সত্যজিৎ রাজন ও অন্যান্য অবলোকন || সৈয়দ মবনু

সত্যজিৎ রাজন ও অন্যান্য অবলোকন || সৈয়দ মবনু

প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় চিত্রকলার চর্চা হয়ে আসছে। সংরক্ষণের অভাবে শিল্পকলার সেই ইতিহাসের তথ্য ও উপাত্ত যথাযথ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে ঐতিহাসিকেরা লিখেছেন, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে বাংলার চিত্রকলার ইতিহাস পাওয়া যায়। প্রাচীন শহর উত্তরবঙ্গের পুন্ড্রবর্ধনে চিত্রিত একটি চিত্রকর্মই সে-সময়ের চিত্রকলার এক অন্যতম নিদর্শন। গবেষকেরা এ চিত্রকর্মের তথ্য বের করেন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ‘দিব্যাবদান’-এর ‘বীতাশোকাবদান’ খণ্ডের একটি কাহিনি থেকে। এ চিত্রকর্মে দেখা যায়, গৌতম বুদ্ধ নিগ্রন্থকে (গোসাল) শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। তাছাড়া ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সম্রাট অশোকের শাসনকালেও বাংলায় চিত্রকলার প্রচলন ছিল।

ঐতিহাসিকেরা অনুমানে বলেন, বাংলার চিত্রকলার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে পালযুগে। সে-সময় রাজপৃষ্ঠপোষকতায় শিল্পকলার বিকাশ ও বিস্তৃতি লাভ করে। অপর এক তথ্যমতে, বাংলাদেশের চিত্রকলার সূত্রসন্ধান পাওয়া যায় ৭২৩ খ্রিস্টাব্দে পর্যটক হিউয়েন সাঙের লেখা বই থেকে। এছাড়া দশম শতকের দিকেও চিত্রকলার অস্তিত্ব ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, সে-সময় ক্যানভাস ও দেয়ালচিত্রের প্রচলন ছিল।

যদিও ক্যানভাস ও দেয়ালচিত্রের ঐতিহ্যগত রীতির প্রচলন সম্পর্কে তেমন কোনো প্রামাণ্য দলিল নেই; তবে অষ্টম শতক থেকে বারো শতকের পাল রাজাদের শাসনামলের বেশকিছু চিত্রকলার নিদর্শন পাওয়া যায়, যা ব্যাখ্যামূলক চিত্র বা নকশা হিসেবে আখ্যায়িত হয়। এ-সকল চিত্রকর্ম বাঙালি শিল্পীদের নয় বলেও ধারণা করা হয়।

কিছু কৌশলগত তফাৎ ছাড়া বাংলার চিত্রকলার সঙ্গে নেপাল বা বিহারের চিত্রকলার তেমন কোনো পার্থক্য নেই বলে গবেষকেরা মত দিয়ে থাকেন। ধারণা করা হয়, ১০১৫ শতকে পাল শাসনামলে গোপালদেব (তৃতীয়)-এর চতুর্দশ বছরের এবং গোবিন্দ পালের চতুর্থ বছরের কোনো-এক সময়ে উদ্ধারকৃত কাঠের তৈরি শিবলিঙ্গ অঙ্কিত এবং লিখিত হয়েছে। অপর একটি শিবলিঙ্গ আঁকা ও লেখা হয়েছে কাগজে। এছাড়া আরও কতিপয় নিদর্শন পাওয়া যায় ধাতুনির্মিত বস্তুতে, যার অধিকাংশই বৌদ্ধ দেব-দেবীর প্রতিমূর্তি। এ-সকল চিত্র ছিল লেখাসংবলিত। প্রথাগত অঙ্কন পদ্ধতি অনুসরণ করে এগুলো চিত্রিত হয়নি। মূলত  দেয়ালচিত্রের রীতিই অনুসৃত হয়েছে এ-সকল চিত্রকর্মে।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বকালে বাংলা অঞ্চলের চিত্রকলার চার পুরোধার কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। সেই চিত্রপুরোধা চারজন হলেন : শিল্পী জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দিন আহমেদ, কামরুল হাসান এবং এসএম সুলতান (শেখ মুহম্মদ সুলতান)। তাঁরা কলকাতাকেন্দ্রিক শিল্পচর্চায় বিখ্যাত হয়েছিলেন। অতঃপর পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন ঢাকা আর্ট স্কুলের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীরা এ-দেশে চারুশিল্পের নতুন দিক উন্মোচন করেন।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ-দেশের শিল্পাঙ্গনে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই যুদ্ধের প্রতিকূল অবস্থা শিল্পীদের চেতনায় সময়, সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি করে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুশাসনের মধ্যে অবস্থান করে যেহেতু স্বাধীন চিন্তার বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায় না, তাই চল্লিশের দশকের শেষে গড়ে ওঠে ‘ঢাকা আর্ট গ্রুপ’।

অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে সত্তর দশক জুড়ে ঢাকায় আবির্ভূত হয়েছে অনেক শিল্পীসঙ্ঘ। তখনও সিলেটের মতো মফস্বল শহরে এসব চিত্রকলাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ হয়তো চর্চা করেছেন। সিলেটে চিত্রকলার আলোচনায় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় অরবিন্দ দাসগুপ্তের কথা। সিলেট অঞ্চলে চিত্রকলায় তিনি কয়েকটি সফল প্রজন্মই দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর মেধা ও মননের দৌলতে এ-অঞ্চলের চিত্রশিল্প পেয়েছে নবপ্রাণ। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে একজন সিলেটের চিত্রশিল্পের তরুণ প্রতিনিধি সত্যজিৎ চক্রবর্তী। শিল্পী হিশেবে তিনি সত্যজিৎ রাজন নামেই বরং অধিক পরিচিত।

কবিতার কিংবা চিত্রের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা কারো জানা আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। তাই সংজ্ঞা দিয়ে কবিতা কিংবা চিত্রকলাকে বোঝানো সম্ভব নয়। দুইটাই উপলব্ধির বিষয়। আর তা উপলব্ধি করতে প্রয়োজন একখানা শৈল্পিক মন। যে-কোনো শিল্পের বিভিন্ন দিক থাকে। এই দিকগুলোকে উপলব্ধি করে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হয় শিল্পের মান নির্ণয়ে। এই দিকগুলোকে শিল্পের আঙ্গিক বলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিচারকেরা।

সাহিত্যের কিংবা চিত্রের প্রাতিষ্ঠানিক বিচার-বিশ্লেষণটা মূলত প্রাতিষ্ঠানিক মাস্টার-অধ্যাপকদের কাজ। আমার কাজ অবশ্যই তা না। আমার মতো মানুষেরা সাহিত্য বা চিত্রকে উপলব্ধি করেন মাস্টার-অধ্যাপকদের সংজ্ঞা কিংবা বিচার-বিশ্লেষণ দিয়ে নয়, আমরা তা বিবেচনা করি মনের উপলব্ধি দিয়ে। সত্যজিৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার অনেক-অনেকদিনের দীর্ঘ পরিচয়। তাঁর চিত্রকর্মের সঙ্গেও আমি বেশ পরিচিত বলতে হবে। আমি খুব কাছাকাছি বসে সত্যজিতের অনেক চিত্রকর্ম উপলব্ধির চেষ্টা করেছি। তাঁর বিভিন্ন সময়ের এবং বিভিন্ন ধরনের কাজ দেখতে দেখতে আমার উপলব্ধিতে এসেছে যে-ব্যাপারগুলো তা হলো, সত্যজিতের কাজগুলোতে দেখতে পাওয়া যায় বেশকিছু প্রতিপাদ্যের পৌনঃপুনিক ঘোরাফেরা : মানুষ, মানবিকতা, প্রকৃতি।

প্রথাগত বা প্রতিষ্ঠানিক চিত্রকলাবিদ্যালয়ের উচ্চতর সনদ নিয়ে সত্যজিৎ চক্রবর্তী শিল্পসৃজনের মাঠে আসেননি। তাঁর চিত্রকলার অবলম্বন জীবনাভিজ্ঞতার প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক কোনো দায়বদ্ধতা থেকেও ছবিসৃজনে ব্যাপৃত হননি, তিনি শিল্পের মাঠে এসেছেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, এসেছেন নিজের বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে। তাঁর চিত্রে যেমন আছে নিজস্ব সমাজবলয়, তেমনি আছে  বৈশ্বিক পটভূমি। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ বিমূর্ত অবয়বগুলোকে মূর্ত করে আমাদের অনুভবে তার চিন্তাগুলোকে স্পষ্ট করে দিতে পেরেছেন বিগত কর্মগুলোর মাধ্যমে, এই কথাটা আমাকে স্বীকার করতেই হবে।

