা রেখা
ওড়াও ওড়াও সুতোর টানে
আকাশ আবার হবে যে দেখা

দ্বিতীয় জীবন
অদৃশ্য চাদরে দিগন্তরেখায় বসে আছে সে,
অসংখ্য অনাবিল পথ পেরিয়ে আশার স্মৃতির ভিড়ে —
রূপালি চাঁদের আলোয় জড়িয়ে-থাকা সেই পিচঢালা পথ,
বিষণ্ণ চারিধার, ছড়িয়ে-থাকা মৃদু কুয়াশা —
বিষণ্ণ ধোঁয়াশার ধূসর স্মৃতি ঘিরে আছে তাকে,
আঁধার লহরীর নীল সাজানো আকাশ ছুঁয়ে
জোছনাভাঙা বালুচরে হারিয়ে যাওয়া,
মনে পড়ে যায় ফেলে-আসা পথ পেরিয়ে সোনালি প্রহর
তবুও সবুজ পথ পেরিয়ে, অসীম ছায়াপথ নিমেষে ছাড়িয়ে,
অবাক বিস্ময়ে।

জীবনস্মৃতি যেন এলোমেলো হয়ে উড়ে যায় একই পলকে,
একই নিমেষে
তোমায় স্বাগত জানাই, ঝরাপাতার মতো সন্ধ্যায়,
আলোময় বিচরণ, দ্বিতীয় জীবন,
ছায়াময় মননে, অবাক নয়নে,
ছায়া সুনিবিড়, বিস্ময়ে দেখি,
দ্বিতীয় জীবন, দ্বিতীয় জীবন॥

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you