একটা অনুষ্ঠানে গানের পর একজন (যিনি একটি গণসংগীতের দলের সঙ্গে যুক্ত) আমাকে খুব প্রশংসা করে বললেন, আপনি তো দেখছি একাই গণসংগীত করেন। উনি বোঝাতে চেয়েছিলেন আমি একাই সমবেতভাবে যে গণসংগীত গাওয়া হয় তার আবেদন পৌঁছে দিতে পারি, আর কোনো লোকের দরকার হয় না। তার মানে তাঁর ধারণায় গণসংগীত মানেই একটি গানের দল।
আসলে ‘গণ’ কথাটা ‘সংগীত’ শব্দের আগে থাকার ফলে ‘অনেকের গান’ এ-চিন্তাটা দানা বাঁধতে পারে। গণসংগীত নিশ্চয়ই জনগণের গান, অনেকের গান বা অনেকের জন্য গান — কিন্তু তা যে সবসময়ই অনেকের দ্বারা গীত হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ওমর শেখের গান শুনেছি — আও নয়া তরানা গাউঁ, একাই তো গেয়েছেন। সুরেশদা, নূর মহম্মদ, মেঘনাদ, দিলীপ বাগচিও একা গান গেয়েছেন।
আমি মুখ্যত একাই গাই। কয়েকবার SOPA-র অনুষ্ঠানে সমবেত গানে লিড দিয়েছি ঠিকই। আমি নিজে একক গানেই স্বচ্ছন্দ। কারণ একক গানে অনুভব সঞ্চারের জন্য এমনকিছু কাজ করতে পারি, যা সমবেত গানে শোনানো সম্ভব নয়। গানকে কখনও কথার কাছাকাছি নিয়ে আসা, নাটকীয়তার প্রয়োজনে সামান্য বিরতি, গানের মধ্যে কথা বলে আবার গানে ফিরে আসা, কথার প্রয়োজনে সামান্য হেরফের করা (voice inflexion), আওয়াজের হেরফের, কণ্ঠের মডিউলেশন (modulation) — এবং আমি যেটা করি, সারা শরীর দিয়ে গান করা — তা সমবেত গানে সম্ভব হতো না।
নীতিশের কাছে শুনেছি, আমার সুরে একটি দাঙ্গাবিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে ‘কি আমাদের জাত’ তালবদ্ধভাবে সারাপথ গেয়ে এসপ্ল্যানেডে আসার পরও অনেক মানুষ আমার প্রায়-কথার-স্টাইলে-গাওয়া গান শুনে বলেছিলেন — এই লোকটি যদি গান গাইতেন আমাদের পাড়ায় দাঙ্গা হতো না। হয়তো অতিপ্রশংসা, কিন্তু কতখানি ভালো লাগলে এ-কথা তারা বলতে পারেন! তবে তেলেগু মূল সুরে গানটি সমবেতভাবে না গাইলে কিন্তু গানটির আবেদন বোঝা যাবে না।
আমার একক গানেও কোনো কোনো জায়গায় যদি আমার সঙ্গে অনেকে গেয়ে ওঠেন তাহলে গানটি যেন পরিপূর্ণ রূপ পায়। ‘ডিঙ্গা ভাসাও’, ‘ভয় কি লাল রঙে’, ‘কি আমাদের জাত’, ‘বলো সাথী চিরদিনই আমাদের পয়লা মে’, ‘লড়াই করো’ যখন গাই তখন কোনো কোনো জায়গায় শ্রোতারা গেয়ে ওঠেন। কখনো আমিই বলে দিই কোন কোন লাইন সবাই গাইলে ভালো হয়।
কোনো গান একাও গাওয়া যায়, সবাই মিলেও গাওয়া যায়। একা গাওয়ার সময়ে আমি যে-স্বাধীনতা নিতে পারি, সমবেতভাবে গাওয়ার সময় তা চলবে না; তখন গানটি নির্দিষ্ট তালে গাইতে হবে। একক গানে হয়তো যে-গান বিলম্বিত লয়ে ভালো লাগে, সমবেত গান হয়তো তার থেকে একটু দ্রুততর লয় প্রত্যাশা করে। জোন বায়েজের একক কণ্ঠে বিলম্বিত লয়ে ‘we shall overcome’ শোনা এক অভিজ্ঞতা। আমরা এটি সমবেতভাবে শুনতেই বেশি অভ্যস্ত।
