রাজেশ্বরী দত্তের কণ্ঠে ‘নীলাঞ্জনছায়া, প্রফুল্ল কদম্ববন’ গানটি প্রথম শুনেছিলাম রেডিওতে, অনেক কাল আগে। গান তো নয় যেন প্রকৃতির বর্ণগন্ধশব্দকল্পের এক জাদুময় বিস্তার; এক অপার্থিব আনন্দলোকের আহ্বান।
‘গীতবিতান’ খুঁজে গানটি আবিষ্কার করে একটু হতাশ হয়েছিলাম, চারপঙক্তির গানটি যেন অকারণ শব্দভারাক্রান্ত। গানটি না শুনলে ‘ঘনসুগন্ধ’ অথবা ‘কান্তবিরহকান্তারে’-র মতো কঠিন শব্দবন্ধ-যে কোনো গভীর সাংগীতিক দ্যোতনা সৃষ্টি করতে পারে, তা হয়তো ভাবতে পারতাম না।
অনেক কাল আগে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চেনাজানাটা গভীর ছিল না। আমাদের চারিদিকের সবুজ তেমন অরক্ষিত ছিল না, নীলাঞ্জনছায়াও সংকুচিত হয়ে পড়েনি। কিন্তু গানটি দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার শুনে মনে হয়েছিল, রাজেশ্বরী যেন রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি উদযাপনের আনন্দ আর আবেগটুকু তাঁর কণ্ঠে ধারণ করে নিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে সহযাত্রী হওয়া, শ্রোতা হিশেবে, অসম্ভব কোনো বিষয় ছিল না।
ততদিনে রবীন্দ্রনাথের আরও গান শুনেছি, কবিতা পড়েছি এবং জেনেছি, প্রকৃতি নিয়ে আনন্দের সঙ্গে তাঁর বিষাদও ছিল, কষ্ট ছিল এবং প্রকৃতিকে যারা সীমিত করে, আঘাত দেয়, তাদের প্রতি ক্ষোভও ছিল। ফলে সেই গানের ‘পরিকীর্ণ দিগন্ত’-কে এক ইচ্ছাপূরণের ছবি হিশেবেও কল্পনা করেছি।
রেডিওতে রাজেশ্বরীকে প্রথম ও তৃতীয় শ্রবণের মাঝখানে কেটে গিয়েছিল কয়েকটি বছর। একসময় তাঁর গানের এলপি রেকর্ড কিনেছি এবং এ-গানটি বারবার বাজিয়ে শুনেছি। এখনও গানটি শুনতে শুনতে চোখ বন্ধ করলে যে-দৃশ্য দেখি, তা এক পরিপূর্ণ সবুজ দিগন্তরেখার, পল্লবিত পুষ্পবনের, আকাশে মন্থর ভেসে-চলা মেঘের এবং সব মিলিয়ে বর্ণনার অতীত এক অনুভবের। এই পরিকীর্ণ সবুজে চিত্তহারা পথিক যে-কেউ হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ অথবা আমি। অথবা নামহীন কোনো দলছুট।
সমগ্র জীবন রবীন্দ্রনাথ শ্যামল ছায়ার সন্ধান করেছেন, যে-ছায়া বৃক্ষের, মেঘের; এবং এক নিমগ্ন, নিভৃত প্রকৃতির নির্জনতায় নিজেকে কল্পনা করেছেন। এই প্রকৃতি নগরে বিলীন; বাংলার বাইরে এর অস্তিত্ব থাকলেও বাংলার প্রাণের ভেতরই তার সন্ধান করেছেন সারাজীবন। শহরে জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, শহুরে সংস্কৃতিতে মানুষ হয়েছেন; শহরকেন্দ্রিক সামাজিকতা, লোকাচার এবং নানা সংস্কার আন্দোলন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়েছেন, অথচ তাঁর ভাবাদর্শের কেন্দ্রে ছিল গ্রাম, তাঁর রোমান্টিকতার অন্দরমহলে ছিল পল্লিগ্রামের প্রকৃতি ও প্রকৃতির নিমগ্নতা। গ্রাম যে কী গভীর দোলা দিত তাঁর চিত্তে, তার প্রমাণ তো অনেক কবিতা, গল্প, নাটক, ‘ছিন্নপত্র’ ও ‘ছিন্নপত্রাবলী’-তে। এমনকি তাঁর প্রকাশবাদী চিত্রকলায়, উদ্ভট জীবজন্তু ও পাখিদের ভিড়ে হঠাৎ হঠাৎ জ্বলে-ওঠা নিসর্গচিত্রে।
