হুট করে এমন বলার দরকার কী!—গানময় এক সংবেদনশীল বাংলাদেশ? কোলে-বুকে-পিঠে-মাথায় গানঘোর অবস্থা নিয়েই তো কাটে শৈশব-যৌবন-বার্ধক্যের দিনগুলো। গানের আশেপাশের ক্রিয়া—খেলাধুলা, পড়াশোনা, সাঁতারকাটা, গাছেচড়া, নৌকাবাওয়া, মাছধরা, কৃষিকাজ ইত্যাদি। কিন্তু এ কোন সময়! দ্রুত ছিন্নবিচ্ছিন্ন, তছনছ হয়ে যাচ্ছে সব, নাই হয়ে যাচ্ছে। উঠানগুলো বিভাজিত হতে হতে আরও একা হয়ে যাচ্ছি আমরা। সঙ্গ ও সংঘ দারুণ বৈরী, প্রচণ্ড অবিশ্বাস!
এককথায় যদি বলা হয় কেন এমন—বলা যেতে পারে কৃষিভিত্তিক যে সমাজব্যবস্থা তার মূল সৃজনের, সহজের জায়গাটিতে তেমন কেউ নেই। খাদ্যশস্য, জল-স্থল উভয় জায়গার স্থানীয় উৎপাদনপ্রক্রিয়া, মজুদকরণ, বিপণনজাত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পিত নয়। একটা উদার, সামনেকার স্থায়িত্বশীল যে পরিকল্পনা—তা আমাদের নেই। এর থেকে ভয়ানক, দুর্ভাগ্যের কী হতে পারে!
বাংলাদেশ কি সত্যিই গানে আছে? সুকুমারবৃত্তির চর্চা, বিজ্ঞানচর্চা, খেলাধুলা? গ্রামে গ্রামে কিংবা শহরে আগের মতো কী গান হয়! বছরে কয়টা নতুন বাংলা গান পাওয়া যায়? এই যে অতশত সংগঠন, কয়টা নতুন গান আসে সাংগঠনিক, রাষ্ট্রীয় উৎসাহ-উদ্দীপনা, সহযোগিতা থেকে? যদিও প্রতিষ্ঠান, সংগঠনকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই তবু সৃজনকর্ম, সংঘশক্তির মৌলিকতা কোথায়—এই জিজ্ঞাসা করাই যায়।
আমার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগরের কামাউড়া গ্রামে। ঘোড়াডুবা হাওরপারে। এইভাবে যদি বলা যায় নাওয়ের গলই ডুবে-ডুবে কূল পায়। ডুবে না ভাসলেও কিছু করার নেই। অর্থাৎ এক দিশেহারা পাহাড়সমান অভিশাপ বয়েবয়ে লোকেরা বসত করে। যোগাযোগে বর্ষায় নাও হেমন্তে পাও। তবুও দেখেছি সন্তান জন্মদান, স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক মৃত্যুক্রিয়ার মাঝখানে জীবনব্যাপী প্রায় সব আনুষ্ঠানিকতায় গান থাকত। থাকত প্রতি ঋতুতেই নানান আয়োজন-অনুষঙ্গ।
বর্তমানে এই গানময় জীবনাচার থেকে মানুষজন অনেকটা দূরে। এই সময়ের প্রেক্ষাপটে টিকে থাকার নানাদিক থেকে আর্থিক টানাপোড়েন তো রয়েছে তার মধ্যে রাজনীতি, ধর্মের নামে কতিপয় লোকের প্রভাববিস্তার, ভীতি ছড়ানো, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার হুঙ্কার সব অনুর্বর করে দিচ্ছে। অপরিকল্পিত বাঁধ, অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে বাস্তবিক অর্থে মাটিও হারাচ্ছে স্বকীয়তা। গোয়াল, ফল-ফুল, সুষমাশূন্য মাটির মানুষ চলে যাচ্ছে নানাদিকে। যে নদী ধুয়েমুছে স্বচ্ছ, তৃণ-উদ্ভিদ-প্রাণীকে সাবলীল করে দেয়, অপার সৌন্দর্যের জীবনকে মহিমান্বিত করে, বেড়ে ওঠার আশ্রয় দেয় খাদ্যশস্যের মাতৃহৃদয়—তার কতটা খবর, শুশ্রুষা আমরা নিয়েছি, দিয়েছি? ক্রমে বিভাজিত, ছোট হতে হতে আমরা ভুলে যাচ্ছি ব্যক্তিমানুষের যেমন উৎসবের প্রয়োজন হয় তেমনি সমষ্টিগত মিলন-উৎসবও প্রয়োজন। উৎসব তো ছোট গণ্ডির বিষয় নয় তাই সবাইকে নিয়েই তার আসল সৌন্দর্য।
বহুজাতিক কোম্পানি, সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান গানবাজনার আসরের ব্যাপ্তি এত ব্যয়বহুল এক ধামাকার জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে যে ছোট ছোট সাধারণ অনুষ্ঠানগুলো আর তেমন আয়োজিত হয় না। রাজনৈতিক, ধর্মীয় আবহ আগ্রাসনের বিপরীতে ছোট আয়োজনের সংগঠকরা নিরুপায়। স্বতন্ত্র, ছোট আয়োজনের বিপরীতে অনেক রকমের জবাবদিহিতা, হেনস্তার শিকার হতে হয়। কে আর চায় বারেবারে হেনস্তা হতে! আর বর্ণিল সব আন্তর্জালিক আধিপত্য তো রয়েছেই। শিল্পীকে সরাসরি দেখে গানশোনার ব্যাপারটা অনেকটা নাই হয়ে গেছে। গান কি কেবল দেখা, শোনার বিষয়, শিল্পীর চলন-বলন, দৈহিক ভাষ্য-প্রতিভাষ্যের আর কিছু কি নেই? গোটাকয়েক শ্রোতার সামনে, জনসমুদ্রের তরঙ্গে সার্বিক মানুষটার, শিল্পীর, শিল্পের, ঘুম-নির্ঘুম থাকার প্রাণদ রসদ ব্যঞ্জনার কী কোনো খবর রাখতে, জানতে হয় না?
