মকর সংক্রান্তি : পৌষ শেষের পার্বণ || অসীম চক্রবর্তী

মকর সংক্রান্তি : পৌষ শেষের পার্বণ || অসীম চক্রবর্তী

শৈশবে আমাদের অন্যতম উদযাপনের দিন ছিল পৌষ সংক্রান্তি । পৌষ মাসের শেষ দিনে পিঠাপুলি, মাছ, কদমা, তিলের তিলু (খাজা) আর মেলা। নতুন বছরের শুরু, নেই পড়ালেখার চাপ। সব মিলিয়ে একেবারে মচ্ছব যাকে বলে।

বার্ষিক পরীক্ষার শেষদিন থেকেই শুরু হতো দিন গোনা। সেইসাথে শুরু হতো আমন ধানের নাড়া সংগ্রহের পালা। নাড়াকে সিলেটে বলা হয় নেরা। নেরা সংগ্রহ অতীব দুরূহ কাজ, কিন্তু বাঁধভাঙা শৈশবে দলবেঁধে নেরা সংগ্রহ ছিল অন্যতম আনন্দদায়ক কাজ।

হয়তো ভাবছেন পৌষ সংক্রান্তির সাথে নেরার সম্পর্ক কি? ধৈর্য ধরুন, ইহা ক্রমশ প্রকাশ্য।

শৈশবে পৌষ সংক্রান্তির অন্যতম আকর্ষণ ছিল রাজা বানানো। জমানো নেরা বাঁশের সাথে পেঁচিয়ে পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন তৈরি করা হয় অনেক লম্বা মানব-আকৃতির একটা দেহ এবং সেই বাঁশ পুতে দেওয়া হয় মাটিতে। তারপরে চারপাশ দিয়ে নেরার স্তূপ তৈরি করা হয় অনেকটা খড়ের গাদার মতো (এই বিষয়টি এলাকাভেদে ভিন্ন)। পৌরাণিক মহাভারতীয় কাহিনি অনুসারে এই দিনই নাকি পিতামহ ভীষ্ম তার শরশয্যায় দেহত্যাগ করেছিলেন। আর এই খড়ের তৈরি মানব-আকৃতিটিই হচ্ছে পিতামহ ভীষ্মের শবদেহ। এই দিন থেকে সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয় বলে ধারণা করা হতো।

পৌষ সংক্রান্তির দ্বিতীয় আকর্ষণ ছিল মাছের মেলা। স্থানীয় বাজারে বসত মাছের মেলা। হরেক রকম বড় বড় মাছ। একবার, মনে আছে, বিশাল সাইজের একটি বোয়াল মাছ কেনা হলো যার দৈর্ঘ্য ছিল আমার উচ্চতা থেকেও বেশি। বাবার সাথে বাজারে যাওয়ার সুবাদে থাকত না কোনো সময়ের বাধা। সূর্য ডোবার পরে বাজার থেকে ফিরলেও মা কিছু বলতেন না। সন্ধ্যার পরে বাজার থেকে মাছ কিনে বাবার সাথে বাড়ি ফিরতাম। এর মধ্যে মা তাঁর পিঠা তৈরির কর্মযজ্ঞ গুছিয়ে নিয়েছেন। মৌ মৌ করা পিঠার গন্ধ চলে গেছে একেবারে বাড়ির রাস্তা পর্যন্ত। বাজার থেকে ফিরেই বড় দাদারা পেট্রোমাস বা পাম্পলাইট জ্বালিয়ে দিতেন বাড়ির উঠোনে। আমরা সবাই গোল হয়ে বসে পাম্পলাইট জ্বালানো থেকে শুরু করে মাছকাটা পর্যন্ত দেখতাম আর হৈহুল্লোড়ে বাড়িটাকে মাথায় তুলে দিতাম নিমেষে। আমাদের শৈশবে পাম্পলাইটের এক অদ্ভুত মাতাল-করা গন্ধ ছিল, যে-গন্ধ জানান দিত উৎসব উদযাপনের, যে-গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে আমরা হুলুস্থুল করতাম গভীর রাত পর্যন্ত।

তারপর ভরপেট খেয়ে ঘুম। ভোরবেলা সূর্য উঠার আগেই বাবার ডাকে ঘুম ভাঙত। সবাই মিলে কনকনে শীতের মধ্যে গায়ে তেল-মালিশ করে চলে যেতাম বাড়ির পাশের দেওরভাগা নদীর শুকিয়ে যাওয়া কোমরজলে। “ওম গঙ্গে চঃ যমুনা চৈব গোদাবরী নর্মদে সিন্দু কাবেরী জলেসিং সান্নিধ্যং কুরু” — এই মন্ত্র পড়ে দেওরভাগা নদীর ঘোলা জলকে যমুনা-কাবেরী-গঙ্গার জল মনে করে সব পাপ মোচনের অলীক আশায় গঙ্গাস্নান সারতাম। তারপরেই শুরু হতো আসল হুল্লোড়।

