বাংলাদেশের অন্যতম প্রান্তিক পেশাজীবী সম্প্রদায় বয়নশিল্পীদের জীবন রূপায়ণে পাপড়ি রহমান অন্যতম পথিকৃৎ। সমরেশ বসুর (১৯২৪-১৯৮৮) তাঁতশিল্পনির্ভর ‘টানাপোড়েন’ (১৯৮০) উপন্যাসের কথা স্মরণ রেখেই এ মন্তব্য করা যেতে পারে। উপন্যাসের অবয়বে উপস্থাপনের জন্য তাঁতশিল্পীদের যে-জীবন তিনি বিবেচনায় এনেছেন সেটা আমাদের জীবনাভিজ্ঞতার সীমানা সম্প্রসারণের জন্য নিঃসন্দেহে একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এ জীবন বিন্যাসে তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার অন্তর্গত মুগরাকুল, পবনকুল, মইকুলি, বরাবো, দিঘীবরাবো, তারাবো ও রূপসী গ্রামের জামদানী শিল্পের সঙ্গে জড়িত জোলা-তাঁতি সম্প্রদায়ের জীবনাচরণকে ‘বয়ন’ (২০০৮) উপন্যাসের উপকরণ হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
দ্রুত-পরিবর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বয়নশিল্পীদের দারিদ্র্যপীড়িত জীবনবাস্তবতা, তাদের মনোদৈহিক সংকট, কুসংস্কার-অন্ধবিশ্বাস, সামাজিক অন্তঃসারশূন্যতা, লালিত স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, নঞর্থক জীবনসত্যের মাঝে নতুন জীবনাভীপ্সা পাপড়ি রহমানের বয়ন উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য দিক হলেও এখানে সমাজজীবনের বহির্বাস্তবতার চেয়ে চরিত্রের অন্তর্বাস্তবতাই অধিকতর শিল্পসিদ্ধি অর্জন করেছে। তাঁতশিল্পের উত্থান-বিকাশ-বর্তমানতার সংমিশ্রণের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে সবেদআলি-পয়রনবিবি, মুল্লুকচান-কমলাসুন্দরী, আতিমুনি-আলাউদ্দিন, নূরমোহাম্মদ-আয়শা-চাঁদবিবি-তারাবিবি, আকাইল্যা-ঝুম্পাড়ি-ফৈজুমিয়ার অন্তর্মনস্তত্ত্বের নান্দনিক ভাষ্য হয়েছে বয়ন উপন্যাস। মৌল তিনটি পরিবার-স্রোত বালু-শীতলক্ষ্যা-ব্রহ্মপুত্রের মতো পরস্পর বিজড়িত হয়ে একটা বৃহত্তর আকরণ সৃষ্টি করেছে এ উপন্যাসে।
সমগ্র উপন্যাসের কাহিনি চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণের প্রয়াস থাকলেও কখনো কখনো ঔপন্যাসিক নিজেও এর ভেতরে প্রবেশ করেছেন। মোঘল আমলে তাঁতিরা বুনত মসলিন। ইংরেজ আমলে মলবুসখাস, শবনম, আলি-বালি, তনজেব , নয়নমুখ, তরান্দাম, আব-ই রওয়ানের বুননের ওপর ইংরেজদের ‘শকুন-নজর’ পড়েছিল। এই নিখুঁত ‘শিশিরের মতো স্বচ্ছ’ বস্ত্র প্রস্তুতকারীদের হাতের আঙুলই কেটে নিয়েছিল ইংরেজরা। এই দুঃসহ স্মৃতি তাড়িত করেছে সবেদআলির বাবা নৈমদ্দিন মিয়াকে, সবেদআলিকেও। ‘পানামপুকুর, চরকার ইতিবৃত্ত, বিলাতী সাহেবদের ইতিউতি কিসসায়’ সে হয়েছিল বিপন্ন। পডিঘরে বসে মাকু চালাতে সিদ্ধহস্ত এ তাঁতশিল্পীকে নিজের সংসারের বৃত্তে বেঁধে রাখতে পারেনি ছয় সন্তানের জননী পয়রনবিবি। গার্হস্থ্য জীবন ও পডিঘর সামলানোর কারণে তার রাশ আলগা পেয়ে ‘পাগলাঘোড়ার মতো’ তারুণ্যপূর্ণ সবেদআলি প্রথম স্ত্রীর কথা গোপন রেখে তারাবোর গৃহস্থকন্যা কষ্টিপাথরের মতো কালো আতিমুনিকে দেখে বিমুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করে ঘরে আনে।