সত্যজিতের চিত্রকলা কোনো দৈবের বশে পাওয়া ব্যাপার নয়, এসবের একটাও কোনো দৈব বস্তু নয়, এ-সমস্তই তাঁর ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও ক্রমাগত নিরলস সাধনার অর্জন। আমি স্বীকার করি, ব্যক্তি সত্যজিৎ কিছুটা আবেগী। তবে পারিপার্শ্বিক কোনো ঘটনা তার শিল্পসাধনাকে হঠাৎ বেগবান করেছে এমনটা আমি দেখিনি। তিনি আপাদমস্তক একজন শিল্পী। তিনি একান্তই শিল্পীর দায়বদ্ধতা থেকে নতুনত্বের আকাঙ্ক্ষায় শৈল্পিক সৃষ্টিতে উন্মাদ দশাগ্রস্ত।

কোনো শিল্পী যখন তার অভিজ্ঞতাকে স্মৃতি থেকে পুনরুদ্ধার করে চিত্রে রূপ দিতে গিয়ে কিছু বিষয় বিস্মৃতিতে হারিয়ে ফেলেন কিংবা তিনি হারিয়ে ফেলার অভিনয় করে দর্শককে রহস্যের মধ্যে নিয়ে যেতে ইচ্ছা ধারণ করেন, তখন তিনি শিল্পকে পূর্ণাঙ্গতা দেন বিমূর্তরূপ উপস্থিত করে। আমার দেখা সত্যজিৎ চক্রবর্তীর চিত্রকর্মগুলোর বেশিরভাগই বিমূর্ত চিত্র।

আমি আগেই বলেছি, সত্যজিৎ চক্রবর্তী তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ বিমূর্ত অবয়বকে মূর্ত করেন চিত্রের মাধ্যমে। শিল্পকলায় বিমূর্ত ধারার আবির্ভাব মূলত দুনিয়াব্যাপী শিল্পচর্চার দীর্ঘ পরম্পরা আর ধারাবাহিকতার ফল। বর্তমানে বিমূর্তায়ন একটি অতি স্বাভাবিক বিষয় হলেও উনিশ শতকের শুরুতে এর (abstraction) আবির্ভাব চিত্রশিল্পের জগতকে একেবারে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।

এক-সময় চিত্রকলার ফোকাস ছিল বিষয়বস্তুর সরাসরি উপস্থাপন। অতঃপর আসে ক্যামেরার ব্যবহারে চেহারার অবিকল প্রতিরূপ প্রকাশ। শিল্পীরা এক-সময় আর এই জায়গায় থাকতে চাইলেন না। তারা প্রকৃতি বা মানুষের সরাসরি চেহারা উপস্থাপনের বদলে প্রতিচ্ছায়া সৃষ্টির চেষ্টা শুরু করেন। এক্ষেত্রে শিল্পী পল সেজানকে আধুনিক চিত্রকলার জনক বলা হয়। তিনি বস্তুর সরাসরি প্রতিরূপকে কিছু মৌলিক কাঠামোতে ভেঙে বিমূর্তায়নের পথে অগ্রসর হলেন। সেজানের দেখানো পথে সত্যজিৎ চক্রবর্তী ধীরে ধীরে এগিয়ে নিজের একটা জগৎ তৈরি করতে চেষ্টাশীল রয়েছেন বলে মনে হয়। তিনি মূলত রেখার মাধ্যমে মানুষ ও প্রকৃতির কল্পনায়িত অবয়ব নির্মাণ করেন।

সত্যজিৎ চক্রবর্তীর চিত্রকলার সাথে যারা পরিচিত তারা হয়তো স্বীকার করবেন, রেখার প্রতি এই শিল্পীর বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। আমরা যতটুকু তাঁকে জানি, তিনি কোনো কাজই পূর্বপরিকল্পনা থেকে করেন না। তিনি মূলত কবিদের মতো যা-কিছু মনে আসে, রেখাপাত করে যা-কিছু মনের ভিতরে, তা আঁকতে সচেষ্ট হন। আঁকতে আঁকতে এক-সময় তাঁর কর্ম গন্তব্যে পৌঁছে যায়। তাই দেখা যায়, ফরমায়েশি চিত্রকলায় সত্যজিৎ রসশূন্য হয়ে যান।