সরাসরি যেন মানুষ গান শোনে, নিখিল সমাজের যে চলা—এই প্রেক্ষাপটে পুরোটা সম্ভব না হলেও যতটুকু ঐক্যবদ্ধ, দলীয়ভাবে, অর্থাৎ সমাজ বলতে যা বোঝায় তার আদলে সহজে আনন্দময়, শিক্ষণীয় চলার একটা আকাঙ্ক্ষা ধরে রাখতেই হয়। শুধু ভাবনাতে নয়, পাড়াগাঁ, শহর, মাঠে-ময়দানেও।
২০০৯ সাল থেকে এমন একটি কাজ আমরা শুরু করেছি। গ্রামে-গঞ্জে গান। বাংলাদেশের বেশকিছু জেলা শহরে, গ্রামেগ্রামে ‘যাত্রাপথে আনন্দগান মেঠোসুর’ কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর প্রশংসা পাচ্ছি। বাউলশিল্পী, পরিবেশকর্মী, সংগঠক, লেখক, সাংবাদিক যে যেভাবে পারেন আমাদের সময়-সঙ্গ কখনো কখনো অর্থসহায়তাও দিচ্ছেন।
শহরে কোনোরকমে সংসার চালানো নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান, যারা বাড়তি অর্থব্যয় করে ঘুরতে যেতে পারে না এমনসব শিশুকিশোরদের গাড়িতে করে দূরে কোথাও নিয়ে ষড়ঋতু দেখানো কার্যক্রম ‘ঋতুবীক্ষণ’ উদ্দীপিত অভিভাবকদের মনে ইতিমধ্যে সংবেদনের সঞ্চার করছে। আপ্লুত সন্তানেরা। মাতাপিতারাও সন্তানের এমন আনন্দে উদ্বেলিত। কোনো-এক চা-বাগানের পাহাড়ি শিশুটি হয়তো জীবনে নদী দেখেনি। কোনো-এক হাওরের, সমতলের সন্তান হয়তো পাহাড় দেখেনি। আমাদের উদ্যোগের কারণে সিলেট শহরে, শহরের বাইরে সমবেতভাবে দেখছে তারা নদী—মাঠ—পাহাড়—সূর্য—আকাশ—চন্দ্রভেষজ—সমতল—সন্ধ্যাতারা। কিছুকিছু মানুষ ভীষণভাবে চাইছেন এইসব উদ্যোগ, আনন্দধারা, শিশুকিশোরদের সাথে আমাদের পারস্পরিক মননঋদ্ধি, আনন্দের লেনাদেনা অব্যাহত রাখতে। বয়স্করাও এসে যোগ দিচ্ছেন নানাভাবে। মনে তাগিদ তৈরি হচ্ছে ঐতিহ্য-ঐশ্বর্যের গতরে সমকালীন সৃজন আনন্দ যোগ করার।
জ্ঞান-শ্রম-সত্য-ঐক্য-আনন্দে যুক্ত থাকলে সংবেদনশীল এক বাংলাদেশকে আমরা পেতে পারি। গানময় বাংলাদেশকে যদি আবার ফেরানো যায়, এই ভাবনায় নিরন্তর ছুটে চলা—‘যাত্রাপথে আনন্দগান মেঠোসুর’ নামে নিজেদের, বন্ধুরপথ সুবর্ণ গায়ে-গঞ্জে।
‘যাত্রাপথে আনন্দগান মেঠোসুর’ কার্যক্রম শুধু বাংলাদেশে নয় ভারতেও বেশকিছু জায়গায় পরিচালিত হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও হবে হয়তো। এর পরিসর, আঙ্গিকযাত্রায় যোগ হচ্ছে নতুন কিছু, নতুন নতুন স্বপ্নিল মুখ। যেটুকু সৃজনের, সুন্দরের—তা সানন্দচিত্তে গ্রহণ করছি আমরা। বলা যায়—একটা নিরন্তর নিরীক্ষা নিজেদের মধ্যে চলছে।
ফেইসবুকে মেঠোসুর
ইউটিউবে মেঠোসুর
- মেঠোসুর কলরব : আবহমানের উৎসব || রূপকার - May 17, 2025
- মেঠোসুর আনন্দযাত্রা : গানময় এক সংবেদনশীল বাংলাদেশ || বিমান তালুকদার - May 9, 2025
- মাড়া || সুশান্ত দাস - May 3, 2025
COMMENTS