বিশ্বাসহন্তা সবেদআলিকে অশ্রুসজল চোখে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে আতিমুনি চলে যাবার পর সে তাঁতের কাজ ছেড়ে জীবন-নকশা বুনে চলে। জামদানীর কারিগর থেকে সে হয়ে ওঠে বাড়ির মালিক। পুরনো সংসার ত্যাগ করে ‘পানামপুকুরের রক্তগন্ধা জলের ঘ্রাণ’ কিংবা ‘মুগরাকুলের হাওয়ায় ধুলা ওড়ার ইতিহাস’ ভুলে থাকার জন্য ‘নতুন গতরের অচেনা ঘ্রাণ’-এর সন্ধানে সখিনা-জাহানারার অধ্যায় শেষ করে মোমেনাতে এসে স্থির হয়। নানা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে সবেদআলি। কিন্তু তার সমস্ত চেতনা জুড়ে ছিল বাইন-নকশা। এটি ভোলার জন্য বিভিন্ন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার নামে প্রকৃত অর্থে সে আত্মপলায়ন করতে চায়।
“উৎসবের কোলাহলের ভিতর, পার্বণের কোলাহলের ভিতর, চটকদার জৌলুসের ভিতর, ম্যালা মানুষের ভিতর মিশ খেয়ে থাকলে সে অনেককিছুই ভুলে থাকে। এই আলো আর উৎসবে, মানুষ আর রঙে মজে থাকলে সবেদআলি পানামপুকুরের রক্তগন্ধা জল ভুলে থাকে। মুগরাকুলের হাওয়ায় ধুলা ওড়ার ইতিহাস ভুলে থাকে। বিলাতী সাহেবদের চরকা ভাঙার শব্দ ভুলে থাকে।” পৃষ্ঠা ১১১
এ বিপন্ন-অস্তিত্ব সবেদআলি তাঁতিদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের বয়নের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার জন্য ধাবমান অস্তিত্বের আলো হাতে শেষ পর্যন্ত শেকড়েই প্রত্যাবর্তন করেছে।
সবেদআলির স্ত্রী পয়রনবিবি — পডিঘরেই তার জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয়িত। স্বামীর কাছ থেকে উপেক্ষিত এ নারীর জীবনসংগ্রাম শেষ হবার নয়। জীবনের উপান্তে এসে ক্ষুধাজর্জর পয়রনবিবির অন্তর্জীবনের বাস্তবতা কখনো স্মৃতিময়তা, কোথাও বিভ্রমের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন ঔপন্যাসিক। ‘রাজ্যের খিদাপূর্ণ পেট’ নিয়ে ‘বিড়ালের মতো গন্ধ শুঁকে শুঁকে এর-ওর পাকঘরে হামলে’-পড়া পয়রনবিবি বয়স ও কুঁজোপিঠের ভারে ন্যূব্জদেহ। তিন ছেলের কারো হাঁড়িতেই রান্না হয় না তার জন্য। প্রতি সপ্তাহে তিন সন্তানের কাছ থেকে প্রাপ্ত নব্বই টাকার বন্দোবস্তেই তার জীবন চলে। নাতনি ঝুম্পাড়ি তার স্নেহার্দ্র হৃদয়ের একমাত্র সাক্ষী, সহযোগী। স্বামীর প্রতি ক্ষুব্ধ পয়রনবিবির কাছে মৃত মেয়ে নছিরন, বিশেষ করে রোশনার স্মৃতিই একমাত্র অবলম্বন; তীব্র রৌদ্রে খেজুরগাছের চিহ্ন ধরে রোশনার কবরে গিয়ে বসে থাকে। দৃষ্টির বিভ্রমে দেখতে পায় ‘দুধ-সাদা পাখি’-র মতো ডানা মেলে শৈশবের শাড়িপরা রোশনা যেন হেঁটে বেড়ায়। প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত পয়রনবিবি চোখের ছানিজনিত কারণে শেষ পর্যন্ত দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে। আন্তরিক ইচ্ছা থাকলেও পুত্র জজমিয়া অর্থাভাবে মায়ের চিকিৎসা করাতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু চিকিৎসার জন্য পুত্রবধূ মোহিতনের কথায় পিতৃপ্রদত্ত স্মৃতি সোনার ধানতাবিজের ছড়া গলা থেকে খুলে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। প্রান্তিক এ নারীর জীবনের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে একটি গোষ্ঠীর জীবনসংগ্রাম। নিচের অংশটি লক্ষণীয় :
