লাকীর সঙ্গে একমঞ্চ || অঞ্জন দত্ত

লাকীর সঙ্গে একমঞ্চ || অঞ্জন দত্ত

[লাকী আখান্দের সঙ্গে স্টেইজ শেয়ার করেছিলেন অঞ্জন দত্ত। ঘটনাটার সংক্ষিপ্ত অথচ মনোজ্ঞ বর্ণনা পাওয়া যায় দত্তের ১৯৯৮-রিলিজড ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ অ্যালবামে। সেখানে, ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ অ্যালবামে, একটা গান রাখেন অঞ্জন ‘লাকী আখান্দ’ শিরোনামে। একেবারেই ছিপনৌকার মতো তরতরিয়ে প্রবাহিত সংগীত ও সুর সেই গানের। অঞ্জনের লেখা গানের লিরিকগুলোতে যেমনটা হাতছাপ থাকে তার নিজের, এইখানেও ব্যত্যয় ঘটেনি কিছুর। গিটারে এবং মাউথঅর্গ্যানে মশগুল অনবদ্য দ্রুতি ও লয়ের কম্পোজিশন।

গান শুরুর আগের কথিকায় অঞ্জনের স্বকণ্ঠে ব্যক্ত হয়েছে সেই দিনটার কাহিনি। লিরিকের উপজীব্যও ওই দিনের মঞ্চাভিজ্ঞতা। লাকী আখান্দের সংগীতপ্রতিভার প্রতি ট্রিবিউট জানিয়েছিলেন অঞ্জন আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে এই গানটার মাধ্যমে। দেখা যাবে যে গানের একজায়গায় যেয়ে অঞ্জন বলছেন “এটা খুঁজে পাওয়ার গল্প / এটা গানের গল্প নয়” … দ্ব্যর্থহীন স্বীকৃতি দিচ্ছেন অঞ্জন তার প্রতিবেশী ভূখণ্ডের এক মিউজিকমায়েস্ত্রোকে, ব্যাপারটা আমরা আনন্দচিত্তে খেয়াল করব।

১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে এসেছিলেন অঞ্জন বাংলাদেশট্যুরে পয়লাবারের মতো। ‘পরশপাথর’ ব্যান্ড ছিল সঙ্গে সেই সফরে। একটা শ্রুতিনাটকের ফিতা বেরিয়েছিল সে-যাত্রা ‘ভালোবাসা’ শীর্ষক, অঞ্জন দত্ত ও নিমা রহমান জুটি বেঁধে সেখানে অনবদ্য বাচিক অভিনয় করেছিলেন। নাট্যঘন সংলাপের ফাঁকে ফাঁকে গেয়েছিলেন অঞ্জন নিজের কিছু নতুন গান, সঙ্গে ছিল ‘পরশপাথর’ ব্যান্ডের কয়েকটা গান। সফরফেরত অঞ্জন কলকাতায় বসে বাংলাদেশ নিয়ে বেশকিছু গান রচনা করেন এবং অবিলম্বে বের হয় ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ অ্যালবামটা, যেখানে ‘লাকী আখান্দ’ ছাড়াও সুন্দর ও মর্মদ্রাবী কিছু সংগীত উপহার পেয়েছিলাম আমরা।

লাকী ছিলেন অঞ্জনেরই সমবয়সী। মিউজিকে ক্যারিয়ার শুরু ও প্রতিষ্ঠার দিক থেকে অবশ্য অঞ্জনের ঢের আগে থেকেই লাকী মিউজিক-কম্পোজার হিশেবে মশহুর। নিজে গেয়েছেন অল্পই, কিন্তু সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় লিস্নারপ্রিয় আধুনিক বাংলা গানের। লাকীসৃজিত সমস্ত গানই আশ্চর্য রকমের জনপ্রিয়তা লাভ করেছে প্রকাশলগ্নেই, শ্রোতাগ্রাহ্যি বিবেচনায় লাকীর কাজগুলো অদ্যাবধি কিলোমিটারস্টোন সব-কয়টাই, ডিকেড গণনায় চারেরও অধিক পেরিয়েছে সেই গানগুলোর বয়স এবং যা আজও অনবদ্য ও অম্লান। চারদশক-পেরোনো সংগীত যদি ফিলহাল লোকপ্রিয় রয় তাহলে সেই সংগীতাঞ্জলি কি কালোত্তীর্ণ গণ্য হবে না? লাকী আখান্দ আধুনিক বাংলা গানের কারিগরদের মধ্যে অলটাইম গ্রেইট হিশেবেই বরেণ্য।

