ভাষা ও দেশের গান : ৫২ থেকে ৭১ || মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী

ভাষা ও দেশের গান : ৫২ থেকে ৭১ || মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী

১৯৪৭-এর পর থেকে পাকিস্তানী শাসকচক্র নানাভাবে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানকে শোষণ-নিপীড়ন এবং সেইসঙ্গে তার স্বাধিকারচেতনা ও সাংস্কৃতিক ধারাকে দাবিয়ে রাখার প্রয়াস চালিয়েছে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ঘোষণা করলেন, “উর্দু, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।”  প্রতিবাদে গর্জে উঠল বাংলার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” — এই দাবিতে সোচ্চার হলেন বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, কবি, সাংস্কৃতিক কর্মী সহ বাংলার মেহনতি মানুষ। শুরু হলো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। এই উপলক্ষ্যে গীত হতে থাকল উদ্দীপনামূলক ও দেশাত্মবোধক গান। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের গান হয়ে উঠল হাতিয়ার। এই সময়ে একক ও সমবেত কণ্ঠে রবীন্দ্র-নজরুলের গান গীত হতে থাকল — বাংলার আকাশ-বাতাসে উত্তাল আলোড়ন তুলল। এই সময়ে গীত হলো —

  • বাঁধ ভেঙে দাও
  • আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে
  • ও আমার দেশের মাটি
  • সার্থক জনম আমার
  • কারার ঐ লৌহ কপাট
  • শিকলপরা ছল
  • দুর্গম গিরি কান্তার মরু
  • ও খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি
  • এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায়

তেমনিভাবে চারণকবি মুকুন্দ দাশের গান উদ্দীপ্ত করেছে বাংলার মানুষকে; — যেমন, তার দু-একটি গান এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে —

  • বান এসেছে মরা গাঙে
  • ভয় কি মরণে

ভাষাপ্রীতি-দেশপ্রেমের জোয়ার বইতে লাগল সমগ্র দেশে। চারণকবি-লোককবিরা গান বাঁধলেন গণজাগরণের, আত্মবোধনের, আত্মজাগরণের।

ঐতিহাসিক বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। ছাত্রজনতার মিছিলে খুনী শাসকচক্র চালাল গুলি। মায়ের মুখের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সেদিন শহিদ হলেন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত। ভাষার জন্য এত রক্তপাত, ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু, ভাইহারা বোনের কান্না বিশ্বের ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তাদের এই আত্মত্যাগে আজ আমরা মুক্তস্বাধীন। গর্ব হয় আজ, একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে — শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে ১৮৮টি দেশ — শহিদের আত্মত্যাগে অর্জিত মোদের গরব মোদের আশা ‘বাংলা ভাষা’।

ভাষা-আন্দোলন ও বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্য করে বেশকিছু গান রচিত হয়েছে। লোককবি-পল্লিকবিরা গান বাঁধলেন —

  • রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি রে বাঙালি
  • ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়

বায়ান্নর একুশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে আছে সেই বিখ্যাত গান — আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচিত এবং আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত সেই গান —

  • আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
  • আমায় গেঁথে দাও না মাগো

১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত আইয়ুবশাহির কালো দশক, — একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র চেপে বসল বাংলার বুকে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাকে পঙ্গু করে দিতে চাইল আইয়ুবী শাসন। রুখে দাঁড়াল বাংলার মানুষ। অবিসংবাদিত মহান নেতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে কেঁপে উঠল পাকিস্তানী শাসক আইয়ুব খানের মসনদ। শেখ মুজিব ঘোষণা দিলেন ঐতিহাসিক ছয় দফা আর এগারো দফার ভিত্তিতে বাংলার মুক্তিসনদ। আইয়ুব খান সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিলেন। শুরু হলো একদিকে স্বাধিকার ও অন্যদিকে স্বাধীনতার সোচ্চার-সরব আন্দোলন। তীব্রতর হয়ে উঠল আন্দোলন। পাকিস্তানী সেনাদের বর্বরোচিত নির্যাতন-নিপীড়ন তুচ্ছ করে লাখো ছাত্রজনতা গর্জে উঠল। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের কাছে হার মানতে হলো শাসকচক্রকে। বাংলার দাবির কাছে সাময়িকভাবে সাময়িকভাবে মাথা নোয়াতে হলো ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসকচক্রকে।

