শুধুই স্ক্রিপ্ট করা বা লাইট-অ্যাকশন-কাট ডিরেকশনই নয়, আগাগোড়া ছায়াছবি নির্মাণের প্রত্যেকটা ধাপেই তিনি নিজের হাত ছোঁয়াতেন, কাস্টিং থেকে শুরু করে পোস্টার ডিজাইনিং এমনকি প্রত্যেকটা ছায়াছবির টাইটেলকার্ডের লেটারিং-টাইপসেটাপ পর্যন্ত সত্যজিৎ রায় নিজের শিল্পীহাতে করেছেন। সমস্তই বিস্ময় আজ। মিউজিক, লোকেশন বাছাই কিংবা নাট্যিক জঙ্গমপূর্ণ দৃশ্যমালার ড্রয়িং এবং সেটনির্মাণ সর্বত্রই সত্যজিৎ (Satyajit Ray) অভিনব উদ্ভাবনা হাজির করেছেন। সত্যজিতের সৃজনসত্তার অনবদ্য নমুনা পাওয়া যায় এমনকি সিনেমার পর সিনেমায় ব্যবহৃত কস্ট্যুম প্ল্যানিং এবং রূপায়ণে। এইখানে সত্যজিতের প্রায় তিরিশটিরও অধিক সিনেমার মধ্য থেকে এক-ডজন বেছে নেয়া হয়েছে পোশাকপরিকল্পক সত্যজিৎ কেমন সেইটা খানিক পুনরালোচনা করে নিতে।
যে-সিনেমাগুলো এই নিবন্ধের আলাপে আনা হয়েছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমে : ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘কাপুরুষ’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘অভিযান’, ‘সমাপ্তি’, ‘মহানগর’, ‘সতরঞ্জ-কে-খিলাড়ি’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘হীরক রাজার দেশে’ এবং ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’।
সত্যজিৎসমগ্র দেখা ছায়াছবিদর্শকের সংখ্যা বাংলাদেশে এবং দেশান্তরে নেহায়েত কম নয়, যে-কোনো ম্যুভিডিরেক্টরের তুলনায় সেই সংখ্যাটা রায়পরিবারের এই গ্রেইটের নসিবে ঈর্ষণীয়ভাবে বেশি বলাটা আদৌ অত্যুক্তি হবে না। ক্ল্যাসিক বাংলাছায়াচিত্রভোক্তাদিগের কাছে এই নিবন্ধ অনাবিল আনন্দের হবে এইটা আন্দাজ করা যায়। তারা আরেকবার রিক্যাপ করে দেখতে পারবেন এই সুবাদে, এই নয়া অ্যাঙ্গেল থেকে। এবং যারা এই নিবন্ধে উল্লেখ-করা ছায়াছবির কিছু কিছু অথবা বেশ-কয়েকটা বা কোনোটাই দেখেন নাই, তারাও হয়তো কৌতূহলী হবেন রচনাটা পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়ায় এই সিনেমাগুলো ঝটপট কালেক্ট করে দেখে নিতে।
এইবার বলা আমাদের দায়িত্ব যে, এই নিবন্ধ গড়ে উঠেছে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত একটি মিনি-ফিচার অবলম্বনে। সেই ফিচারটা ‘আনন্দভুবন’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ১ জুলাই ১৯৯৮ সংখ্যায়। কাজেই এর জন্য নতুন করে আমাদেরকে খাটতে হয় নাই। রেডিমেইড গবেষণার পর্যবেক্ষণগুলো আমরা শুধু পুনর্গ্রন্থনা করে গেছি নিচে। এই নিবন্ধ মুসাবিদার পিছনে এর ভিত্তিরচনাটার লেখক/লেখকবৃন্দ সমস্ত ক্রেডিট পাবেন তা না-বললেও চলে। এবং পরিতাপ এ-ই যে, এই দারুণ কাজের কন্টেন্টটা কার সপ্রেম শ্রমের ফসল, আমরা তার নাম জানি না, ছোট্ট সেই বক্সট্রিটমেন্ট প্রতিবেদনের সঙ্গে লেখক/প্রতিবেদকনাম সংযুক্ত হয় নাই। বিশ বছরের তফাতে এসে এই নিবন্ধপ্রতিম প্রতিবেদনটি যিনি বা যারা আর্টিক্যুলেইট করেছিলেন তাকে বা তাদেরে স্যাল্যুট জানাই।
নিচে দেখি কস্ট্যুম-ডিজাইনার সত্যজিৎ রায় দেখতে কেমন।
১.
‘সোনার কেল্লা’ সিনেমায় ভুয়া প্যারাসাইকোলোজিস্ট ড. হাজরার সহকর্মী কামু মুখার্জি। আসলে সে ভিলেন। তাই তার পোশাকও তেমন। গায়ে সিল্কের চক্রাবক্রা শার্ট। হাতে মদের গ্লাস, সামনে লুডুর বোর্ড, আহা! কী কম্বিনেশন! বিশেষ করে তাসের ছবি আঁকা কামুর সেই ইউনিক জামাটা — এমন জামা যে সত্যজিৎ কোত্থেকে যোগাড় করলেন সেটাই এক গবেষণার বিষয় হতে পারে।
২.
‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে ধুতি, পাঞ্জাবি, জ্যাকেট ও বিদ্যাসাগরী চটি ছাড়া লালমোহন বাবুকে চিন্তাই করা যায় না। সন্তোষ দত্ত এই পোশাকে লালমোহন বাবু হিশেবে চিরদিনের মতো সবার মনে গেঁথে আছেন। বিকল্প ফেলুদার কথা ভাবা যায়, ভাবা যায় বিকল্প তোপসের কথাও; কিন্তু বিকল্প জটায়ু? অসম্ভব।
৩.
‘কাপুরুষ’ ছবির একটি দৃশ্যে দেখা যায় মাধবী প্যাশেন্স খেলছেন। তখন তার পরনে সফট সিল্কের শাড়ি ও পাথরের গয়না। এমন পরিশীলিত পোশাক তখনকার দিনে বিরল। ছাপা সিল্কের শাড়ির ফ্যাশনও তখন নতুন।
৪.
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ সিনেমায় সিমি গারোয়াল সাঁওতাল যুবতী। তার ফর্শা শরীরের কালো মেকাপ শ্রীরায়েরই নাকি দেয়া! পেটিকোট-ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি আর রূপার গয়নায় তাকে যেমন লেগেছে, এখন পর্যন্ত কোনো মিস্ ওয়ার্ল্ডকেও তেমন দুর্ধর্ষ লাগেনি।
৫.
‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছায়াছবিটাই রায়ের প্রথম রঙিন ছবি। সেখানে অলকানন্দা রায়ের মণি রায়বাহাদুরকন্যা। সিল্কের শাড়ির সাথে মেয়েদের কোট, পায়ে পাম্প-শ্যু। টেনে-খোঁপা-বাঁধা কানে ঝোলানো সোনার দুল। খুবই চমৎকার। পুরো ছবিতে এই এক পোশাকই পরে থাকেন অলকানন্দা; — অবশ্য উপায়ও ছিল না, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির সময়কালই স্রেফ একটি বিকাল পর্যন্ত বিস্তৃত।
৬.
‘অভিযান’ ম্যুভিতে ওয়াহিদা রেহমান পরেছেন ঘাগরা, চোলি আর ওড়না। গালে ঝোলানো বড় রাজস্থানী দুল। তার পরা ঘাগরা-চোলি কিন্তু হিন্দি সিনেমার সেইসব ছোট কাচ-বসানো কিছু নয়, একেবারেই রিয়্যালিস্টিক।
৭.
‘সমাপ্তি’ সিনেমায় অপর্ণা সেন — তখনও দাশগুপ্ত অবশ্য — রবীন্দ্রনাথের মৃন্ময়ী। ব্লাউজছাড়া শাড়ি, নাকে ফুল আর জবজবে করে তেল দিয়ে টেনে চুল বাঁধা তার। দস্যি মেয়ের দারুণ সাজ।
৮.
‘মহানগর’ ম্যুভিতে চাকরিরত মাধবী আধুনিক হয়ে উঠেছেন। এক-সময় দেখা যায় পাৎলা আর আধুনিক ডিজাইনের ব্লাউজের নিচে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে বাটারফ্লাই ব্রা। পোশাক পরিকল্পনা সত্যজিৎ রায়ের।
৯.
‘সতরঞ্জ-কে-খিলাড়ি’ সিনেমার পোশাক পরিকল্পনা আলাদাভাবেই লক্ষণীয়। কস্ট্যুম ডিটেইলস্ নিয়ে এদেশে সত্যজিৎ রায়ের মতো ভাবুক বিরল। বাদশা ওয়াজেদ আলী শাহ্ যখন ইংরেজদের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য, তখন সাঈদ জাফরী ও সঞ্জীব কুমার দাবা খেলতে ব্যস্ত। পরনে তাদের জমকালো শাল, মেরজাই, টুপি ও নাগরা।
১০.
‘ঘরে-বাইরে’ সিনেমায় বিচিত্র রকমের নান্দনিক ও দৃশ্যানুগ আলোয়ান বা শালের ব্যবহার দেখা যায়। আদ্দির, সিল্ক, খদ্দর, পাঞ্জাবি আর কাশ্মিরি সহ নানান রকমের শাল পরেছেন ভিক্টর ব্যানার্জি। স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ব্লাউজ ট্রায়াল দেবার দৃশ্যে পরেন পাঁচটারও বেশি ব্লাউজ। প্রত্যেকটাই দারুণ, প্রত্যেকটাই নয়নজুড়ানো, প্রত্যেকটাই সত্যজিৎকৃত ডিজাইন।
১১.
‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার নামচরিত্র হীরক রাজা স্বৈরাচারী। তার চরিত্রের কালো দিকের কথা ভেবেই সম্ভবত গাঢ় রঙের পোশাক পরানো হয়েছে ক্যারেক্টারটায়। হীরক রাজার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন উৎপল দত্ত।
১২.
‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমায় জাদুকর বরফির পোশাকের পুরোটাই সত্যজিৎ রায়ের করা। অদ্ভুত, আজব এবং মৌলিক।
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS