মৌলভীবাজারের শহরের কাছেই বিশাল এক দীঘি। এপার থেকে ওপার দেখা যায় না। ক্লাস সিক্সে পড়া আমি দীঘির বিশালত্ব দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বিষ্ণুপুরের এই দীঘির নাম ছয়চিরি। প্রতিটা দীঘির যেমন একটা ইতিহাস এবং মিথ থাকে, ছয়চিরি দীঘিও তার ব্যতিক্রম নয়। সেসব কথা অন্য-একদিন হবে। আজ বলি চৈত্রসংক্রান্তিতে বসা ছয়চিরি দীঘির পাড়ের চড়কের মেলার গল্প । চৈত্রসংক্রান্তি বলছি এই কারণে যে, মেলাটি হিন্দু পঞ্জিকামতে চৈত্রসংক্রান্তিতেই হয় যা আমাদের দেশীয় পঞ্জিকামতে বাংলা নববর্ষ।
সবচেয়ে পপুলার মিথ হলো চড়কের আগে নাকি দীঘির জলে ভেসে ওঠে চড়কের ৭০-৮০ ফুট গাছ। সেই গাছ দিয়েই দীঘির চারপাশে হয় চড়কের আয়োজন। অবশ্য চড়কের আগে এবং পরে থাকে কালীনাচ, যেখানে গ্রামে গ্রামে হরগৌরী সেজে নেচে গেয়ে ধান-চাল-টাকা ইত্যাদি উত্তোলন করা হয়। তবে চড়কের মূল কার্যক্রম শুরু হয় চৈত্রের শেষদিনের আগের রাতে। যেখানে চড়কগাছ গাড়া হয়, তার পাশে তৈরি করা হয় অস্থায়ী মণ্ডপ। সেই মণ্ডপের আঙিনায় তান্ত্রিক মন্ত্রের কাচপড়া দিয়ে জ্বলন্ত ছাইয়ের ওপর মানুষরূপী কালী সেজে নৃত্য করেন পুণ্যার্থীরা। নৃত্যের সঙ্গে ভক্তরা ঢাকঢোল, কাঁসা-করতাল বাজান, শিঙ্গা ফোঁকেন। এ নাচে মানুষরূপী কালী লম্বা দা-এর ওপর উঠেও দাঁড়ান। আর চড়কের গাছে পিঠে বড়শি বেঁধে ঘুরতে থাকেন হরগৌরী সাধকের দল। চড়কগাছের মাথার উপরে স্থাপিত হন মহাদেব। যে গান সাধকদের মুখে শুনেছিলাম তার একটা লাইন আজো মনে আছে : “হরগৌরী প্রাণনাথ, মাথার উপরে জগন্নাথ” …
ঢাকের বাদ্য, মেলার আওয়াজ , শিঙ্গার ধ্বনি, আর ডমরুর গুড়ুগুড়ু শব্দ আর ভাঙের গন্ধে এক অন্য মাত্রার আবহ সৃষ্টি হয় ছয়চিরি পারে। এত বছর পরেও তিরের ফলার মতো গেঁথে আছে মনে।
চড়কের গাছে বড়শি দিয়ে ঝুলন্ত মানুষ দেখে দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস পায়নি কিশোর মন। তবে মেলার খই, পোস্টার, চরকি ইত্যাদি ছিল লোভনীয়। মনে আছে সেই মেলায় আমি আমার জীবনের প্রথম ও শেষবারের মতো টাকা হারিয়েছিলাম, যার অ্যামাউন্ট ছিল বিশ টাকা।
এর পরে আরো একবার সিলেট শহরের চালিবন্দরের চড়কের পূজা দেখেছি। তবে তা আমার কাছে এত এক্সোটিক আর জীবন্ত মনে হয়নি।
সংস্কৃতির ধারক-বাহকরা হয়তো এটাকেও দলিত শ্রেণির উৎসব অথবা নিম্নশ্রেণির মানুষের উৎসব বলে দূরে ঠেলে দেবেন । আরেক দল হয়তো বলবেন ইহা হিন্দু সংস্কৃতি। তবে এটাই আমার হাজার বছরের শিকড়। এসব ছোট ছোট শিকড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের বাংলা সংস্কৃতির মহীরুহ। এটাই আমাদের আধুনিক সংস্কৃতির উৎস। আমরা এগিয়ে যাব, আধুনিক হব, তবে অবশ্যই পেছনকে ফেলে নয়। শিকড়কে ভুলে নয়।
ব্যবহৃত ছবিগুলো আমাদের মুন্সিবাজার নামের একটি গ্রুপ থেকে সংগৃহীত
… …
- দিবারাত্র দুর্গাপুজো || অসীম চক্রবর্তী - October 5, 2019
- ঠাকুরবন্দনা || অসীম চক্রবর্তী - August 9, 2019
- জলধামাইল || অসীম চক্রবর্তী - August 1, 2019
COMMENTS