লোকমনোরঞ্জনের লাফঝাঁপ থেকে দূরে এই নয়নের নীরে || কল্লোল তালুকদার

লোকমনোরঞ্জনের লাফঝাঁপ থেকে দূরে এই নয়নের নীরে || কল্লোল তালুকদার

পোশাকি নাম ‘কেদার কুটির’, তবে ‘লম্বা বাসা’ নামেই উকিলপাড়ার এই প্রাচীন পরিবারটি সবার কাছে পরিচিত। এটি সুনামগঞ্জ শহরের অন্যতম সংস্কৃতিবান পরিবার। সংগীতজগতেও এই পরিবারের অনেক সদস্যের ছিল ও আছে অবাধ বিচরণ। এক-সময়কার একান্নবর্তী এই বর্ধিষ্ণু পরিবারের সদস্যগণ দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন সময়ের প্রয়োজনে। ছোটবেলায় দেখেছি, কী জমজমাট ছিল এই বাসাটি! ভোরবেলা রেওয়াজ শুনে আমাদের ঘুম ভাঙত। রাতবিরেতে হঠাৎ হঠাৎ ভেসে আসত অভিজিৎ চৌধুরীর — আমাদের বিজিতদার — দরাজ কণ্ঠ : “তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে / তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে” …

এই বাসারই ছোট্ট মেয়ে সিমি, — আজকের অনিন্দিতা চৌধুরী। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক-কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট সুকুমার চৌধুরীর, মানে আমাদের প্রিয় শংকরদার, কন্যা। পারিবারিক সাংস্কৃতিক আবহে সিমির বেড়ে ওঠা। বৈবাহিক সূত্রে সে এখন সিলেটের বাসিন্দা। প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত রামকানাই দাশের পুত্রবধূ।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে সম্প্রতি বেরিয়েছে তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘নয়নের নীরে’। এতে রয়েছে নজরুলের বিভিন্ন আঙ্গিকের আটটি গান। গতকাল রাতে অ্যালবামটি হাতে এল। সিডিটি সুনামগঞ্জে এত দ্রুত নিয়ে আসার জন্য এই সুযোগে পাপ্পুকে জানিয়ে রাখি ব্যক্তিগত ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতাটুকু।

নয়নের নীরেগভীর রাত পর্যন্ত তন্ময় হয়ে অনিন্দিতার গান শুনলাম। আমি এমনিতেই দুখু মিয়ার গানের একনিষ্ঠ ভক্ত। বলা যায় রোজ রাতে নজরুলসংগীত আমার সঙ্গী। অবশ্যই প্রথিতযশা শিল্পীদের কণ্ঠে। তবে মনে মনে ভাবি, এ-রকম দুয়েকজন শিল্পী কী আমাদের এই জনপদ থেকে কখনও বের হবে না! কিন্তু কীভাবে? নূতন প্রজন্মের মধ্যে হাতে-গোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই লোকগীতি নিয়েই মেতে রয়েছে। তবে অমিত সম্ভাবনাময় রাকিব ইসলাম ঐশী, দেবশ্রী তালুকদার সৃষ্টি, অরুণিমা সহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে আমরা গর্বিত ও আশাবাদী।

শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা প্রায় উঠেই যাচ্ছে। মা-বাবারাও দুয়েকটি জনপ্রিয় করতালিসম্ভাবনাপূর্ণ লোকসংগীত শিখিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সন্তানকে মঞ্চে তুলে দিতে চান। তারকা বানাতে হবে তো! এত সময় কোথায় নষ্ট করার? তাছাড়া শ্রোতৃবর্গও এখন আর এসব গান শুনতে চান না! পাব্লিক খাবে না, তাই উৎসব-অনুষ্ঠানে কেউ রবীন্দ্র-নজরুল গাইতে সাহস করে না। তবু আমরা প্রতীক্ষা করি, কেউ হয়তো আসবে!

“বরষ পরে বরষ আসে যায় ফিরে,
পিপাসা মিটায়ে চলি নয়নের নীরে।”

লোকগীতির এই ডামাডোলে নূতন প্রজন্ম যখন চিরন্তনী সংগীত বিস্মৃত হতে চলেছে, ঠিক এমনই এক সময় অনিন্দিতার এই অনন্যসাধারণ আবির্ভাব। অনন্য তার গায়কী! তাঁর গান শুনেই বোঝা যায় যে, সে বিশুদ্ধ সংগীতের সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছে।

নয়নের নীরেঅ্যালবামটিতে আটটা গান রয়েছে, সেগুলো : ‘জনম জনম গেল’, ‘আয় মরুপারের হাওয়া’, ‘রুমঝুম রুমঝুম’, ‘বুলবুলি নীরব নার্গিসবনে’, ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর’, ‘তুমি যতই দহ না’, ‘প্রিয় যাই যাই বোলো না’ এবং ‘আমার যাবার সময় হলো’। অনিন্দিতার ঘন পরিমিতিদীপ্ত গায়কী এবং ক্ল্যাসিক্যালকৌলীন্য মিলেমিশে এই বহুশ্রুত নজরুলগানগুলোর উপস্থাপন এমন হয়েছে যেন নবায়ন ঘটেছে বলে মনে হয়। রেন্ডিশন এতই স্ফূর্ত হয়েছে যে, শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এ তো নজরুলের সমস্ত কালোয়াতি বজায় রেখেও হয়ে উঠতে চেয়েছে এই সময়েরই বিধুরতার গাথা! আর, আমরা তো স্বীকারই করব যে, রেন্ডিশন মাত্রেই ইন্টার্প্রিটেশন। অনিন্দিতা এই কাজে প্রথম নিবেদনেই যথেষ্ট সফল বলতে হবে।

অ্যালবামের যন্ত্রানুষঙ্গ পরিচালনা করেছেন । যেটুকু শুনেছি, অন্তত প্রথম শ্রবণে, কোথাও অসামঞ্জস্য কানে বাজেনি। মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে এই এক ব্যাপার যে, প্রথম শ্রবণে যদি পীড়াকর মনে না হয় তাহলে অন্তিমে সেই মিউজিক শ্রুতিনন্দিত হবে বলা যায়। অনিন্দিতার অ্যালবামে সংগীত ও বাদ্যযোজন সুখশ্রাব্য হয়েছে।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন নিবেদিত ‘নয়নের নীরে’ অ্যালবামের সিডিপিঠে দেশের প্রখ্যাত নজরুলগানশিল্পী শাহীন সামাদ একটি ছোট্ট অথচ সুপাঠ্য শংসাপত্র লিখেছেন নবোদিত সংগীতশিল্পীটিকে স্বাগত জানিয়ে; সেই শংসাপত্রে লেখা : “সংস্কৃতির অঙ্গনে নতুন প্রজন্মের যে-কয়জন শিল্পী সাধনার দ্বারা নিজেদের ক্ষেত্র তৈরি করে নিয়েছেন তাদের মধ্যে অনিন্দিতা চৌধুরী অন্যতম। তিনি সাবলীল কণ্ঠের অধিকারী, অনন্য তার গায়কী। গানের প্রতি গভীর মনোনিবেশ ও মোহময় সুরের জাল রচনায় সিদ্ধহস্ত এ শিল্পী। বর্তমান সময়ে আধুনিক গানের জোয়ারে মূলানুগ গানের প্রতি নবীনদের ঝোঁকের বহিঃপ্রকাশ অনিন্দিতার গানে পাওয়া যায়। তাঁর গাওয়া সিডির প্রতিটি গানই পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর। আমি অনিন্দিতার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।”

ঠিক এই কথাটা আরেকবার উচ্চারণ করা যায় যে, ‘আধুনিক গানের জোয়ারে মূলানুগ গানের প্রতি নবীনদের ঝোঁক’ যখন প্রায় তলানিতে, ফোকের ধুমধাড়াক্কায় স্টেজে হুড়োহুড়ি দিয়ে ফেস্টে সয়লাব যখন দেশ, এই সময়ে অনিন্দিতা চৌধুরী নজরুলগান গাইবার সশ্রম সাহস করেছেন, এটা চাট্টেখানি কথা নয়। কেননা আমরা জানি যে এদেশে নজরুলের গানের শিল্পী একদম কড়ে-গোনা, আর নজরুলের গানে শাস্ত্রীয় নোটগুলোর প্রায় সরাসরি পাতনের কারণে এই গীতিকার-সংগীতদ্রষ্টার গান গাইবার সশ্রম দুঃসাহস করতে খুব-একটা কাউকে দেখা যায় না। আর আমাদের দেশে নজরুলগান গাইবার ন্যায় ট্রেইন্ড শিল্পী বিকাশের কোনো প্রক্রিয়া বা রাস্তাঘাটও চোখে পড়ে না। কালেভদ্রে যারা আসছেন দুখু মিয়ার ঘনসংগীতঋদ্ধ পথে, তারা নিজেদেরই হিম্মতে ঝুঁকি নিচ্ছেন। ফলে গ্রেইট দুয়েকজনের রেকর্ডগুলোই আমার মতো শ্রোতাদের সম্বল শুধু। অনিন্দিতার এই রিস্ক-টেইকিং ইনিশিয়েটিভ নিশ্চয় এদেশের সংগীতসমুজদারদের কাছে সাদরে গৃহীত হবে।

এখন থেকে দেশবিদেশের বরেণ্য শিল্পীদের সমান্তরালে আমাদের মেয়ে অনন্য অনিন্দিতার গান শুনব। ‘নয়নের নীরে’ অ্যালবাম দিয়ে এই নবীন শিল্পীর অভিষেকে আমরা তাকে অভিবাদন জানাই। কামনা করি নজরুলগানের শিল্পী বিকাশের রাস্তাটা আরও সুগম ও বেগবান হবে।

… …

কল্লোল তালুকদার

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you