শো-স্টপার শিল্পী যখন গলার ভেইন আর গিটারের স্ট্রিং একাকার করে ব্যাপক আবেগে “হিরোর দেশ / বাংলাদেশ … হিরোর দেশ / বাংলাদেশ” জপমালা গাইছিলেন, সমবেত সহস্র-দশেক উত্তাল জনতা স্বাধীন বাংলার বীরবন্দনায় শিল্পীরই পাশাপাশি ইমোশনে খলবল করছিল, বর্তমান রিভিয়্যুয়ার তখন উৎকর্ণ হয়েছিল বুঝি-বা আনরিলিজড একটা ট্র্যাক শুনাইবার ন্যায় বিরল সম্মান অডিয়েন্সরে দিতে চলেছেন বঙ্গের প্রথিতযশা ব্যান্ডশিল্পীটি। কিন্তু অনেকক্ষণ উৎকর্ণ চক্ষুবোঁজা থাকিয়াও যখন ওই রিপিটেডলি রিফ্রেইনের অন্ত হচ্ছিল না, স্বাধীন বাংলায় ইন্ডিপেন্ডেন্স ডিক্লেয়ার করার এত বছর পরেও দুই লাইনেই হিরোবন্দনা মানিয়া লইতে মন সায় দিচ্ছিল না, বাকি লাইনগুলার তালাশে নয়ন মেলে দেখি — এ কী! হিরো মোটরবাইকের মজমায় নাক্ষত্রিক শিল্পী মহোদয় নিলয় মোটর্সের বিক্রয়বালক হিশেবে স্টেজথ্রব পার্ফোর্ম্যান্স করছেন!
অচিরে জেনে নেয়া গেল পার্শ্ববর্তী মিউজিকভোক্তার কাছ থেকে যে এইটা গণমাধ্যমে রেগ্যুলার প্রচারিত একটা অ্যাড, মোটরবাইকের বিক্কিরি বাড়ানোর প্রোমো, বর্তমান প্রতিবেদক বহুদিন টিভিবিচ্ছিন্ন রইবার কারণে ব্যাপারটা আনমোল মনে হলেও মোটে তা আনমোল নয়। এইটা জিঙ্গেল, পূর্ণাঙ্গ কোনো গান নয়। মার্চ মাসে ইন্ডিয়ান মোটরবাইকের জয়গাথা গাইবার ব্যাপারটা আদৌ অশুদ্ধ মহাবাংলা টাইপের কিছু মনে করা বাড়াবাড়ি হবে; তেমন মনে করা হচ্ছেও না। তারপরও কথা থাকে। প্যারাডক্স সবসময়ই ইন্ট্রেস্টিং হয়ে থাকে অবশ্য। কন্সার্টের নাম স্বাধীন বাংলা কন্সার্ট। পুরা নাম : হিরো স্বাধীন বাংলা কন্সার্ট। শুধু জ্ঞাতব্য এ-ই যে, এই হিরো বাংলার নয় — এই হিরো ইন্ডিয়ার, বাংলা এর লোক্যাল ডিস্ট্রিবিউটর। বলতেই পারে নিন্দুকেরা : ভারতের কোলাবোরেটার, ইন্ডিয়ার তাৎপর্যহীন তাঁবেদার, তেজারতি-ওজারতি দুইয়েরই হেলাফেলার প্রাণপণ পার্টনার। অসুবিধা তাতে এমন কিছুই নাই। বিজনেসে দেশপ্রেম হুদাহুদি ইমোশন। হোক তা ময়দার বা মিউজিকের বিজনেস। ওয়াল্টন তো স্পন্সর করে নাই, কিংবা কোনো স্বদেশজ পুঁজিপাট্টার ব্যেভারেইজ কোম্প্যানি। কাজেই পয়সায় নাচায় মিউজিশিয়্যান থেকে শুরু করে মরমী পিরফকির মুহাদ্দিস বেবাকেরেই।
যিনি হিরোবন্দনা গাইছিলেন, স্পন্সরখুশ পার্ফোর্ম করছিলেন যিনি, কে এই প্রথিতযশা? আপনারা তারে চেনেন, তার সংগীততৎপরতা আর গানবাজনাকেন্দ্রী জীবনভর ব্যবসাবাণিজ্যের সঙ্গেও পরিচিত আপনারা, আইয়ুব বাচ্চু নাম তার। সেই ফিতার অডিয়োযুগে এবি-র কন্ট্রিবিউশন বাংলাদেশের মিউজিক-ইন্ডাস্ট্রিতে অনুল্লেখ্য নয়। তিনিই হিরো স্বাধীন বাংলা কন্সার্টের শো-স্টপার। ছয় মার্চ দুইহাজারআঠারো শো হয় সিলেটের আবুল মাল আব্দুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্স ময়দানে। স্টেডিয়াম মন্ত্রীর নামে খচিত হলেও পয়সাটা মাননীয় কোনো পকেট থেকে নয়, নির্মাণখর্চা রাজস্ব থেকেই বিনিয়োগ করা হয়েছে। এমন নয় যে নামকরণ দিয়া মিনিস্টার মশাইকে গণশ্রদ্ধা জানানো হয়েছে, কেননা মন্ত্রী মশাই জীবিত ও গদিনশিন এবং বকবকানিতেও বল্গাহারা; কাজেই, বাকিটুকু বলা বাহুল্য।
