রাষ্ট্রের নিঃসঙ্গ কবি কিংবা এই সারিন্দা আমার || সরোজ মোস্তফা

রাষ্ট্রের নিঃসঙ্গ কবি কিংবা এই সারিন্দা আমার || সরোজ মোস্তফা

শেয়ার করুন:

 

একরামের দুই মেয়ে

সোনালি বুলেট অপনাকে হাজারো সেলাম!
এই রমজানে বুট-বড়া, আঙুর-মাল্টার বদলে
আব্বার ডেডবডিটার সামনে বসে আছি।

ক্রসফায়ারে ডেডবডিটা
আরবের আজুয়া খেজুর হয়ে ফুলে আছে।
দয়া করে এই দামি খেজুরটা
আমাদের খেতে বলবেন না।
দেখুন না, আমরাও রাষ্ট্রের দাস
ঘাসের উপরে করি বসবাস।
আব্বার ছিদ্রশরীরে ভনভন করছে মাছি!
সোনালি বুলেট আমরা কি মাছি তাড়াতে পারব?
মাথার উপরে একটা শামিয়না টানাতে পারব?
আব্বার মাথাটা ঘাসের উপরে রেখে আসতে পারব?

আপনাদের কী দয়ালু মন!
বারুদ-বসানো শরীরটা
আপনারা সন্তানকে উপহার দিয়েছেন।
সে-দেহের চারপাশে আগরবাতি
সে-দেহের চারপাশে জলজ ফুলের বিষণ্নতা!
গোলাপজলের পবিত্রতায় এই লাশগুলোকে দেখুন
লাশগুলো জাম্বুরা ফুলের আদর চাইছে।
লাশগুলো শিমুল তুলার বালিশে শুতে চাইছে!
দুনিয়ায় ফিরতে চাইছে!

রেস্ট পিরিয়ডে জামা খুলে
আপনারা কি কখনো ঘুমুতে পারেন?
জৈষ্ঠ্যের গাছগুলোর সাথে
আপনারা কি কথা বলতে পারেন?
রস-নিংড়ানো ছায়াকে কি আলিঙ্গন করতে পারেন?
আপনাদের শর্ট মোজায় নিশ্চয়
নির্গত রক্তের অভিশাপ।
মাংসের দোকানে গিয়ে আপনারা কি
মানুষের মাংস কিনে আনেন?
একটা কল্লায় কয় কেজি স্বপ্ন থাকে
বলতে পারেন সোনালি বুলেট!

বারুদমাখানো ডেডবডি গোসল করাতে কষ্ট হয় খুব!
খুলির ছিদ্রতে সমুদ্রলবণ!
খুলির ছিদ্রতে সাবানের ফেনা।
সে-ফেনা মুছতে অনবরত ভিজতে থাকে
একরামের দুই মেয়ে।
কন্যাদের চোখ দেখে বাংলাদেশ ঘুমাতে পারে না।

২৯ মে ২০১৮

 

দোকানি

যে-কোনো শহর চেনা যায় রাতে!
রুটির দোকানে।
আলাদা আলাদা জটলায়
ডাল-রুটি খেয়ে
মতলব ও প্রেমিক
কোথায় যে যায়!
দিকে দিকে চুলার আগুন!
এ পৃথিবী তেলে ভাজা রুটি!
দোকানি ঘুমায় না। দেখে।
১৯ মে ২০১৯

 

রাষ্ট্রের নিঃসঙ্গ কবি

কারো ইশারায় ওঠানামা করে এ-জাতির মেরুদণ্ড।
মৃত মগরার রোমান্টিসিজমে
আমি শহরে চক্কর দিই।
খলনির্ভর হাসিতে
শহর একটা শূয়রের স্মার্টনেস।
শহর একটা জোকারের লাইসেন্স।
তবু কাপড়ের দোকানের
এই সেলাইমেশিন বেশ ভালো।
লজ্জা-শরমের অনেককিছুকে
ওরা সেলাই করতে পারে।
ডিসেম্বর ২০১৭