সত্তরের নির্বাচন দেয়া হলো। বঙ্গবন্ধুর মহান নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল আওয়ামী লীগ। আবার চক্রান্ত হলো, গোলটেবিল আলোচনাচক্রের আড়ালে নিয়ে আসা হলো সামরিক বাহিনী বাংলায়। ইয়াহিয়া-ভুট্টো-মুজিবের আলোচনা ভেস্তে গেল। বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতিকে দিকনির্দেশনা দিলেন; ডাক দিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

পঁচিশে মার্চ কালো রাতে হানাদার পাকবাহিনী নৃশংসভাবে আক্রমণ চালাল নিরস্ত্র বাঙালির মানুষের ওপর। বাংলার আপামর জনতা ‘জয় বাংলা’ স্লোগ্যান দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মুক্তিসংগ্রামে। মেহনতি মানুষ, ছাত্র-শিক্ষক-জনতা-বুদ্ধিজীবী-শিল্পী সবাই যোগ দিলেন মুক্তিবাহিনীতে। সাড়ে-সাতকোটি মানুষ মুক্তিযোদ্ধা। আকাশে বাতাসে দিকে-দিকে বঙ্গবন্ধুর তেজোদ্দীপ্ত বজ্রকণ্ঠের উদাত্ত আহ্বান বুকে নিয়ে নয়মাস তিরিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে শতসহস্র মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতার সূর্যোদয় হলো পূর্বদিগন্তে — স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়। ষোলো ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। একসাগর রক্তের বিনিময়ে তিরিশ লাখ শহিদের আত্মত্যাগের ফসল এই স্বাধীনতা — বাংলার আকাশ-মাটি-নদী-নিসর্গকে ভালোবেসে, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে, সেই রূপ স্মরণ করে স্বাধীন ও মুক্ত দেশে জাতীয়ভাবে গান গাই — “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।”

______________________________

লেখক ও লেখাটি বিষয়ে একপ্রস্থ

[সংগীতশিল্পী, সংগীতগবেষক ও সংগীতশিক্ষক ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী (Mridul Kanti Chakrabarty)। ইন্তেকাল করেছেন ১৫ অগাস্ট ২০১১।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীতবিভাগ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তিনি সেখানে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন, আমৃত্যু ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলেন সংগীত-অধ্যয়নরতদের কাছে এক আদর্শ ও প্রিয় শিক্ষকমূর্তি। টিভিপ্রোগ্র্যামগুলোতে তাকে দেখা যেত সংগীত বিষয়ে কথা বলতে, সংগীতের বিচিত্র ধারা-উপধারা আলোচনার পাশাপাশি বিশেষভাবেই লোকসংগীত বিষয়ে তাকে কথা বলতে দেখা যাইত হামেশাই, তিনি ছিলেন সিলেট ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের লোকসংগীতের একজন তথ্যজ্ঞ ও অনুরাগী।

Mridul Kanti Chakrabartyবি-মিউজ ও এম-মিউজ সম্পন্ন করেন ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী থেকে এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি পিএইচডি লাভ করেন। গবেষিত অভিসন্দর্ভের বিষয়টি ছিল ‘বাংলা সংগীতের ধারা ও লোকসংগীতের সুরে রবীন্দ্রসংগীত’ (অষ্টম থেকে বিংশ শতাব্দী)। শান্তিনিকেতনে অবস্থানকালীন তিনি নানা সংগীতগুণীজনের সংস্পর্শে আসেন। পুরাতনী বাংলা গান ও রবীন্দ্রসংগীত এবং রাগসংগীতে তালিম নেন স্বর্গীয় মন্মথনাথ রায়, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহন সিং খাঙ্গুরা, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, গোরা সর্বাধিকারী, মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়, ভিভি ওয়াঝলওয়ার, দেবেন দাস বাউল প্রমুখের কাছে। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত সংগীতশিল্পী হিসেবে যুক্ত হন।

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় মৃদুলকান্তি বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ঘুরে ঘুরে মুকুন্দ দাশ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান করে উৎসাহ জুগিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদেরে। এই সময় তিনি ‘বাংলাদেশ বুলেটিন’ নামে একটি পত্রিকা বিক্রি করে যে-অর্থ সংগ্রহ করতেন তা জমা দিতেন তৎকালীন ন্যাপনেতা প্রয়াত পীর হাবিবুর রহমানের কাছে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে সিলেট বেতার কেন্দ্রে তিনি নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করতেন।