“কুঁজো পিঠটাকে ময়ূরের মতো পেখম মেলাতে না পেরে, পয়রনবিবি পা-দুটো টান-টান করে সামনে ছড়িয়ে দেয়। বলতে গেলে হাড্ডিসার পা। কিন্তু চামড়া যতটা কুঁচকে যাওয়ার কথা তা যায়নি। বরং হাড্ডির সঙ্গে মিশ খেয়ে খানিকটা টান ধরেছে। পয়রনবিবির দুইখানা পায়ে কিছুতেই বয়সের চিন খুঁজে পাওয়া যাবে না। যুবতী নারীর চিন নিয়ে এই পা-দুইখানাই তাকে কখনো উদাস করে তোলে। তামার পয়সার মতো রঙ ধরা পা — মাটির গর্তে তলপাওয়ের সঙ্গেই তো সেঁটে রইল কতকাল।” পৃষ্ঠা ১২
ঔপন্যাসিকের প্রাগ্রসর ভাবনার স্মারক আতিমুনি চরিত্র। তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব গ্রামীণ নারীর স্বভাববৈশিষ্ট্যে দুর্লভ। সবেদআলি কারিগরের হাতে বোনা “বাঘনলি পাড়, জুঁইফুল, মটরদানার নকশা করা শাড়ি। … কমলা রঙ আর কালোর মাঝে সোনালি-রঙা মটরদানার”-র সিঁদুররঙা জামদানী পরে বাসরঘরে ঢুকেছিল গৃহস্থকন্যা আতিমুনি, যার সৌন্দর্য সবেদআলির দ্বিতীয় বিয়ের কারণে ‘দশমণি পাথরের তলায় চাপা পড়া’ পয়রনবিবির দৃষ্টিতেও পড়েছিল।
“এক্কেবারে পুড়িয়ে-কয়লা-করা কালোকিষ্টি গতরখান। কাটাকাটা নাক-মুখ। আর কোমরের বাঁক ছিল নতুন-কেনা কাস্তের মতো ধারালো। আতিমুনির রূপের রোশনাইয়ের সঙ্গে মেজাজখানাও ছিল এক্কেবারে জাত গোখরার মতো। দুই-পাঁচদিনের ভেতর যেভাবে ফণা ফোঁস করে উঠেছিল — পয়রনবিবি চার-পাঁচজনের মা হয়েও তেমন কোনোদিন পারে নাই। সবেদআলির সঙ্গে নয়-দশ বছরের সংসার যাপনের পরও অত বিষ সে উগরাতে পারে নাই।” পৃষ্ঠা ১১
আতিমুনি পূর্ববিবাহিত সবেদআলির সংসারে থাকতে চায়নি, মেনে নিতে পারেনি তার বিশ্বাসঘাতকতাকে। অন্য নারীর সঙ্গে স্বামীকে ভাগ করতে চায়নি বলেই ‘বাপজানের’ হাত ধরে নিজ বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করেছে। দিঘীবরাবোর আলাউদ্দিনমিয়ার সংসারে এলেও সবেদআলির সঙ্গে কাটানো ক’দিনের উদ্দাম জীবনের স্মৃতি মাঝেমাঝেই তাকে উদাসীন করে তোলে। নিজ জীবনের রূপক হিসেবে বর্ষামুখর দিনে নকশী কাঁথায় জোড়া পাখির নকশা তুলেও লতাপাতা দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেয় তাদের। প্রতি মুহূর্তের অন্তর্যন্ত্রণার মাঝেও নিখুঁতভাবে সাংসারিক দায়িত্ব পালন করে যায়, জুঁইফুলের মতো মুড়ি ভেজে চালান দেয় ডেমরার বাজারে।
“আতিমুনি মাঝে মাঝে চমকে ওঠে — আলাউদ্দিনমিয়া কি তবে ধরতে পেরেছে দেহ-মনে একাত্ম না-থাকার রহস্য! আলাউদ্দিনমিয়া কি জেনে গেছে — তার সংসার, তার জমিন, তার ধাইন-চাইল, মুড়ির চালান, ডোলা-ধাম, হাড়ি-কুড়ি আর সন্তানের ভেতরে থেকেও, আতিমুনির মন কি-না সেই কোনকালে দেখা পডিঘরের আনাচে-কানাচে ঢুকে পড়ে! তাঁতে-বুনে-যাওয়া জামদানীর বিচিত্র নকশার ভেতর সেঁটে থাকে তার মন! অথচ তার কাছে জোলার ছাওয়াল সবেদআলির কোনো মাফ নাই।” পৃষ্ঠা ১০৭
শেষ পর্যন্ত সবেদআলিই তার জীবনের নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। ভাগ্নে সিদ্দিকআলির মুখশ্রীতে সবেদআলির মুখচ্ছবি দেখতে পেয়ে রাতের আঁধারে তার পরিচয় জানার জন্য ব্যাকুল আতিমুনি ঘর ছেড়ে বাইরে এসে সন্দেহের বশে আলাউদ্দিনমিয়া কর্তৃক নির্যাতিত হয়। গ্রামপঞ্চায়েতের ফতোয়ার শিকার আতিমুনি শীতলক্ষ্যার স্রোতোধারায় চেতনা হারিয়ে পিতৃগৃহে উপস্থিত হয়েছে। আলাউদ্দিনমিয়াও নিজের ভুল বুঝতে পেরে স্বগ্রাম ছেড়ে আতিমুনির গ্রামে উপস্থিত হয়ে সেখানেই নতুন জীবন শুরু করে।