কন্সার্ট সামনে রেখে বেশ প্রচারণা চালানো হয়েছিল নগরীর নির্দিষ্ট কয়েকটা অ্যারিয়ায় বিলবোর্ড-হোর্ডিং-পোস্টার সাঁটিয়ে। সেইসব প্রচারোপকরণের সর্বত্র দুইটা ব্যান্ডের নাম পাওয়া যায় : ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ এবং ‘এলআরবি’। যদিও পুরা ব্যান্ডের তসবির না-ছাপায়ে সেইসব পোস্টার-বিলবোর্ডে মুখাবয়ব ছাপানো হয় মাকসুদুল হক আর আইয়ুব বাচ্চু মহোদয়বৃন্দের। বাংলায় ব্যান্ড তৎপরতার স্বর্ণসময়ের ভ্যানগার্ড এই দুইজনেই, স্বীকার সকলেই করবেন। দুইয়ের মধ্যে ম্যাক তো শুধু মিউজিকই নয়, ব্যান্ড ম্যুভমেন্টেরও অন্যতম পুরোধা। আজকাল সর্বত্রই দেখি ব্যান্ড জিনিশটা ব্যক্তির/কণ্ঠশিল্পীটির গোলামি ছাড়া আর-কিছু নয়; এবং মোস্টলি ব্যান্ড ইজ প্যাটার্নড আফটার দি লিড-ভোক্যাল। অনেকটা বাংলাদেশের এনজিওগুলোর মতো অপরিপক্বতায় পেয়ে বসেছে ব্যান্ডগুলোকে। এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরের আন্দুধুন্দুও তোফা খাসা। যারা ব্যান্ড নামের হিউজ অর্গ্যানিজমটা চালিয়ে থাকেন ভাগেযোগে, ইকুয়্যাল শেয়ার থাকার কথা যাদের আইডিয়্যালি ব্যান্ডে, হ্যান্ডস্ ছাড়া আর-কিছুই নন কণ্ঠশিল্পী লিডার ব্যতীত দলের বাকি মেম্বাররা। ভাড়ায়-খাটা কামলা যেন বেচারা বাকিদের দশা। আলাদা আইডেন্টিটি শুধু গলাওয়ালা লিডারের। অথচ এমন তো হবার কথা না। ব্যান্ড তো গলাবাজির নয়, মিউজিকের এবং মিউজিশিয়্যানের হবার কথা। যার যার অবদান অনুযায়ী পৃথক পরিচয় থাকবে ব্যান্ডে সবারই। কিন্তু বাংলাদেশে সেই দিন আর নাই ব্যান্ডের। মাকসুদ-বাচ্চুর মতো বয়স্করা ব্যান্ডের কান্ধে সওয়ার হয়ে স্টেজে স্টেজে ফেরি করে বেড়াতেছেন নিজেদের নিভন্তচুলা স্টারডম।
দুপুর দুইটা থেকেই কন্সার্টগ্রাউন্ডে লোকসমাগম হতে শুরু করে। শীতশেষের মিঠেকড়া রোদ্দুরে। হাদিয়া ছাড়া এন্ট্রি ছিল বলে শেষমুহূর্তে ব্যাপক লোকসমাগম হয় গেইটের সামনে। ক্যাওয়াসও হয় আইডি ছাড়া এন্ট্রি ডিস্যালাও করায়। কিন্তু অল্প লোকেই বিষয়টা অবগত ছিলেন বলে ভোটারআইডি ইত্যাদি সঙ্গে না থাকায় টাকা দিয়া এন্ট্রি ক্লিয়ারেন্স চেয়েও পান নাই। যাদের সঙ্গে ড্রাইভিংলাইসেন্স ইত্যাদি কিছু-একটা আইডি ফোটোকপি ছিল তারাই পেরেছেন সহজে এন্টার করতে এবং বাকিরা নানান বাহানা বানিয়ে কেউ ঢুকেছেন কেউ গজগজ করতে করতে ফিরে গেছেন।
সন্ধ্যা সাতের দিকে ম্যাক মঞ্চে ওঠেন। ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ সাউন্ড চেকের জন্য বেশকিছু সময় নেয়, মাগ্রেবের আজান ইত্যাদিও এই ফাঁকে শেষ হলে পরে ধর্মীয় সমস্যা থাকিয়া পরবর্তী এশা-ওয়াক্ত অব্দি খানিকটা শান্তি লাভ করা যায়। এরপর শুরু হয় ম্যাকের ধর্মীয় ভক্তিশ্রদ্ধা প্রকাশের প্রদর্শনী। কিন্তু গুণেমানে একটু উন্নত সর্বধর্মসমন্বয়ী ম্যাকের ফানি কিছু কথাবার্তা আর দুই-তিন লাইন পরপর জয়গুরু-সাঁইসাঁই ধ্বনির বাইরে গান শোনার ব্যাপারে কেউ যদি রিপোর্টার বেচারারে পুঁছতাছ করেন তাইলে বিপদেই ফেলবেন। গোটা-আট-নয়েক গান গেয়েছেন যদিও, সংখ্যায় বিবেচ্য শুধু, গুণের বিচারে গান নিয়া কেউ প্রশ্ন তুললেই খামোশ রইতে হবে।