‘সুরশ্রী’ নামে একটা বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন। বই লিখেছেন তিনি মিউজিক বিষয়ে বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। এর মধ্যে ‘হাসনরাজা : তাঁর গানের তরী’, ‘বাংলা গানের ধারা’, ‘গানের ঝরনাতলায়’, ‘লোকসংগীত ও স্বরলিপি’, ‘রবীন্দ্রসংগীত ও স্বরলিপি’, ‘দেশাত্মবোধক গান ও স্বরলিপি’, ‘রবীন্দ্রনাথ : পূর্ববঙ্গে লেখা গান’, ‘সংগীত সংলাপ’, ‘হাজার বছরের বাংলা গান’, ‘বাউলকবি লালন ও তাঁর গান’ প্রভৃতি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। রয়েছে বেশকিছু শ্রুতিপ্রকাশনা : ‘অধরা মাধুরী’ (রবীন্দ্রসংগীত), ‘সুরশ্রীবাদন’ (রাগসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, লোকসংগীত ও আধুনিক গানের সুর) ‘হারামানিক’ (হারিয়ে-যাওয়া লোকগান ও লোকসুর নিয়ে ৫টি কণ্ঠসংগীত, উদ্ভাবিত যন্ত্র সুরশ্রীতে ২টি লোকসুর পরিবেশন)।

১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে সুনামগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন মৃদুলকান্তি। পিতার নাম মনোরঞ্জন চক্রবর্তী এবং মাতা দীপালী চক্রবর্তী।

ইন্তেকালের অর্ধযুগ পেরিয়ে গেলেও মৃদুলকান্তিস্মৃতিগ্রন্থ অথবা তার আজীবনের রচনাসংগ্রহ প্রকাশে এখনও কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। অথচ কত অসুরেরও প্রয়াণপরবর্তী বিতিকিসিমের শোক-স্মারক প্রকাশে ধেই ধেই দেখি আমরা। আশা করতে পারি শুধু যে একদিন মৃদুলকান্তির রেখে-যাওয়া লেখাপত্র লইয়া অ্যান্থোলোজি আউট হবে এবং সেইসঙ্গে একটা স্মারক পুস্তকও। তখন নিশ্চয় মৃদুলের অগোচরিত রচনাগুলোও কুড়িয়ে আনা হবে নানান সোর্স থেকে। এইখানে তেমনই একটা রচনা আমরা কালেক্ট করে এগিয়ে দিচ্ছি। মনে হয় না এই রচনাটা তার কোনো প্রকাশনায় তিনি নিয়েছেন।

রচনাটা ‘সাঁই’ শীর্ষক একটা কাগজ থেকে আমরা আহরণ করেছি। ২০০১ সনে ছেপে বেরোনো লোকসংগীত ও লোকসাহিত্য বিষয়ক মননানুশীলনের পত্রিকা ‘সাঁই’ উজ্জ্বল দাশ কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত। সম্ভবত ওই একটা সংখ্যার পরে এইটা বাইর হয় নাই আর। সম্পাদকীয় যোগাযোগে দেখা যাচ্ছে লেখা আছে এইটা সুরভী#৪/এ টিলাগড় সিলেট ৩১০০ থেকে বেরিয়েছিল। মোটমাট তিনফর্মা কাগজের ভিতরে আটটা রচনা আঁটানো। ওই পত্রিকার পয়লা লেখাটাই মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীর। নতুন পর্যায়ে মুদ্রাক্ষরিকের প্রয়োজনীয় প্রুফকাজটুকু ছাড়া আর-কোনো সম্পাদনা করা হয় নাই এখানে। একেবারে হুবহু ছাপা হলো।

খুব-একটা কাজের না হলেও, সংগীত নিয়া আদৌ কোনো ধর্তব্য কথা না বললেও, সংরক্ষণদায় থেকেই রচনাটা গানপারে রাখা হচ্ছে। এবং আশা করছি স্মৃতিগ্রন্থ প্রণয়নে মৃদুল-অনুরাগীরা আগাইবেন অচিরে। — গানপার]

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you