বয়ন উপন্যাসের মুল্লুকচান অন্তর্দন্দ্বময়তায় পূর্ণ উল্লেখযোগ্য একটি চরিত্র। সাত বছর বয়স থেকে কারিগরের সাগরিদ হওয়া মুল্লুকচান স্ত্রী আয়রননেছার বজ্রাঘাতে মৃত্যুর পর থেকে জামদানী শাড়ি বুনতে পারেনি। স্মৃতিময় অতীত তাকে বিভ্রান্ত করেছে বারবার। বিচূর্ণিত অস্তিত্বের ধারক হয়ে দ্বিতীয় স্ত্রী কমলাসুন্দরীকে গ্রহণ করার পরও অস্বাভাবিক আচরণ দ্বারা নিজেকে রক্তাক্ত করার পাশাপাশি কমলাকেও রক্তাক্ত করেছে। প্রায় এক যুগ আগে ছেড়ে দেওয়া তাঁতের শব্দ এখনো তাকে বিভ্রমে ফেলে। নিচের অংশটি লক্ষণীয় :
“স্বপ্নে কি জাগরণে, ঘুমঘোরে কি তন্দ্রার ভেতর মুল্লুকচান পাখনার ঝাপট শোনে। শুনতে শুনতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে! রাতদুপুরে কখনো নিঁদ টুটে টিনের চালার দিকে তাকালে তার দম আটকে আসে। ওই ঘুটঘুটে অন্ধকার চালার নিচে কি-না পাখির দঙ্গল ওড়াওড়ি করে। ওই উড়ন্ত দঙ্গলের মাঝে কারো কারো পাখনার রঙ এতটাই ধপধপে যে — ঘন রাত্রির শরীরে তা সাদা নয়নতারার মতো ফুটে থাকে! সদ্য ঘুমভাঙা মুল্লুকচান বিভ্রমে পড়ে — ওরা পাখির দঙ্গল না ফুটে-থাকা ফুলদল? অবশ্য কারো কারো পালকের বর্ণ এতটাই নিকষ কালো যে, তাদের অস্তিত্ব বোঝাই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। শুধু পাখনার ঝাপট জানান দিয়ে যায় উড়ন্ত প্রাণকে । ওই রকম ঘন-হয়ে-থাকা অন্ধকারের ভেতরও পাখির দঙ্গলের তীক্ষ ঠোঁট বা ধারালো নখের ভয় মুল্লুকচানকে প্রায় গ্রাস করে ফেলে। তখন দুর্বোধ্য ধ্বনি তার ঠোঁট জোড়াকে কম্পমান করে ফেললে কমলার হাতের মৃদু ধাক্কা টের পায়।” পৃষ্ঠা ১৫
মুল্লুকচানের এ অস্বাভাবিক আচরণ তাকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মোহিতনের কাছে করে তোলে কাকরূপী অশুভ শক্তির প্রতীক। কারিগরের ‘বয়ন্তি’ করানোর জন্য দক্ষ কারিগর মুল্লুকচানের ডাক আসে। সে তাঁতিদের জীবনের সংগীত ধারণ করে নিজ কণ্ঠে, বৃষ্টি দেখে তাদের দুর্ভাগ্যের আশঙ্কা তাকে শঙ্কিত করে তোলে। এই দুশ্চিন্তার মাঝেই উন্মুক্ত আকাশের নিচে দু-হাত মেলে ‘মৃগেল পোনার ঝাঁক’-রূপী বৃষ্টি ধরতে উদ্যত মুল্লুকচানের কণ্ঠে জাগে গান। ঠিক সে-মুহূর্তেই বাজের আগুন পুড়িয়ে দিয়ে যায় তার সর্বশরীর। এভাবেই তার অন্তর্যন্ত্রণার অবসান ঘটে। মুল্লুকচানের মৃত্যুমুহূর্তের বর্ণনা লক্ষযোগ্য :
“মুল্লুকচান ততক্ষণে মৃগেল পোনার বিশাল ঝাঁক দুই হাতের ভিতর পুরে ফেলেছে। ছোট ছোট মাছ বলে তা সামান্য নড়েচড়েই হাতের ভিতরই শব হয়ে উঠছে! এই পোনার শব মুল্লুকচানের দেহে কোনো আবরু দিতে পারে না! লহমায় পুড়ে যায় মুল্লুকচানের সুর! সুর পুড়ে বুকে নামে। বুক থেকে নাভি। তারপর শিশ্ন। শিশ্ন পুড়িয়ে দিয়ে পা বেয়ে মাটিতে ঢুকে পড়ে কমলা-সাদা আগুন! কমলাসুন্দরী আর ফিরোজার চক্ষের সামনে মুল্লুকচানের গান পুড়ে যায়। সুর পুড়ে যায়। পুড়ে যায় সমস্ত দেহ। পুড়ে কয়লা হয়ে যায় কারিগর মুল্লুকচান!” পৃষ্ঠা ২১৩