 

এই শোকে

কী দেখবে বর্ষা ঋতু!
খরগোশের তাকানো, নাকি বিহারি পল্লির আর্তনাদ!
একটু একটু করে শুকিয়ে গিয়েছে মরমি গাছের ধ্যান!
এই নদী বাঁচবে না মরবে ওরাই নির্ধারণ করবে।

শাই করে চলা বাইকের আওয়াজে এখন ব্যাকুল অপরাধ।
এত এত খুন, গুম আর নষ্ট হলে মেঘের জীবনী
হরিণ যেভাবে তাকাচ্ছিল
সেখানেই শেষ হয়ে গেছে সৌন্দর্যের আয়ু।
সন্ত্রাসী পাখিরা অনেক ভূগোলে ওড়ে
শপিং মলে চিত্রবিচিত্র পিস্তলে
নিম্নধ্বনি শিশুরাও অস্বাভাবিক
দরজা-জানালা ভর্তি শোক।
এই শোকে রূঢ় শীতকালে
স্তব্ধ হয়েছে পাড়ার কামিনী ফুল।
১৯ জুন ২০১৪

 

খুনি

গ্রামের ভেতরে খুনি,
শাপলাপুকুরে ধুয়ে ফেলে রক্তাক্ত চেহারা।
তবু, ফিজিক্যালি খুন হলে কেউ
জংলার পাখির উড়ালে গাছের পাতারা নড়ে।
শালিকের ক্যামেরাগিরিতে
দৃশ্য হয়ে থাকে বকুলগাছের মন।

বাড়ি ফিরে ডায়রি লিখেছে যারা
তারার লিখে না কিছু।
না-লেখার ছটফটে
মিলনমুহূর্তে শুধু কাঁদে।
বাঁচে। শস্যের মাটিতে
পলায়ন করে বহুবার।
১৫ জুন ২০১৪

 

যুক্তাক্ষরে

গোহালঘরের যুক্তাক্ষরে, দরজায়, ঢাকনায়
গৃহস্থেরা রেখে দেয় জলজ জ্যোৎস্না
জাদুটোনা সহ লিখে রাখে জানা-অজানা নয়নতারা।
অশ্বত্থবৃক্ষেরা নীরবে দেখেছে
সময়চিহ্নের ধবল জোনাকি, অনটন, পাখিমৃত্যু।
পতনের কালে ডানে-বামে জেগে থেকে
দাঁড়াজ সাপের নাচে পড়শিরা আসে ধাক্কা দিতে।
আসন্ন আষাঢ়ে বিস্তারিত কদমের ঘ্রাণে
পাশাপাশি থাকলেও সখ্যরীতি ধুয়ে যায়।
সম্পর্কের রঙে পাশাপাশি থাকলেও
হালুয়ার প্লেট শুধু থাকে।
গৃহস্থ বাড়ির আঙিনায়
মনখারাপের পেঁয়াজ-রসুনে ধুয়ে যায় সব।
১৪ জুন ২০২৪

 

শরবতের গ্লাসে

শরবতের গ্লাসে এ কোন সন্ধ্যা!

ইফতারের সময় ভাই হয়ে কেমনে ভাইকে গুলি করলা! মাবুদ, ছোট মেয়েটা তখন শরবতের গ্লাস নিয়া ওরে ডাকতেছিল। ওরে পিস্তল না দিয়ে একটু পানি দিতে পারতা। খুনির লিস্টিতে নাম স্থাপন করলেও তোমরা জানতা, দিন শেষে রোদমাখানো আত্মাটা লেবুর ফ্লেবারে বরফকুচিতে ভাসে। পানিতে ভিজতে ভিজতে দিনশেষে নামাঙ্কিত ফুসফুস নিজের পাগড়িতে সুন্দর! সেই আত্মা ছিদ্র করে দিলা! চিনির শিরার মতো গড়িয়ে পড়ছে রক্ত! কে থামাবে রক্ত! জানি, তোমরা রক্ত বের করতে জানো! রক্ত থামানোর রক্তটিপ তোমাদের নেই। ভূগোলবইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায় আজ মেহগনির তক্তার মতো পড়ে আছে লাশ! রক্ত বেরোনোর পর মাটির নামোনো ঘরে আশ্রয় নিয়েছে সহোদর! মাটির দরদে মাটি সবাইকে রাখে! নদীর দরদে নদী মোছে শ্যাওলামাখানো দিন।