…
গানপারটীকা
এই নিবন্ধটা আমরা কালেক্ট করেছি বাংলাদেশের ‘দৈনিক সমকাল’ পত্রিকার শুক্রবাসরীয় সাময়িকী ‘কালের খেয়া’ ৪ মে ২০১২ থেকে। এইটা মূল রচনার এক-চতুর্থাংশ, পূর্ণ রচনাটা এইখানে নেয়া হয় নাই। ‘নীলাঞ্জনছায়া’ শিরোনামে লেখাটা কালের খেয়ায় ছাপা হলেও আমরা গানপারে গ্রহণকালে এর শিরোনামে চেইঞ্জ এনেছি শ্রীমতী রাজেশ্বরী দত্ত-প্রাসঙ্গিক অংশটুকু প্রদীপের আলোয় রাখার জন্য। মূল রচনা ‘নীলাঞ্জনছায়া’ আরও লম্বা, বাকি অংশ যা এখানে গৃহীত হয় নাই তাতে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে প্রকৃতিচেতনা ইত্যাদি নিয়া আলাপসালাপ গানপারে তেমন জরুরি পাঠকগুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নাই। গৃহীত অংশটুকু রবীন্দ্রনাথের একটা গানকেন্দ্রী শ্রোতার অভিজ্ঞতা বিবৃত করছে, সেইসঙ্গে উঠে এসেছেন একজন সংগীতশিল্পী রাজেশ্বরী দত্ত।
প্রথিতযশা সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রচনায় নিজের একটা স্টাইল গড়ে নিয়েছেন ইতোমধ্যে। এবং হয়েছেন পাঠকআদৃত। এই রচনায় রাজেশ্বরীকে চেনা যায় একটা গানসূত্রে, যে-গানটা গীতবিতানে প্রেমপর্বের আওতাভুক্ত ২৫৮ সংখ্যাচিহ্নিত গান। আর রাজেশ্বরী দত্তকে চেনেন না, এমন মানুষ নাই ভাবাটা তো অত্যুক্তি হয়। কাজেই রাজেশ্বরীর পরিচয় দেয়া বাঞ্ছনীয়। উনি একজন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। পুরা নাম রাজেশ্বরী দত্ত। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্ত্রী। তিরিশের দশকের কবি ও সাহিত্যিক পরে যারা পরিণত বয়সে যেয়ে স্মৃতিকথা লিখেছেন তাদের অনেকেরই স্মৃতি থেকে আমরা রাজেশ্বরী দত্তকে দেখেছি। ঠিক বাঙালি ছিলেন না তিনি, ছিলেন জন্মসূত্রে পাঞ্জাবি। ভিন্ন একটা কায়দায় তাঁর রেন্ডিশন রবীন্দ্রানুরাগী অনেকেরই ছিল পছন্দের সেই-সময়, চেহারাসুরতেও রাজেশ্বরী ছিলেন নিজের নামেরই মতো। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের রচনাটা রাজেশ্বরীর গান শোনার জন্য শ্রোতাদেরকে ইউটিউবের দিকে ধাবিত করবে নিশ্চয়। কিছু গান পাওয়া যায় সার্চ করলেই।
যে-গানটা নিয়া সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্মৃতি রোমন্থন করেছেন, সেই গানের লৈখিক রূপটা আমরা নিচে রাখছি :
নীলাঞ্জনছায়া, প্রফুল্ল কদম্ববন,
জম্বুপুঞ্জে শ্যাম বনান্ত, বনবীথিকা ঘনসুগন্ধ॥
মন্থর নব নীলনীরদ- পরিকীর্ণ দিগন্ত।
চিত্ত মোর পন্থহারা কান্তবিরহকান্তারে॥
রাজেশ্বরীর কণ্ঠে রবীন্দ্রগানের আমেজ কেমন ছিল শুনতে ইউটিউবে সার্চ দিন।
… …
- কাব্য ও বিজ্ঞান || শ্রীঅশোকবিজয় রাহা বি.এ - January 14, 2025
- মুরারিচাঁদ কলেজ, অশোকবিজয় রাহা এবং একটি অগ্রন্থিত রচনা || মোহাম্মদ বিলাল - January 14, 2025
- জনতার কাব্যরুচির প্রতীক || ইলিয়াস কমল - December 14, 2024
COMMENTS