পাপড়ি রহমান জামদানী শিল্পের সঙ্কটকে শিল্পরূপ দিতে গিয়ে দেখিয়েছেন অনেক কষ্টে বোনা শাড়ির প্রকৃত মূল্যও তাঁতিরা পায় না ‘নিশিকন্যা’-র সাজে সজ্জিত ডেমরার ক্ষণকালের ‘হাদি’-তে গিয়ে। ফড়িয়া, দালাল, পাইকার আর মহাজনদের চাহিদা মিটিয়ে সামান্য অর্থে আশাহত মন নিয়ে ফিরতে হয় তাদের। তবুও তাদের কাছেই তাঁতিদের জীবন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা — সমস্তকিছু বুঝেও নীরব থাকতে হয়। কারণ কাঁচামাল ও বাজার তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর ওপরে রয়েছে বিরুদ্ধ প্রকৃতির পাশাপাশি বয়নশিল্পীদের আত্মকলহ, গ্রাম্য দলাদলি , পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা-বিদ্বেষ। জজমিয়া-নূরমোহাম্মদ দ্বন্দ্ব, কিংবা জজমিয়া-আমান-জামান — তিনভাইয়ের তাঁতচুরি তারই প্রমাণ।
নূর মোহাম্মদের নকশা পরাজিত হয় জজমিয়ার নকশার কাছে। মেয়ে চাঁদবিবির সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন নকশা বোনার প্রতিযোগিতায় নামে সে। কারণ মা আয়শা খাতুন দাদির কাছ থেকে গোপনে দাদা রঙরাজ তুফাজ্জলমিয়ার ‘খত’ পেয়েছিলেন। এটি মায়ের কাছ থেকে পেয়ে রেশম রঙ করার কাজে পারদর্শিতা লাভ করেছিল চাঁদবিবি। এটি দিয়েই নূর মোহাম্মদ জজমিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে চায়। অন্যদিকে জজমিয়ার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে ছেলে সিরাজমিয়া ও মেয়ে ঝুম্পাড়ি। এভাবেই তাঁতিদের শিল্পধারা ক্রমঅগ্রসরমান হয় নব প্রজন্ম-পরম্পরায়।
আকাইল্যা-ঝুম্পাড়ি-ফৈজুমিয়ার ত্রিমুখী সম্পর্কের মাধ্যমে ঔপন্যাসিক বয়নশিল্পীদের জীবনের নতুন দর্শন প্রকাশ করেছেন। নূর মোহাম্মদের কৌশলগত সিদ্ধান্তের কারণে ব্যর্থ হয় আকাইল্যা-ঝুম্পাড়ির বিয়ের সম্ভাবনা। হতাশায় নিঃশেষিত ঝুম্পাড়ির সামনে নতুন জীবনের আলোকময় সত্তা হিসেবে ফৈজুমিয়ার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এভাবেই পাপড়ি রহমানের তাঁতশিল্পীরা জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত হয়েও না থেমে প্রতিনিয়ত সম্মিলিতভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস চালিয়ে যায়। সবেদআলির ভাগ্নে সিদ্দিকআলি তাঁতিদের ঐক্যরক্ষায় সাহসিকতার সঙ্গে নিজ গ্রামে ‘রূপসী তাঁতি সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত করেছে। শুধু তা-ই নয়, তাঁতবোর্ড থেকে ঋণ নিতেও শুরু করেছে তাঁতিরা। কিন্তু এ ঋণ সাপ্তাহিকভাবে শোধ করতে তাঁতিদের যে কষ্ট তা দূর করবার জন্য বিকল্প উপায় আলোচনা করে সবেদআলি। নিজে আর্থিক সহায়তা দিয়ে মুগরাকুলে তাঁতি সমিতি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সিদ্দিকআলি ও ফৈজুমিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে। এভাবেই এগিয়ে চলে তাঁতিদের বয়নের স্বপ্ন। এ স্বপ্নের সঙ্গে ফৈজুমিয়ার অনন্যতা এখানেই যে ঝুম্পাড়ির গর্ভজাত আকাইল্যার সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকার করার মধ্য দিয়ে তাঁতিদের অনৈক্য-অনাস্থার বিপ্রতীপে মানবিক দর্শন সাংগঠনিক রূপ পেল। ঝুম্পাড়িকে বলা ফৈজুমিয়ার কথার মানবিকতার আবেদন কালাতিক্রমী :