করলাফুলের সাথে মাটিতে নামছে আযানের ধ্বনি! জানালার পর্দা ঠেলে ছোট মেয়েটা তখনো আব্বাকে ডাকছে। ওর আব্বা বিশাখা প্রকাশনীর নিঃশ্বাস! ওর আব্বা একটা টগর! ওর আব্বা কাব্যের মলাট! খুলি ফেলে আততায়ীগণ খুলি হতে যাচ্ছে। সবাই লাশ দেখছে! রক্তজবার পবিত্র লাল লাশ। পবিত্র জোনাকি সবাইকে পথ দেখায়! আত্মজা নামের সাদা হরিণটা কোথায় পৌঁছুবে
১২ জুন ২০১৮

 

মাপ

যে-পরিমাণ কবর আছে
তারো চেয়ে বেশি কবর খুদতে হবে।
মাটির অভাবে একের উপরে অন্যকেও
শুইয়ে রাখতে হবে।
আব্বার কবরে আম্মা
পাখির কবরে পাখি
খুনির কবরে খুনি।
এমন মুহূর্তে মাটি সব মীমাংসা করে।
আল্লাহ তাকিয়ে খুঁজবেন
পৃথিবীতে মুমিন কোথায়?
মোনাজাতে কার চোখ অশ্রুতে ভেজায়?
গাঙের তেলতেলা পানিতে
গুইঙ্গা মাছের মতো
বান্দাগণ স্বার্থ ও নীরবতায়
যে যার মতন দোয়া করে
নিজের পাঞ্জাবি রেখে
অন্যের পাঞ্জাবিতে আতর খোঁজে।
কবর মূলত মাপ।
সেখানে একজনের মাপে
অন্যকেও রাখা যায়।

২৯ এপ্রিল ২০২১

 

আজ মে দিবস

মাথায় পেঁচিয়ে লাল কাপড়ের ধ্বনি
ওরা বলছেন, শ্রমিক! শ্রমিক!
আজ মে দিবস।
যারা বলেছেন, ‘কবিতা দুর্বোধ্য’
নীরব চোখের শ্রমিকদেরকে
আজ কী বুঝবেন তারা!
ওদের আঙুলে প্রাচীন শতাব্দীর যন্ত্রণা।
ধানগাছের উপরে শালিকপাখির চোখ দেখে
আপনারা যারা কবিতা বুঝি না বলেন,
তারা কীভাবে বুঝবেন এদের আঙুলে নরম মাটির সুবাস।
০১ মে ২০১৪

 

মেঘগুলো

নাক লম্বা মেঘগুলো একটু পরেই নামবে!

পুকুর ভরতি আনন্দে
খলিশামাছের নাচানাচি দেখে মনে হচ্ছে
টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িতে ওর দ্বিতীয় জন্ম হয়েছে!
পুরো পুকুরটা একার করে নিয়েছে!
ওর মা ও বড়বোনেরাও
এভাবেই নাচতে নাচতে
প্রসন্ন ভূমিতে নিখোঁজ হয়েছে।

গুম-খুন, ক্রসফায়ারের কালো দিবসেও
নৌকা ভরতি বরযাত্রী।

সাজানো প্যান্ডেলে বিয়েবাড়ি।
শামিয়ানার তলায় বড় বড় ডেকচিতে
বাবুর্চি রান্না করছে।
পুরো গ্রামে সানাই নামছে!
২৮ ডিসেম্বর ২০১৭


সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপার কবিতার, কবিতার গানপার

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you