এমন নয় যে একদা ম্যাকের তুখোড় মঞ্চহাজিরার পুনরাগম প্রত্যাশা করে কেউ ওইদিন ময়দানে গিয়েছিল। উত্তর-পঁয়তিরিশ উমরের শ্রোতা যারা ম্যাকের গনগনে পোলিটিক্যাল লিরিকের গানবাজনার সঙ্গে বেড়ে উঠেছে এমন দর্শকশ্রোতা ন্যাচারাল সিলেকশনের সূত্র মানিয়াই ক্রমক্ষয়িষ্ণু। ওইদিন বড়জোর ফোর্টি পার্সেন্ট হাজিরা ছিল ওই বয়সের শ্রোতা-উপভোক্তার, মাকসুদ একফাঁকে নিজেই জরিপটা করেছেন এবং মঞ্চ থেকে অডিয়েন্স অ্যাড্রেস করে সার্ভেরেজাল্টটা জানিয়েছেনও। ফলে বিপত্তিটা হয়েছে এ-ই যে, সিক্সটি পার্সেন্টেরও অধিক লোকে ম্যাকের গানবাজনার নিশানা জানে না, লিরিক্স ধরতে পারে নাই, ম্যাক নিজেও শ্রোতাদের সঙ্গে মিউজিক দিয়া কমিউনিকেইট করতে আগ্রহী ছিলেন বলিয়া মনে হয় নাই, নিজের গুরুবাদী গামছা আর বব মার্লির দেশ জ্যামাইক্যান ফ্ল্যাগরঙা টুপি কিংবা ভিয়েতনামখচিত কম্যুনিস্টবর্ণ কুর্তা আর পাফের পর পাফ বিড়িসিগ্রেট ছাড়া আবহমান সুর কি সংগীত কি রকোন্মাদ মোমেন্ট কোনোটাই ম্যাকের মধ্যস্থতায় তৈয়ার হয় নাই। নিজেই ম্যাক বলছিলেন একফাঁকে, একষট্টি উমর হয়েছে তার ইত্যাদি। কিন্তু পোলাপানে এসেছে গান শুনতে, এসেছে বাজনা শুনতে, এরা আশ্চর্যভাবে এমনকি ভাষারহিত সংগীতবাজনার তারিফও করতে জানে, এসবের কিচ্ছুটি না-পেয়ে স্রেফ বয়সের কারণে গ্রেইস দেবে কেন? ফোর্টি পার্সেন্টের গ্রেইস পাইলেও সিক্সটি পার্সেন্টের বুলিয়িং বা দুয়ো সইতে হয়েছে ম্যাকেরে। এইখানে কারোর হাত নাই, ম্যাক নিজেও জানেন সেইটা, দীর্ঘদিনের গ্যাপ, আনকোরা গানপ্রমত্ত প্রজন্ম, দুনিয়ার তুখোড় গানবাজনা শুনছে এরা, খালি লিজেন্ড খেয়ে এদের ন-পোষায় অধিকন্তু।
কন্সার্টে লোকে যায় ইম্প্রোভাইজেশনের ম্যাজিক পরখিবার আশে। তেমন একটাও মুহূর্ত তৈয়ার হয় নাই ম্যাকের স্পেলে। প্রকাশ্য মঞ্চে প্রচুর চুরট পুড়িয়ে ম্যাক পার্ফোর্ম করেছেন অত্যন্ত প্যুওর। যদিও চুরট ফোঁকা নিয়া লোকের খুব সমস্যা হয়েছে তেমন নয়, আবার চুরটের ইম্প্যাক্ট না পেয়ে ত্যক্তবিরক্ত হইতেও দেখা গিয়েছে ব্যাপক শ্রোতা ভাইবন্ধুদেরে। এখন ইউটিউবে ন্যাট-কিং-কোল বা বিটলস/লেনন-ডিলান সহ অসংখ্য পুরানা আমলের ভিশ্যুয়্যাল রেকর্ডে চুরটফোঁকারত পরিবেশনায় পাব্লিক পার্ফোর্ম্যান্সে শিল্পীদের কাণ্ডকারখানায় আমাদের আঁখি কুঁচকাইলেও পরে এদের রেন্ডিশন দিয়া ব্যাটাগিরিটা বৈধ করে নিতে পারেন তারা। ম্যাক তা পারেন নাই। খালি নিজের হেল্থের বারোটা বাজিয়ে গেলেন, বাংলা গানের-মিউজিকের একটা বাজাইতে পারলেন না। বাংলা ব্যান্ডের হেল্থ-নিউট্রিশন নিয়া ভাবেচিন্তে এমন লোক তল্লাটে কেউ অবশিষ্ট আছে?