“হোনো মানুয়ে মানুর লিগ্যা কান্দে ক্যান জানো? মানু কেন মানুরে মনে রাহে? মানুয়ে মানুর কি মনে রাহে? … মানু মনে রাহে মানুর কাম। মানুর খাইসলত। আর মানুর কথাই হইলো মানুর খাইসলত। খাইসলত যুদি পচা-গান্ধা অয় — কে তুমারে মনে করবো? তুমার কথা যুদি অয় বিষে-ভরা, কে তুমারে লগে নিব? কেউই নিব না। কেউই লগে ভিড়ব না। মানুর লিগ্যা ময়া থাহন আসল কথা। তুমি ময়া না করলে কেডায় তুমারে আর মনে রাখবো?” পৃষ্ঠা ২৪৯
উপন্যাসের মূল স্রোতের সঙ্গে অনিবার্য সম্পর্কসূত্রে আবদ্ধ কেন্দ্রীয় ও মধ্যবর্তী চরিত্র ছাড়াও প্রান্তিক কিছু চরিত্র কাহিনিতে এমন ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি করেছে যে তা কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়। কমলাসুন্দরী, ফিরোজা, পরীবানু, তারাবিবি, মোহিতন, আমান, জামান, সিরাজমিয়া, জামিলা, রেণু, মোমেনা, চারুবালা, সাধু, ভোম্বল, রইসুদ্দি, পরান এমনই সব চরিত্র যাদের মধ্য দিয়ে তাঁতিজীবনের শ্রম, অন্তহীন সংগ্রাম ও স্বপ্নময়তাকে দেখিয়েছেন ঔপন্যাসিক। কমলাসুন্দরী তার দাদির কাছ থেকে জেনেছে তাঁতিদের সমৃদ্ধ অতীত ছিল চরকানির্ভর। দাদির কাছে শোনা শ্লোক এখন শুধুই স্মৃতিময় অতীত। এই সমৃদ্ধ অতীত পার হয়ে ইংরেজ আমলে তাঁতশিল্পের ধ্বংসকাব্য তার কাছেই শুনেছিল কমলাসুন্দরী।
“দেশী সুতার বারোটা বাজিয়ে বিলাতি সুতার কদর বাড়ানোর জন্য কত ফন্দিই না তারা করেছিল! বিলাতি সাহেবদের কোম্পানির লোক অনেক চরকাই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল — যাতে করে কাটুনিরা আর সুতা কাটতে না পারে। শুধু ভাঙাভাঙি করেই তারা ক্ষান্ত হয় নাই-চরকার ওপর চড়া দরে ট্যাক্স বসিয়েছিল। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল — কোম্পানির লোকের আনাগোনার খবর শুনলেই কাটুনিরা পুষ্করিণীর জলে চরকা ডুবিয়ে ফেলত, যাতে চরকা তাদের নজরের আড়াল হয়ে পড়ে।” পৃষ্ঠা ১০০
কমলাসুন্দরী পুকুরের জলে স্নান করতে গিয়ে আনমনা হয়ে আজও জলে কাঠের ঘ্রাণ-সন্ধানী হয়। এরপর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও মুঘল-ইংরেজ আমলের তাঁতিদের উত্তরাধিকার বহনকারী রূপগঞ্জের তাঁতিদের দুর্ভাগ্য ঘোচেনি। পরিবারের সকলে মিলে তাঁতের কাজে যোগ দিলেও দারিদ্র্যের সঙ্গেই নিত্য তাদের বাস করতে হয়। ‘দুইযুগ আগে স্বামী নিরুদ্দেশ হওয়া পরীবানুর মতো অসহায় মা মেয়ে আরজার বিয়ে দিয়ে উপলব্ধি করে ‘পডিতে কারিগরের মূল্য কী!’ এজন্য দ্বিতীয় মেয়ে ফিরোজার বিয়ে দেয় না জীবিকার মাধ্যমে আত্মস্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে। এ সকল প্রান্তিক চরিত্রের জীবন প্রকৃত অর্থে বয়নশিল্পীদের বহির্বাস্তবতাকেই নির্দেশ করছে।
তাঁতশিল্প শুধু নয়, আলাউদ্দিনমিয়া-আতিমুনির জীবনকথায় ভূমিনির্ভর অর্থনৈতিক জীবনচিত্রও উন্মোচিত হয়েছে বয়ন উপন্যাসে। লেখক উপন্যাসের পরতে পরতে তাঁত যন্ত্র ও তাঁতচালনার বিশ্বস্ত বর্ণনা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে পাপড়ি রহমান নিস্তরঙ্গ তাঁতিজীবনের রূপায়ণে বিবর্ণ শীতকাল ও বর্ষাপ্রকৃতিকে বেছে নিয়েছেন যে কাল জামদানী বয়নের পক্ষে ঠিক অনুকূল নয়। তাঁতিদের জীবনে বসন্ত নেই, ক্ষণকালের জন্য সেটা আসে শুধু প্রকৃতিতে :