অঞ্জন যখন ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে নিজের ডেব্যু সংকলন প্রকাশ করছেন ততদিনে লাকী নিজের সেরা কাজগুলো করে সেরেছেন। ছিলেন তখন অন্তরালে স্বেচ্ছা-অন্তরীণ। অতি অল্প বয়সে ক্যারিয়ার শুরু করে লাকী মিউজিশিয়্যান হিশেবে মুনশিয়ানা দেখিয়ে ব্যক্তিগত দুর্ঘট ও অনুমেয় অন্যান্য অভিমানে নেপথ্যে ছিলেন দীর্ঘদিন, সংগীতসৃজনের মঞ্চ ও স্টুডিয়ো থেকে তফাতে রেখেছিলেন নিজেকে একটানা দেড়-দশকেরও অধিক। পরে ফের ফিরলেন নব্বইয়ের মধ্যপাদে এবং বেশকিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যবহ সংগীত উপহার দিলেন ব্যান্ড ও সোলো পন্থায়। নিজের কণ্ঠে এবং মুখ্যত অন্য কণ্ঠশিল্পীদের গলাবাহিত সেই গানগুলোও পূর্ববৎ স্বকীয়তা হাজির রেখেছে আধুনিক বাংলা গানের নিয়মিত শ্রোতৃমণ্ডলী ও সমুজদারদের সমুখে।

‘হ্যাপী টাচ’ নামে একটা ব্যান্ড ফর্ম করেন লাকী নিজের সহোদর অকালপ্রয়াত হ্যাপী আখান্দের স্মৃতির সম্মানে। হ্যাপী আখান্দ এদেশের বাংলা প্যপগানের আরেক দীর্ঘশ্বাস, বয়স তিরিশ পূরণেরও আগে হ্যাপীর প্রস্থান বাংলাদেশের আধুনিক গানে এবং লাকী আখান্দের জীবনে এক অপূরণীয় ক্ষতি। লাকীসৃজিত ও সুরারোপিত কয়েকটা গানে হ্যাপীর কণ্ঠলগ্নি চিরহরিৎ নিসর্গের মতো অনুরণিত আজও। ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’ এবং ‘কে বাঁশি বাজায় রে’ এভার্গ্রিন বাংলা গানের তালিকায় শীর্ষগণ্য সর্ববিধ বিবেচনায়। এই গানদ্বয় হ্যাপী-লাকী ভ্রাতৃযুগলকে লেজেন্ডের মর্যাদায় উন্নীত করেছিল অলমোস্ট তাদের কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণতুর্কি দিনেই। তুঙ্গ জনপ্রিয়তার নিরিখে লাকীর অন্যান্য গানের মধ্যে ‘আগে যদি জানিতাম’, ‘আমায় ডেকো না’, ‘মামণিয়া’, ‘এই নীল মণিহার’, ‘হৃদয় আমার’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। রয়েছে আরও অনেক জনপ্রিয় সুরের গানমালা লাকীসুরায়িত ও লাকী কর্তৃক সংগীতায়োজিত, যে-গানগুলো মুক্ত বাংলাদেশের বিগত পাঁচদশকে বেড়ে উঠেছে প্রজন্মান্তরের শ্রবণপুষ্টি পেয়ে। ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে’, ‘পাহাড়ি ঝর্ণা’, ‘নীল নীল শাড়ি পরে’, ‘হঠাৎ করে বাংলাদেশ’, ‘হৃদয়ের দুর্দিনে যাচ্ছে খরা’ লাকীর আরও কিছু জনপ্রিয় গানের তালিকায় উল্লেখ্য। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রিয় সহোদর ও সংগীতসখা হ্যাপী আখান্দের সহসা জীবনাবসানের ট্রমা কাটাতে নেপথ্যযাপনে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ম্যাচিয়্যুর সময়টাকে হেলাফেলায় খর্চা করে ফেলেন লাকী। মিউজিকে এরপরে ফেরেন অবশ্য নব্বইয়ের অন্তিমে, দেরি হয়ে গেছিল যদিও, এরপরও দ্রুত কিছু স্বাক্ষরবাহী টিউন করে ওঠেন এবং পুনরায় হয়ে পড়েন অনিয়মিত। প্রকৃতির ভৌত নিয়মে একসময় হয়ে গেলেন দেহগতভাবে অন্তর্হিত।