এইদিকের বিবেচনায় এবি নিশ্চয় ভালো স্কোর পাবেন ভক্ত-অভক্ত দুই শিবির থেকেই। মিউজিকটার ধক জ্যান্ত ধরা যায় আইয়ুব বাচ্চু ও এলআরবি-র বাদনে। সমস্যা একটাই, এবি এতটাই স্কিলের শো-অফ করেন যে একটা বাংলা গানের কঠিন সব বাজনার মোড়ে মোড়ে একেকটা চকিত মোচড়ে একগাদা হিন্দি ফিল্মি ম্যাসালা গানের ধুন ঢুকিয়ে দেন। লোকে সেই-কারণেই মজা পায় কি না তা জানি না, বাট কারো কারো কানে ব্যাপারটা বাজেভাবেই পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। এবি-র গ্রেইট সব নাম্বারগুলোতে এই চিপ চটক উত্যক্ত করে এমনকি তার দীর্ঘকালিক ভক্ত শ্রোতাদেরেও।
তবে এবি গিটার দিয়াই শ্রোতা আটকে রাখেন, এতে একবিন্দু সন্দেহ নাই। গিটারে একাই একশ এবি তার সহগিটারিস্টদেরেও দর্শনীয় সুযোগ দেন সোলো ও বৃন্দ বাদনের। লোকে সেইটা অ্যাপ্রিশিয়েইট করে, এঞ্জয় করে। এবং যুগলবন্দীকালে পাব্লিকের মুখরতা তাক-লাগানো। শুধু গিটার তিনটাই তো নয়, এলআরবি-র ড্রামস্ ময়দানের আস্ত ভূমি-নীলিমা ব্যাপ্ত করে রেখেছিল। মনে হচ্ছিল একেকটা হ্যামারের ঘায়ে মাটি তিরিশহাত ডেবে যাচ্ছিল, পুনরায় পায়ের তলা মাটি ফিরিয়া পাচ্ছিল পরবর্তী হ্যামারিঙের অব্যবহিত প্রভাবে। এই ব্যাপারটাই মিসিং ছিল ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ডের পরিবেশনাকালে। একে তো ম্যাকের গলায় সেই তুখা ভাবটা নাই, নিজে সেভাবে গাইতে চেষ্টাশীল বলেও মনে হয় না, মিউজিশিয়্যানদেরেও সুযোগ দিতে স্টেজে ম্যাকেরে তেমন উদ্যোগী হইতে দেখা যায় নাই। নিজেই গাইলেন শুধু। দুইটামাত্র গিটারই ছিল ডানে-বাঁয়ে, এর মধ্যে একটা আবার অ্যাক্যুস্টিক, ফলে খুব-যে আবেশ তৈয়ার হবে এমনটা কেউ ভাবে নাই। রিহার্স-করা পাড়ার ব্যান্ডের দুরুদুরু নবিশি বাজনার এলোমেলো অপরিকল্পিত শব্দায়তন তৈরি হয়েছে, এটুকু শুধু বলতে পারি। বিষয় আছে আরেকটা, যা এই রিপোর্টারের কানে ম্যাচিয়োরিটিহীনতা বলিয়াই ঠেকেছে; — বিষয়টা হচ্ছে, একদা ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয় মাকসুদের গানগুলোর সঙ্গে গিটারযোজনায় জেমসের ‘মীরাবাঈ’ এফেক্টের পুনঃপুনঃ প্রয়োগ। সম্ভবত ওয়া-ওয়া প্যাডেল বলে এই গিটারিং টেক্নিকটাকে। এইসব জোড়াতালি দিয়া ম্যাকের নবীন সংগতকারেরা তাদের সেল্ফ-কনফিডেন্সের ঘাটতিটাকেই উদাম করেছেন শুধু। জগাখিচুড়ি হয়েছে সবকিছু মিলিয়ে। একেকটা দলের আলাদা সাউন্ডস্কেইপ থাকে, যেমন স্টুডিয়োঅ্যালবামগুলোতে অ্যাভেইল করি আমরা ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ডেরও, স্টেজে ম্যাকের এই নবীন লাইনআপটা সাউন্ডের বিচারে একেবারে বৈশিষ্ট্যরহিত ম্যাড়ম্যাড়ে মিউজিক করে গেছে। এলোমেলো রিনিকঝিনিক নৃত্যঝঙ্কার শুধু উৎপন্ন হয়েছে। এবি মিউজিকের দিক থেকে যেভাবেই হোক অডিয়েন্স সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন। যদিও গায়ক এবি বহুদিন ধরেই নিখোঁজ। বাদক এবি এখনও বর্তমান বটে। স্টেজে এখনও কব্জি আর আঙুলমালায় আগুনফুল্কি উড়াইতে পারেন এবি।
ফিডব্যাকটাইমের গানগুলোই সংগত কারণে প্রেফার করেছেন ম্যাক স্টেজে, সেগুলোর সোজা-সাবলীল লিরিক্স আর রেগ্যুলার বিট এবং মিউজিক্যাল ফ্লো মঞ্চমাতানো মুহূর্ত তৈয়ার না-করার কোনো কারণ ছিল না, ম্যাকের দল তাতে ব্যর্থ হয়েছে। এমন হতেই পারে যে শব্দপ্রকৌশলীর পক্ষপাত ছিল না ম্যাকের প্রতি, খিচুড়ি সাউন্ডের শিকার হতে হয়েছে তাদিগেরে; এমন না-ও হতে পারে; এমন বরঞ্চ হতে পারে যে স্টেজে এক্সপেরিয়েন্সের দিক থেকে এবি-টিম নিয়মিত ও আগুয়ান, দুঁদে সব বাজিয়েরা বাচ্চুর সঙ্গে প্লে করে থাকেন, সর্বোপরি মিউজিক কম্পোজার বাচ্চু অডিয়েন্সের নার্ভ ধরতে পারেন আপন কররেখার চেয়েও ঘনিষ্ঠ। সংগীতের মৌতাত কাজেই এবি-র পরিবেশনায় হেসেখেলে বেড়ায় অনায়াস। ওদিকে ম্যাক নিজে একটু কম গেয়ে যদি টিমের সেকেন্ড ভোক্যাল ব্যবহার করতেন, সুযোগ দিতেন যদি কণ্ঠলগ্নি কমিয়ে বাজিয়েদেরে, হয়তো-বা জাদুমুহূর্ত উদ্ভাসিত হতো ওই সন্ধ্যায়। দ্বিতীয় কণ্ঠ ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ডে আছে কি? ঠিকঠাক তথ্যটা জানি না।
ম্যাক গেয়েছেন একে একে ‘আপন দেশে চলো’, ‘করিমানা’, ‘দেহঘড়ি’, ‘মৌসুমী-১’ ও ‘মৌসুমী-২’, ‘ধন্যবাদ হে ভালোবাসা’, ‘ডাকপিয়ন’, ‘মেলা’ প্রভৃতি বিখ্যাত গানগুলো। মোটামুটি স্টুডিয়োরেকর্ডের অনুসরণেই গিয়েছেন গেয়ে, স্টেজম্যাজিক ক্রিয়েট না করেই। দীর্ঘ ব্যালাড ফর্মের ‘ধন্যবাদ হে ভালোবাসা’ গানটা গাইবার সময় সমবেত তরুণ শ্রোতাগোষ্ঠীর স্লেজিং বা দুয়োধ্বনির কারণ বোঝা যায় যে তারা কানেক্ট করতে পারছে না তাদের কাছে অপরিচিত লম্বা লিরিকের সঙ্গে, কিন্তু অন্যান্য ট্র্যাকগুলো তো ক্লোজআপ ট্যালেন্ট হান্ট ইত্যাদি ইনিশিয়েটিভের সুবাদে এই বয়সী লিস্নারের কাছে ব্যাপক পরিচিত ও গ্রাহ্যও। মৌসুমীদ্বয়ের সঙ্গে উন্মাতাল হয়ে উঠল না কেন শ্রোতা? ম্যাক যদি বিষয়গুলো নোটিস করিয়া থাকেন তবেই ইন-ফিউচার নিশ্চয় ম্যাক নিজেকে স্টেজে ব্যেটার একটা জায়গায় নিয়া যাইতে চেষ্টাশীল হবেন এবং নয়া ম্যাকের দুর্দান্ত মঞ্চহাজিরা দেখতে পাবো আমরাও।