“ফুল-ফুল-গন্ধ নিয়ে মুগরাকুলে বসন্তকাল ঢুকে পড়ে। এইখানে শীত যেমন আসে তীব্রভাবে, বসন্ত আসে ঠিক ততটাই হালকা হয়ে। মুগরাকুলের বসন্ত মানে প্রজাপতির ডানা, ফুরফুরে আর বর্ণময়। মুগরাকুলের বসন্ত মানে দুরন্ত বাতাসের টানে ডাঙের গুল্লি আসমানে উঠে-পড়া, ওই গুল্লি খুঁজে জোলার ছাওয়ালদের হয়রান হয়ে ঘরে ফেরা।” পৃষ্ঠা ১৬২–১৬৩
কাহিনি বর্ণনার প্রয়োজনে ঔপন্যাসিক মূল ঘটনাকে ৬০টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত করেছেন। তিনি বর্ণনাকে বেশি প্রাধান্য না দিয়ে চরিত্রের প্রেক্ষণবিন্দু থেকে কাহিনিকে উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসের শুরুতে সবেদআলি ছিল তরুণ — পরিণতিতে সত্তরোত্তর প্রৌঢ়। এ দীর্ঘ কালাতিক্রমণের মধ্য দিয়ে জামদানী শাড়ি বয়নের পদ্ধতি থেকে শুরু করে তাঁতযন্ত্রের নাম, রঙ তৈরিসহ হাটে বিক্রি পর্যন্ত সকল বিষয় উঠে এসেছে উপন্যাসে। পডিঘর, জুইতাশ, তলপাওড়, নরত, সানা, দকতি, নাচনি কাঠি, তলপাওড়, মাকু, কাণ্ডুল, নলি, পারি-করা, নাটা-করা, বীমের রেশম, বাইনের রেশম, বাইটের রেশম, বুটা, জাল, তেসরী নকশা, ডালিম তেছরি, পোনাফুলে ঘুড্ডিপাইর, গোলাপচরপাড়-জুঁইফুল, কাঁচিপাড়-পোনাফুল, চালিতাপাড়-বড়লাঙ্গইল্যা, বিশকরমের ব্রত, বয়ন্তি, গুড়িচাপী, হজগীতি শব্দগুলো এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যে মনে হয় প্রতিটি বিষয় ঔপন্যাসিকের স্বজীবনের অভিজ্ঞতালোক থেকে উৎসারিত হয়েছে।
তাঁতশিল্পীদের অন্তর্জীবন ও বহির্জীবন, অতীত-বর্তমান, বিশ্বাস-সংস্কার প্রকাশে পাপড়ি রহমানের বয়ন উপন্যাসের ভাষারীতি হয়েছে কবিত্বময়। বিভিন্ন চরিত্রের অন্তর্ময়তার চিত্ররূপ হিসেবে এ উপন্যাসে রূপ, বর্ণ ও ঘ্রাণকল্পের মিথস্ক্রিয়ায় দৃশ্যশিল্প ও শব্দশিল্পের এক আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছে। সবেদআলির বিপন্ন অস্তিত্ব প্রকাশের প্রয়োজনে “ধুলার না-সোঁদা, না-ধুলাটে, না-মাটিমাটি গন্ধযুক্ত” (পৃ.১১৩) ‘বাওকুড়ানির ঝামটা’-র ধুলোমাখা ঘ্রাণনির্ভর চিত্রকল্প বারবার ব্যবহার করেছেন ঔপন্যাসিক। এ চিত্রকল্প সবেদআলির কাছে যে-কোনো দুর্ঘটনার সংকেতবাহী। বর্ণনির্ভর চিত্রকল্পে ‘বাদামী জমিন’,‘কমলারঙা ঘোর’, ‘রোদের কুসুম কুসুম উত্তাপ’, ‘আলোর রুপালি রঙ’, ‘সাদা নয়নতারা’,‘কালোকেশর-মাখা চুল’, ‘সবুজ-রঙা লিকলিকে সাপ’, ‘মরচেরঙা পালক’, ‘সাদা-কালো-সুর্মারঙা’, ‘ সূর্যের কমলারং গায়ে-মাখা মেঘ’, ‘কমলার সঙ্গে সবুজ,সাদার সঙ্গে লাল, আসমানীর সঙ্গে হলুদ, গোলাপির সঙ্গে নীল, বেগুনির সঙ্গে কালো’, ‘দুধ-সাদা পাখি’, ‘ডিমের-কুসুম-চাঁদ’, ‘সবুজগন্ধ’, ‘গোলাপি ফিতার পদ্মফুল’, ‘শিমুলের সিন্দুর-লাল’, ‘এই রঙ নীল তো নীল — এক্কেবারে গাঢ় নীল’, ‘পাত্থর-কালো রঙ’, ‘কমলা-সাদা আগুন’ — অপূর্ব ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে।
পয়রনবিবির অন্তর্দাহ, দক্ষ কারিগর মুল্লুকচানের আয়রননেছাকে কেন্দ্র করে অবচেতন মনের বিভ্রম কিংবা আতিমুনির রক্তাক্ত জীবনাভিজ্ঞতানির্ভর অন্তর্মনস্তত্ত্ব বর্ণনায় ঔপন্যাসিক অন্ধকারের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার করেছেন। সবেদআলির জন্য অবচেতনে লুকায়িত আবেগ, মনোময় সংবেদনা ও অন্তর্জগতের অবরুদ্ধ কান্না নিয়ে আলাউদ্দিনমিয়ার সংসার ছেড়ে পিতৃগৃহ তারাবো-অভিমুখী আতিমুনির উৎকণ্ঠাগত চেতনাময় প্রেক্ষণবিন্দু অন্ধকারের চিত্রময়তায় রূপকথার আশ্রয়ে উপস্থাপিত হয়েছে নিচের অংশে :