স্নান সেরেই পৌষের শীত আর কুয়াশা মাড়িয়ে সবাই এসে গোল হয়ে দাঁড়াতাম নাড়ার তৈরি রাজার চারপাশে। খড়ের তৈরি পিতামহ ভীষ্মের শবদাহের আগুনে সেঁকে সেঁকে হাত-পা গরম করা চলত আর সাথে থাকত নানা ধরনের হৈহুল্লোড়।

ততক্ষণে পুবের আকাশে দিনমণির আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। নাড়ার আগুনও গেছে নিভে।

এর মধ্যে আমরা সবাই বাড়ি ফিরে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে পেট পুরে পিঠাপুলি-দই খেয়ে বেরিয়ে পড়তাম নগরকীর্তনে। খোল করতাল আর কাঁসর বাজনার সাথে কৃষ্ণনামের ধ্বনিতে নগরের নাগরিক যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পেতেই এই আয়োজন। নাগরিক যন্ত্রণা কতটা লাঘব হতো জানা নেই কিন্তু এই আয়োজনে নানাভাবে শামিল হতেন গ্রামের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়। চলত কদমা, তিলের খাজা (সিলেটে আমরা বলি তিলু) পিঠা ইত্যাদি বিতরণ।

মকর সংক্রান্তির সর্বশেষ আনন্দযজ্ঞ হলো রথের মেলা। পাশের গ্রামেই জগন্নাথ দেবের আখড়ায় হতো রথের মেলা। নগরকীর্তন থেকে ফিরেই শুরু হতো রথের পথে যাত্রা। ব্যাগভর্তি মাটির খেলনা আর বল্ নিয়ে বাড়ি ফিরেই ভাবতাম কখন সকাল হবে আর মাঠে গিয়ে নতুন বল্ দিয়ে জমিয়ে ফুটবল খেলব।

একবার হলো কি, রোজা আর মকর সংক্রান্তি পড়ল একসাথে। পাশের পাড়ার মসজিদের এক অস্থানীয় হুজুর তার খুতবায় বললেন সংক্রান্তি, রথ — এসব হেন্দুদের সংস্কৃতি। তিনি আদেশ করলেন কোনো মুসলমান যেন না-যায় মাছের মেলায় অথবা রথের মেলায়। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক বাঙালিকে রুখে কে?  ওই বছরই সবচেয়ে বেশি জমজমাট মাছের মেলা এবং রথের মেলা হলো। এবং আমাদের তৎকালীন অগ্রজ ধর্মপ্রাণ মুসলমান প্রতিবেশীদের রোষের মুখে পড়ে সেই হুজুর তার চাকরি হারালেন।

বাঙালি হলো পার্বণপ্রিয় জাতি। আবহমান বাংলার বারো মাসের তেরো পার্বণ বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানার বহিঃপ্রকাশ। পৌষ পার্বণ বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কিঞ্চিৎ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই দিন পালন করেন, কিন্ত ধর্মের বেড়াজালকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মকর সংক্রান্তি আবহমান বাংলার অন্যতম সার্বজনীন উৎসব। নতুন চালের পিঠাপুলি, পায়েশ, মিষ্টি, দই আর মাছ — এসব বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উপজীব্য। এসবকে ধর্মের জালে বন্দি করা কেবল বোকামির বহিঃপ্রকাশ।

দেশ ছেড়েছি আজ দশ বছর। হয়তো অনেককিছুই আজ বদলে গেছে। এখন হয়তো সবাই স্নানঘরেই গঙ্গাস্নান সারে। খোল-করতালের আওয়াজে আর নগরকীর্তন হয় না। যান্ত্রিকতার নাগপাশে আবদ্ধ বাঙালিরা হয়তো ভুলে গেছে পিঠা তৈরি করে হাসিমুখে প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণের বিমলানন্দ। হয়তো রথের মেলায় এখন আর কুমোরের মাটির হাঁড়িপাতিল আর খেলনা নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে না।

আমিও হয়তো আগের মতো নেই। বদলে গেছি অনেকটাই। অতি যান্ত্রিক শহরের যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ হয়ে গেছি আপাদমস্তক। তবুও পৌষ পার্বণ আসে, তবুও স্মৃতির জোয়ারে ভাসিয়ে আমাকে নিয়ে যায় দুরন্ত শৈশবে।

পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে গিয়ে খুশিতে বিষম খেয়ে আরও উল্লাস বাড়িয়াছি মনে মায়ের বকুনি খেয়ে।

[metaslider id=”3597″]

[লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত স্থিরচিত্রগুলো লেখক কর্তৃক সরবরাহকৃত। — গানপার]

… …

অসীম চক্রবর্তী

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you