কয়টা গান আস্ত গেয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু, মনে করতে পারছি না এখন, তবে চার-পাঁচটার বেশি নয় বোধহয়। বাজিয়েছেন বেশ। জনপ্রিয় নাম্বারগুলোর মুখ-মধ্যস্তবক সমবায়ে একটা কোলাজ করেছেন সবশেষে, মিডলি বলে যারে। আর, আগেই বলা হয়েছে, বাজারে চালু অনেক হিন্দি ফিল্মিগানার ধুন অবাধে অনায়াসে মিশিয়ে টেক্লিন্যালি স্কিলড মিউজিক উপহার দিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু যা পাব্লিকেরে ক্ল্যাপ্সপ্রসূ করে রেখেছে আগাগোড়া। মার্চ মাস বলিয়াই হয়তো কয়েকটা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের গানেরও ধুন শোনা গিয়েছে এবি-র গিটারে সেদিন; যেমন, “মাগো ভাবনা কেন / আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে / তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি / তোমার ভয় নেই মা / আমরা প্রতিবাদ করতে জানি” … ইত্যাদি। ‘হকার’, ‘ঘরছাড়া এক সুখী ছেলে’, ‘হাসতে দ্যাখো গাইতে দ্যাখো’, ‘তারাভরা রাতে’, “এক-আকাশ তারা তুই একা গুনিসনে / গুনতে দিস তুই কিছু মোরে / পুরো জোছনা তুই একা পোহাস নে” … এবি-র নিজের এই নাম্বারগুলো মোটামুটি তিনি গেয়েছেন সেই রাতে।
স্টেজে একটা কাণ্ড অনেকটা তামাশাতেই গিয়েছিল চলে। ম্যাক মঞ্চ থেকে নেমে যাবার পৌনে-একঘণ্টা বাদে এবি যখন মঞ্চে ওঠেন, সহসা ম্যাক ফের মঞ্চে দেখা দেন। বয়সে এবি-র চেয়ে বছর-কয়েকের বড় ম্যাক অনেকটাই সিনিয়রসুলভ স্নেহপ্রশ্রয় মিশিয়ে এবি-র মঞ্চে বেসামাল আচরণ করেন যা অডিয়েন্সের অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটু লেগেছে। এবি বিষয়টা ভালোভাবেই সামলে নেন ম্যাকের উদারতা আর অবদান ইত্যাদির গুণগান গেয়ে ম্যাককে স্পেস দিয়ে। ম্যাক ঘোষণা দেন যে স্টেজ শেয়ার করার এই মুহূর্ত ঐতিহাসিক এবং বাবা শা’জালাল-শা’পরানের দেশে এই বিরল মুহূর্তটা রচিত হতে পারল। ম্যাকের আহ্বানে এবি-ম্যাক গুরুপ্রণামী জ্ঞাপন করেন আজম খানের ‘বাংলাদেশ’ গেয়ে, “রেললাইনের বস্তিতে / জন্মেছিল একটি ছেলে / মা তার কাঁদে / ছেলেটি মরে গেছে” … এই গানটা সমবেত শ্রোতারাও সশ্রদ্ধ উপভোগ করেছে। গেয়ে শেষ হবার পরেও ম্যাক বাচ্চুকে ঢের দোয়াখায়ের করেন, বাচ্চু সংক্ষেপে এবং স্মার্টলি ইন-রিপ্লাই ম্যাককে শুভেচ্ছা জানান। অডিয়েন্সে এবিফ্যানদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল ম্যাকের দ্রব্যগুণে কিংবা আবেগী শিশুতুল্য প্রণয়ে বেসামাল আচরণে। এই বিগব্রো আচরণ প্রকাশ্য মঞ্চে এতটা বাঞ্চিত নয়, এইটা সদাচারও নয়, সেলিব্রেটি উভয়েই এবং উভয়েরই শ্রোতাসার্কেল রয়েছে। স্নেহমমতা অনস্টেজ যতটা আবশ্যক অফস্টেজ হিংসা পরিহার ও সৌহার্দ্য-সহযোগ দরকার সহস্র গুণে বেশি। মিছেমিছি পাব্লিকলি স্টেজে নাট্যঘনঘটা আমোদের হলেও অবমাননা আর বিব্রত হবার উপাদানও তাতে থেকে যায়। একটা বয়সের পরে সিনিয়র-জুনিয়র হায়ারার্কিবিন্যাস মাথায় রাখাটাই ইম্যাচিয়্যুরিটির লক্ষণবাহী; তদুপরি অথোরিট্যারিয়্যান ডোমিন্যান্স তো অবশ্যপরিত্যাজ্য। নগরবাংলায় এইসব পুরানা ব্যামো পুনরায় ফিরাইয়া আনলে তো মুসিবত। ঐতিহাসিকতাটা সাংগীতিক হইলে অকৃপণ তারিফ করা যাইত বটে। সেইটা হারাম হয় নাই বিন্দুটাও, হয়েছে স্রেফ বড়ভাই-ছোটভাই মিলনমেলা। পাব্লিক পার্ফোর্ম্যান্সে এইটা ভূয়সী প্রশংসনীয় কোনো আচরণ হতে পারে না। ম্যাকেরই লেখা গানে আমরা শিখেছি কর্তৃত্বপরায়ণ মুরব্বিয়ানার বিরুদ্ধে তর্জনী উঁচানো, উজ্জ্বল উদ্ধারের ন্যায় বেয়াদবি শিখেছি ম্যাকের ঠোঁটকাটা তৎপরতা মারফতে, “ধন্যবাদ ভালো দিয়া গেলেন, ধন্যবাদ ভালোই দিয়া গেলেন” পঙক্তিটা ম্যাকের গানবাহিত হয়েই ছড়িয়েছিল বনটিলাহাওড়পাহাড়ের বাংলায়। ম্যাক নিজেই এখন গুরুবাদী। কিন্তু গুরুধারা যদি বিজ্ঞাপনী কর্মপন্থায় আগায়, মানে স্টেজে উঠে রেন্ডারিং বিটুয়িন ইচ অ্যান্ড এভ্রি লাইন্স যদি গুরুনামে ভক্তি ঠুকতে হয়, বিরক্তিই আসে অনুরক্তির বদলে। এবং সবাই যদি গানের মঞ্চে এসে এইটা স্টাইল হিশেবে ধরে নিয়ে আওড়াতে থাকে স্বীয় ভক্তিশ্রদ্ধার ব্যক্তিগত জপমালা, তাইলে আল্লাবিল্লা আর সদাপ্রভুসাঁইনিরঞ্জনের আওয়াজ ছাড়া আর-কিছুই শুনতে হবে না। গানবাজনা এমনিতেই নাই, বিবিধ ঈশ্বর-নিরীশ্বরের শিষ্যরা আরও নালিফাই করে দেবেন গানবাজনাটারে। এমনকি মিউজিকের মজমায় মানববন্দনারও কি পৃথক দরকার আছে? কবিকে, চিত্রীকে, মিউজিশিয়্যানকে স্বধর্মে স্থিত রইতে হয়।
শেষে এসে বলি যে, ম্যাক বা এবি জিন্দেগির চারটা দশকেরও বেশি সময় গান গাইছেন, বাংলা গান তাদের কাছে পেয়েছেও কম না, তারা যা দেবার তা দিয়েছেন এবং সম্ভবত নিজেদের সাধ্যের চূড়া ছুঁয়েছেন বহু আগে। এদের কাছ থেকে নিত্যনতুন সংগীত আমরা কামনাও করি না মুহুর্মুহু। তবে একটা জিনিশ তো আমরা চাইতেই পারি তাদের কাছে, একটা জিনিশ তারা দিতেই পারেন চাইলে আমাদেরে, সেইটা হচ্ছে ধ্যান। রকমিউজিকে ধ্যানের যোগ দরকার। অন্তত ফিফটি-পার-করা সাংগীতিক একটা ধ্যানের প্রকাশ আমরা চাইতেই পারি এই বর্ষীয়ান রকারদের কাছে। একদম ধুমধাড়াক্কা গাইয়া-বাজাইয়া নামিয়া যাওয়া, ম্যাসিভ আয়োজনের কন্সার্ট নয়টা বাজার আগেই সুনসান, ম্যাক আর বাচ্চুর মতো মিউজিশিয়্যানরা যদি এখনও তাদের কাফেলায়-থাকা শ্রোতাদেরে ধ্যানস্থ করাতে না পারলেন, কন্টেমপ্লেইটিভ মিউজিক আর মিউজিশিয়্যানে ভরা জাতি আমরা পাইব কই? নিজের বয়স বুঝে রেন্ডিশনস্টাইল শিফট করে ফেলতে পারলেই অ্যানশিয়েন্ট মিউজিক দিয়াও সম্ভব নয়া জামানা স্টার্ট করা। ধ্যান দরকার। এত দ্রব্যের ব্যবহার সত্ত্বেও প্রয়োগক্ষেত্রে সেবা/সাধুতার প্রকাশ তো পাই না। “পাবো বলে আশায় আছি না-পাইলে যাব মারা” …
আর, স্বীকার করি সলজ্জ, আমাদের দেশের দুই গ্রেইটের গান শুনতে যেয়ে পেয়েছি বিস্তরকিছু। মনে হয়েছে, এ-ই তো, একটা হিস্ট্রি ধীরে উপান্তের দিকে যেতে লেগেছে, এর সাক্ষী আমরা। আরও মনে হয়েছে, বেশকিছু পুরানা আমলের রকমোমেন্টের ফ্ল্যাশব্যাক তো হয়েছে এই এক সন্ধ্যাসুবাদে। একটু হিরো মোটরবাইক চালিয়ে হলেও ঘটনাটা মাঝেমধ্যে ঘটুক সবিরত। মনে হয়েছে, দেশের বীরেরাও তো বিজ্ঞাপনী হিস্যার বাইরে কেউই পায়চারি করছেন বলিয়া আন্দাজ হয় না। আর ব্যান্ডমিউজিকের ম্যুভমেন্ট তো মরিয়া গিয়াছে ঢের আগে, সে আর ফিরিবেক লাই, গ্রেইটদের গগনেও অনেক মেঘকুজ্ঝটিকার ঘনঘটা। তাই, অগত্যা। রাগে-গনগনানো পুরাকালের সেই ব্যান্ডমিউজিক এখন হিরোবন্দনায় স্টেজ মাতায়, বেন্সন অ্যান্ড হেজেস দিয়া মাতামাতি শুরু হয়েছিল ওয়ান্স আপঅন অ্যা টাইম, গ্রেইটদের গান শুনিয়া আজ আর তাল-লয় কিছুই ঠাহর হয় না। অ্যাট-লিস্ট গ্রেইটদের গান সরাসরি স্টেজে শুনিয়া হাল্কা চালের একটা ল্যান্ডস্লাইড হবে না? মানসিক না-হোক শারীরিক একটা উইন্ড অফ চেইঞ্জ শ্রোতৃবৃত্তে সূচিত হবে না? ব্যান্ড বলি বা রক যা-হোক শুনিয়া শারীরবৃত্তীয় দোলকম্প্রে উদ্বেলিত হব না আমি/আমরা? তা তো হইল বলিয়া সাক্ষ্য দেয়া যাচ্ছে না।
আবারও স্বীকার করি, সলজ্জ সসঙ্কোচ, গিয়াছিলাম গ্রেইটদের সশরীর সরেজমিন শুনতে; গ্রেইটনেসের ছিঁটেফোঁটাও হেরি নাই। মিউজিকে গ্রেইটনেসের দুই-তিনটা ইজিয়ার এক্সাম্পল ইয়াদ করতে যেয়ে দেখি স্মৃতি কীটদষ্ট। কোন গাছে যেন ধরে গ্রেইটনেসের গুটিআম? কোথায় হিরো ও কত তার দরদাম? কোথায় কার সেরেস্তাদারিতে কামলা খাটছে আমার দুঃখিনী বর্ণমালা বাংলার হিরো? অতএব, হে স্টেজে-আংরেজি-কাভারভার্শন-করা বাংলার মেটাল ক্রেইজি প্রজন্ম, মোটরবাইকের হিরো হইবার চেয়ে তালপাতার সেপাই বা চিলেকোঠার তরল্লা বাঁশিবাদক হইবে কি না আজই সিদ্ধান্ত নাও। মোদ্দা কথা, গানটা ছাড়িয়া দিয়ো না, গানটা চালায়া যাও। মোটরবাইকার হয়েও ঘোড়ার আস্তাবলটার যত্ন নিও ঘুমঘোরে। হে রোহিতাশ্ব, রক্তঘোড়া, রুটি-হালুয়ার ভাগ বুঝিয়া নাও তাতে আপত্তি করিনাকো। শুধু ভুলিয়া যাইও না রুখিয়া দাঁড়াইবার দায়টাও। নবীন মিউজিশিয়্যান, আগে বাঢ়ো, জোর-কদম চলো সুরের সংগীতের সোহবতের সমুদ্দুরপারে …
লেখা : সুবিনয় ইসলাম
… …
- জুয়েল, সেদিনের সেই বিকেল - January 3, 2025
- গোপালটিলায় গানসন্ধ্যা - February 2, 2021
- গান ও গঞ্জনা - December 1, 2019
COMMENTS