গত পাঁচ দশকের বাংলাদেশে গেয়ে প্রতিষ্ঠিত সব বয়সের সব ধারার শিল্পীরাই লাকী আখান্দের সুরে, সংগীতে এবং আবহ-আয়োজনে একটা-না-একটা বা একাধিক গান করেছেন এবং সেসব গানের একটাও অগ্রাহ্য হয়নি মিউজিকশ্রোতাদের কাছে। ব্যান্ড বা বাংলাদেশের রক মিউজিকে মধ্যনব্বইয়ে আবির্ভূত শিল্পীদের অনেকেই লাকীর কাজ গলায় নিয়েছেন তুলে এবং হয়েছেন সমাদৃত। নরম বিষাদ, মগ্নচৈতন্য অভিমান আর বিপন্নমাধুরী বিরহের ছোঁয়াচলাগা লাকী আখান্দের সুরকারুকাজগুলো।

১৯৫৬ সনের ১৮ জুন জন্মেছিলেন লাকী আখান্দ, লোকান্তরিত হলেন ২০১৭ সনের এপ্রিল মাসের ২১ তারিখে ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘসময় যুঝে। সেল্ফ-টাইট্যল্ড অ্যালবাম বেরিয়েছিল ১৯৮৪ সনে। ডেব্যুর পরে দীর্ঘবিরতি দিয়ে ‘পরিচয় কবে হবে’ শিরোনামে অ্যালবাম বেরিয়েছিল ১৯৯৮ সনে। এবং বলা বাহুল্য স্বকণ্ঠে নয়, গ্রেইট মিউজিশিয়্যান লাকী আখান্দের কাজগুলো অন্যান্য সংগীতশিল্পীদের কণ্ঠেই পেয়েছি আমরা সারাজীবন। ফলে পার্ফোর্মার হিশেবে নয়, লাকী চিরবরণীয় অন্তরালের সংগীতপ্রণেতা হিশেবেই।

এদিকে অঞ্জন দত্ত অভিষেকবর্ষ ১৯৯৪ থেকে একটানা ২০০১ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে অ্যালবাম প্রকাশ করে গেছেন; পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় সংগীতরচয়িতা এই শিল্পীর স্টুডিয়োঅ্যালবামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ‘শুনতে কি চাও’, ‘পুরনো গিটার’, ‘ভালোবাসি তোমায়’, ‘কেউ গান গায়’, ‘চলো বদলাই’, ‘হ্যালো বাংলাদেশ’, ‘কলকাতা-১৬’, ‘বান্দ্রা ব্লুজ’, ‘অসময়’ এবং ‘রং পেন্সিল’। এরপর এই শিল্পী অ্যালবাম প্রকাশে বিরত থাকেন দীর্ঘ প্রায় একযুগ; ২০১৪ সনে একটানা ১৪ বছর অন্তরালবাসের শেষে ‘ঊনষাট’ অ্যালবাম দিয়ে ফেরেন স্টুডিয়োরেকোর্ডিঙে। এইটাই এ-পর্যন্ত অঞ্জনের সর্বশেষ স্টুডিয়োঅ্যালবাম। অবশ্য লম্বা এই বিরতিকালে সিনেমা বানিয়েছেন অঞ্জন বেশ-কয়েকটা, আপন সিনেমার জন্য টুকটাক গান তৈয়ার করেছেন, প্লেব্যাক করেছেন,  বেশ কয়েকটি সিঙ্গেল্সও বের হয়েছে ইতিউতি, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ স্টুডিয়োঅ্যালবাম একটাও না।

‘লাকীর সঙ্গে একমঞ্চ’ শিরোনাম দিয়ে এই নিবন্ধটা আমরা হাজির করছি অঞ্জনেরই বকলমে ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ অ্যালবামের অডিয়ো শুনে শুনে। এতদসঙ্গে সেই ট্রিবিউটগানের রিটেন টেক্সট যেমন থাকছে, তেমনি থাকছে ইউটিউবদৌত্যে গানটা শোনারও ব্যবস্থা।

জুনজন্মা লাকী আখান্দকে এই জুনে আমরা জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা। – গানপার]

 612

লাকীর সঙ্গে একমঞ্চ

উনিশশ’ আটানব্বইয়ের এপ্রিল মাস নাগাদ আমি প্রথম বাংলাদেশ যাই। ঢাকার ন্যাশন্যাল মিউজিয়াম অডিটোরিয়্যমে আমাদের শো।

প্রথমবার ঢাকা। হ্যলভর্তি শ্রোতা। দারুণ লাগছে।

হঠাৎ শোয়ের মাঝামাঝি আমাদের জলসার উদ্যোক্তা নিমা রহমান আমায় জানান যে হ্যলে একজন শিল্পী উপস্থিত, যিনি এক-সময় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তাকে আমি চিনি না, তার গানও কখনো শুনিনি।

কিন্তু একেবারেই নিছক আসর জমানোর উদ্দেশ্যে হঠাৎ তাকে মঞ্চে আসতে আহ্বান করলাম। তিনিও দিব্যি উঠে এলেন এবং আমার সঙ্গে গানবাজনা করতে শুরু করে দিলেন। যদিও তাকে যখন জিগ্যেশ করেছিলাম, “আমার কোন গানটা গাইব বলুন তো?” তিনি বলেছিলেন, আমার গান তিনি আদৌ শুনেননি।

দিব্যি গান গাওয়া হলো। আসর জমে গেল।

বহু বছর যে-শিল্পী গান গাওয়া বন্ধ করে চুপ মেরে বসেছিলেন, হঠাৎ আবার গান গেয়ে উঠলেন।

তারপর, তার সঙ্গে তেমনভাবে আর-কোনো যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু যে-কারণে এই কথাগুলো বলছি তা হলো, জীবনে খুব কমই আমি অন্য কোনো শিল্পীর সঙ্গে গান গাইতে গিয়ে এতটা এঞ্জয় করেছি। তাই ভাবলাম গল্পটা আপনাদের বলি।

‘লাকী আখান্দ’

দুজনে থাকে দুটো দেশে
দুজনেই গান বেচে খায়
গানে গানে কোনো-এক মঞ্চে
হঠাৎ দেখা হয়ে যায়

একজন বাজায় গিটার
আরেকজন কিবোর্ডস্
একজন গান গেয়ে চলে
আরেকজন দ্যায় সঙ্গৎ

মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় গান
সেদিনের সেই জলসায়
একাকার হয়ে যায় ঠিকানা
কলকাতা কিংবা ঢাকায়

এটা খুঁজে পাওয়ার গল্প
এটা গানের গল্প নয়
একজন খুঁজে পায় বন্ধু
আরেকজন হয়তো-বা ভাই

ব্যাকস্টেজে সিগারেট লেনদেন
তাড়াহুড়ো করে পরিচয়
টুকরো হাসি আর হ্যান্ডশেইক
তারচেয়ে বেশি কিছু নয়

তবু মনে মনে সব বাধা পেরিয়ে
কতকিছু যায় ঘটে যায়
মুখে তারা কিসসু না বললেও
হৃদয়ে দাগ কেটে যায়

গান নিয়ে দুজনের কারবার
গানের জোরেই পরিচয়
গানের দৌলতে কাছে আসা
আর বাঁচার জন্য বিদায়

একজন ফিরে আসে দেশে
আরেকজন দেশে থেকে যায়
দুজনেই খুঁজে ফেরে রোজগার
কলকাতা কিংবা ঢাকায়

একজন ফিরে আসে দেশে
আরেকজন দেশে থেকে যায়
দুজনেরই হয়তো অজান্তে
কখনো-বা কান্না পায়

একজন বাজায় গিটার
আরেকজন কিবোর্ডস্
দুজনেই বেচে চলে গান
বাঁচার ইঁদুরদৌড়

দুজনেই হয়তো-বা ভাবে
আবার কোনো জলসায়
গান হবে কাছে আসার জন্য
পয়সার জন্য নয়

একজন চায় বড় বেশি চায়
একজন হয়তো-বা কম
একজন যদি হয় অঞ্জন
আরেকজন লাকী আখান্দ


গানের নাম : ‘লাকী আখান্দ’
সিঙ্গার, স্যংরাইটার, কম্পোজার : অঞ্জন দত্ত
অ্যালবামের নাম : ‘হ্যালো বাংলাদেশ’
অ্যালবাম প্রকাশকাল : ১৯৯৮


nirbaak

অঞ্জন দত্ত । স্যংরাইটার, সিঙ্গার, কম্পোজার, ম্যুভিডিরেক্টার । কলকাতা, ইন্ডিয়া


 

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you