“ভাল্লুকের লোমের মতো কালো-কোমল অন্ধকারে আতিমুনি হোঁচট খেয়ে রক্তাক্ত হয়। পা কেটে যায়। নাক উল্টে যায়। দাঁত-মুখ-চেপে ভয়ানক যন্ত্রণা সহ্য করে আতিমুনি দেখে তার পায়ে আর আঙুল নাই! পাতা নাই! পায়ের গোড়ালি নাই! এমনকি হাঁটু নাই! এতসব কখন নাই হলো? আতিমুনির দুই পা নাই হয়ে সেখানে কোতলা মাছের মতো বিশাল লেজ গজিয়েছে! আতিমুনির কোমর থেকে পা অব্দি মাছের আকৃতি পেয়েছে! আতিমুনির গতর থেকে ভুরভুর করে মাছের আঁশটে গন্ধ ছড়ায়। হায়! হায়! এইডা কেমতে অইলো? ছোডুকালে মায়ে মাছকইন্যার বয়ান দিছিল- দারুণ রূপবতী এক মাছকইন্যা! … আতিমুনি পিছলা লেজের ঝাপটে জল কেটে সাঁতরে চলে সামনে। তার সাঁতারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশের মেঘদলও ভেসে চলে। কিন্তু আতিমুনির গন্তব্য কোথায়? কতদূর যাবে সে? কেন সাঁতরে চলেছে এই নদী? সে কি মাছকন্যা নাকি জলকন্যা নাকি জলের পরী? জলপরী কি ভাসতে ভাসতে খুঁজে পাবে দিঘীবরাবোর সংসারের ঠিকানা? অনেকদিন বসবাস করা ওই ঘর? খুঁজে পাবে আলাউদ্দিনমিয়ার সজল চক্ষু? অথবা এক ঠকবাজ মানু – তার দেখা কি সে পাবে এই দীর্ঘ জলসাঁতার শেষ হলে?” পৃষ্ঠা ১৮৮–১৮৯
এভাবেই ঘটনার সমষ্টি না হয়ে চরিত্রের অন্তর্বাস্তবতাপ্রকাশক চিত্রময় ইমেজগুচ্ছে রূপান্তরিত হয়েছে বয়ন উপন্যাস।
সমাজের প্রান্তজনের বাস্তবতাকে গ্রহণ করার জন্য পাপড়ি রহমান বয়ন উপন্যাসে আঞ্চলিক ভাষাকে ব্যবহার করলেও উল্লেখিত বিশেষ অঞ্চলের ভাষার যথাযথ প্রয়োগ পুরোপুরি আসেনি, তবে এটা খুব একটা দোষণীয় নয়। কারণ শাহরিক জীবনের মানগদ্যের চাইতে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের ফলে বয়নশিল্পীদের জীবনের বহির্বাস্তবতা ও অন্তর্বাস্তবতা অনেক বেশি সত্যাশ্রয়ী হয়েছে। এটা আমরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসেও লক্ষ করেছি। জোলা-তাঁতি সম্প্রদায়ের জীবনের ইতিহাস, স্মৃতি, ব্যর্থতাকে প্রকাশের প্রয়োজনে লোককথা, পেশাভিত্তিক কর্মসঙ্গীত ও শ্লোকে সমৃদ্ধ হয়েছে বয়ন উপন্যাসের ভাষারীতি।
সবদিক বিবেচনায় বলা যেতে পারে, কালিক প্রবাহের পরিবর্তমানতায় বয়নশিল্পীদের বহির্বাস্তবতা আলোচ্য উপন্যাসে অধিকতর বাস্তব রূপ পেতে পারত যদি তা সমকালীন ইতিহাস, রাজনীতি ও আর্থনীতিক বাস্তবতার সঙ্গে সমীকৃত হতো। টেলিভিশনে বাংলা সিনেমা দেখার প্রসঙ্গ উপন্যাসে উত্থাপিত হয়েছে ঝুম্পাড়ির সঙ্গে আকাইল্যার কথোপকথনে। অথচ ১৯৪৩-৪৪ সালের মন্বন্তর, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের অভিঘাত থেকে মুগরাকুল সহ উপন্যাসের স্থানিক পরিসরের যাপিত জীবন বিচ্ছিন্ন দূরবর্তী দ্বীপের মতো রয়ে গেল। তবু বয়নশিল্পীদের সংগ্রামী জীবনরূপের মধ্য দিয়ে তাদের বহির্জীবন ও অন্তর্জীবনের শিল্পরূপ সৃষ্টিতে পাপড়ি রহমান যে নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন তা সর্বকালীন তাঁতশিল্পের সঙ্কট ও সম্ভাবনাকে মূর্ত করেছে।
… …
- বয়ন : প্রান্তজনের কথকতা || পারভীন আক্তার - September 11, 2018
COMMENTS