আগেই বলেছি, কোনো কোনো গান বহুকণ্ঠে শুনতে ইচ্ছে করে। যদি পাশ্চাত্য প্রথায় হার্মোনাইজেশনের ব্যাপার থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। সমবেত গানে নিয়মানুবর্তিতার এবং অভ্যাসের প্রয়োজন খুব বেশি। একা একা নয়, সবাই মিলে অভ্যাস। সেটা অনেক সময় নানা কারণে হয়ে ওঠে না। বিদেশের ধাঁচের choir এমন কঠোর বলিষ্ঠ প্রশিক্ষণ এবং অভ্যাস সাপেক্ষ। সমবেত গানে অভ্যাসের অভাব খুব স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে এবং গান তার আবেদন হারায়।
আমাদের এখানকার গাওয়া সমবেত সংগীত অনেকটাই পাশ্চাত্য কয়্যারধর্মী। শ্রদ্ধেয় গদ্দর ও তাঁর সম্প্রদায়ের সমবেত গানে শরীরের ভঙ্গি, শিল্পীদের চলাফেরা, নৃত্যের একটি প্রধান ভূমিকা আছে। ব্যাপারটা অভ্যাসসাপেক্ষ, দুরূহ — এমনকি সবসময় শিখেও আয়ত্ত করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন লোকসংস্কৃতির গভীরে সঞ্চার এবং জনগণের সঙ্গে একাত্ম হওয়া।
গানপারটীকা
ষাটের দশকের গোড়ায় সেই-যে এসেছিল তুফানি দিনগুলো, গোটা দুনিয়ায় এবং বাংলাদেশে ও ভারতেও, প্রতুল মুখোপাধ্যায় সেই নিশিদিনগুলোতে একাধারে গেয়ে লিখে সুর দিয়ে বেড়িয়েছেন এন্তার গান। যদিও আমরা, বাংলাদেশের শ্রোতা সাধারণ এবং পশ্চিমবঙ্গ সমেত গোটা ভারতেরও বিপুল শ্রোতাগোষ্ঠীর বিবেচনায়, তার গান শুনতে পেয়েছি তিনদশক পরে ক্যাসেটযুগে এসে। সেইটা লাস্ট সেঞ্চুরির নব্বইয়ের দশকের একদম পয়লা। তার অভিষেক স্টুডিয়োরেকর্ড রিলিজ হয়েছে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে, ‘পাথরে পাথরে নাচে আগুন’ নামে। এরপর বেরিয়েছে একে একে ‘যেতে হবে’, ‘ওঠো হে’ এবং আরও অন্তত ছয়টা অ্যালবাম যা আমরা বাংলাদেশের শ্রোতারা বাজার থেকে ক্যাসেটপার্চেজ করে শুনেছি। সর্বশেষ বাংলাদেশের বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে বেরিয়েছে প্রতুল মুখুজ্জের ‘আমি বাংলায় গান গাই’ শীর্ষক একটা অ্যালবাম, ২০১১, হয়ে গেছে সে-ও অর্ধযুগ অতিক্রান্ত। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সত্তর-প্রায় বয়সের প্রতুল এখনও সক্রিয় রয়েছেন গানসৃজনে।
এই লেখাটা আমরা কালেক্ট করছি স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত ‘যুদ্ধজয়ের গান’ শীর্ষক একটা সংকলন থেকে, লেখাটা ‘একক ও সম্মেলক গান প্রসঙ্গে’ শিরোনামে মূলে পাওয়া। সংকলনের ৩৩২ পৃষ্ঠাঙ্কে লেখাপ্রারম্ভে এডিটোরিয়্যাল দুইটা লাইন পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে দেখছি লিখিত : “গণসংগীত মূলত সম্মেলক গান অথচ প্রতুল মুখোপাধ্যায় এককভাবে গেয়ে থাকেন। এই প্রসঙ্গে প্রতুল মুখোপাধ্যায় তাঁর বক্তব্য লিখিতভাবে জানিয়েছেন।” উল্লেখ্য, সংকলনে প্রতুলের দীর্ঘ কথোপকথা ছাড়াও অনেক লড়াকু গণসংগীতকারের অন্তরঙ্গ কথাবার্তা ছাপা আছে। এইটা বাইর হয়েছিল ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে, ‘এবং জলার্ক’ প্রকাশন কলকাতা থেকে, একহাজার পৃষ্ঠার কাছাকাছি কলেবরের সংকলনটা বাংলা-হিন্দি-মারাঠি-তেলেগু প্রভৃতি বিচিত্র ভাষার বিভিন্ন অঞ্চলের গণসংগীত নিয়া আলাপবোঝাপড়ার একটা জ্যান্ত আকরিক।
প্রতুল মুখোপাধ্যায় নিজে লেখেন গান, তারচেয়েও অধিক তিনি বিভিন্ন সময়ের ও বিভিন্ন ভাষার কবির কবিতায় এবং এমনকি পোলিটিক্যাল প্যাম্ফলেট-ম্যানিফেস্টোতে সুর দিয়ে অবাক করেছেন বারবার বাংলার সংগীতামোদীদের। বিশেষভাবেই চিনের ভাষায় অ্যাফ্রিকার ভাষায় হিন্দি ভাষায় কিছু লোকায়তিক সুরের কাঠামো প্রতুল বাংলায় ব্যবহার করে একে তো বাংলা সুরের ইডিয়মের সঙ্গে মেশামেশি ঘটিয়ে দিয়েছেনই, নিজের ইউনিক সিগ্নেচারটিউনও করে তুলেছেন যেন। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কাজ সোলো হয়েও সমবেত সংগীতের ব্যঞ্জনাবাহী; কিংবা, সমস্বরের কন্টেন্ট এর লিরিকে থাকলেও অন্তিমে যেন তা একা-ব্যক্তির ভাঙন-উত্থানের উপাখ্যান বলিষ্ঠভাবে ডেপিক্ট করে। একক নিঃসঙ্গ নিত্যজঙ্গের বীরটিকেই যেন প্রতুলের গান বন্দনা করতে চায়। ঠিক বইয়ের পাতার বীরবন্দনা বা জ্বালাওপোড়াও স্লোগ্যানের বাইরে এমন পোলিফোনিক দ্যোতনার অল্পবাদ্যবহ প্রতুলসংগীত শেষমেশ চিরন্তন প্রেমেরই গান। প্রকৃত প্রস্তাবে এনজিও-কর্পোরেটের সোশ্যাল রেস্পোন্সিবিলিটির ভড়ং দেখানো প্রচারণাগানের বেশিকিছু হইতে না পারা আজকালকার বাংলাদেশজ কিছু গণসংগীতদল হয়তো প্রতুলের গানের পরবর্তী বিন্দু থেকে তাদের গানকর্ম শুরু করতে পারে। এবং, বলা বাহুল্য, পরিবেশচেতনা বা রাজনীতিচেতনা বা মানবদরদচেতনা ইত্যাদি কিসিমের বিবিধ ব্যুকিশ ব্যাপার ঝেড়ে ফেলে একজন সংগীতজীবীকে তার গানচেতনাটায় শান দিতে হয়, গানকেই নিশানা করতে হয়, এনজিও আর বিজ্ঞাপনপটু প্রচারমাধ্যমের মানবকল্যাণকান্নার সঙ্গে একটা গণসংগীতশিল্পী/গণসংগীতসংঘের একটা ফারাক তো থাকতে হয়।
দেশের মানুষকে জাগানো তো নোবল কাজ, সন্দেহ নাই; কিন্তু সুরটাকে, কথাটাকে, ব্যথাবেদনার উপশমটাকে, কে জাগাবে? কে ভাবে এইসব নিয়া! খালি মিনারের বেদিমণ্ডপে আর রাস্তাপাশে মাচা বেঁধে শালু ঝুলিয়ে কিছুদিন ধুমাইয়া গাও আর বাকি জিন্দেগির লাগিয়া সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হইয়া যাও। গণসংগীত সম্প্রতি এইভাবেই বিরাজিছে, বোধহয়, অসমর্থিত খবরে প্রকাশ। অলমিতি বিস্তরেণ।
… …
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
- আর্কের হাসান ও নব্বইয়ের বাংলা গান - January 23, 2025
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
COMMENTS