জটিল ভাবনাগুলো যেমন ব্যক্তি সত্যজিতকে তাড়িত করে, তেমনি তাঁর চিত্রকলায় রেখার এক-ধরনের জটিল অভিব্যক্তি দেখা যায়। সত্যজিতের চিত্রকর্মের অবয়বগুলোতে উদ্ভিদ ও প্রাণির যুগল মিলন স্পষ্ট। তাঁর কোনো কোনো চিত্র রয়েছে এমনও যে হঠাৎ দেখলে মনে হয় উদ্ভিদ, গাঢ়তর দৃষ্টিতে দেখলে বোঝা যায় এক বা একাধিক বা অসংখ্য জৈব দেহ।

কবি জীবনানন্দ দাশের পরাবাস্তববাদী কবিতাগুলোর মতো সত্যজিতের একই চিত্রে কখনো কখনো মানুষের দেহ, তার অভ্যন্তর, কিংবা মানবদেহের প্রত্যঙ্গসমূহ, অথবা আবছা আদিম প্রাকৃতিকতা এবং প্রায়ই বৃক্ষের বিন্যাস দেখা যায়। বিচিত্রের (এবং বৈচিত্র্যেরও) অবিচ্ছেদ্যতাই মূলত সত্যজিৎ চক্রবর্তীর চিত্রকলার মৌলিক দিক।

সত্যজিৎ চক্রবর্তীর শিল্পকর্মে শ্লীলতা-অশ্লীলতা বলে কিছু নেই। মানুষকে তিনি রেখে দিতে পারেন অবলীলায় নারীর জরায়ুতে, আবার এই একই জরায়ুতেই তিনি ঘোড়াকেও দৌড়াতে পারেন। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবরণের গভীরে ব্যক্তির জৈবিক অস্তিত্বও আমরা দেখতে পাই সত্যজিতের চিত্রকলায়। সকলেই স্বীকার করবেন, সত্যজিৎ তাঁর চিত্রশরীরের গভীরে প্রকৃতির অপরাপর উপাদানের সঙ্গে এক-ধরনের সমরূপতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।

অনেকে বলেন, সত্যজিতের বেশিরভাগ কাজে রেখার গতিতে বা ব্রাশের টানে সূক্ষ্মতা নাই, তীক্ষ্ণতা নাই, এক-ধরনের ভোঁতা অনুভব রয়েছে, এবং এই ভোঁতা ভাবানুভূতিটা আমাদের ভিতরে এক-ধরনের বেদনার সঞ্চার ঘটায়। তাঁর চিত্রকর্মে রঙের আড়ম্বর নেই। প্রাকৃতিক জগতের মতো তাঁর চিত্রকলা অজস্র প্রাণপ্রক্রিয়ার জটিল সমাবেশ। সত্যজিৎ চক্রবর্তীর চিত্রকর্মগুলো তাঁর প্রকৃতিবাদী চেতনার পরিচায়ক বলা যায়। তাঁর এ-যাবৎ কাজগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাচ্যের ঐতিহ্য বহন করলেও পাশ্চাত্যের প্রভাবও সত্যজিৎচিত্রকাজে অনুভব করা যায়। ধর্ম, বিজ্ঞান, প্রগতি ইত্যাদির চেতনাও তাঁর চিত্রকর্মে অস্তিত্ব ধারণ করে নিয়েছে।

সত্যজিৎ শুধু রঙ-তুলি হাতে নিয়ে ক্যানভাসের পর ক্যানভাস উপচানো ছবি এঁকে যাওয়ার পক্ষে সায় দেন না। আর-দশজন সচেতন নাগরিকের মতো তাঁরও রয়েছে সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা। তিনি সংবেদনশীল একজন শিল্পী। অমঙ্গল, অশুভ, অন্যায় ইত্যাদির বিরুদ্ধে তাঁর অনেক ছবি চেতনায় তীব্র প্রভাব ফেলে।

সত্যজিৎ চক্রবর্তীর স্টুডিয়োতে গিয়ে তাঁর আঁকা ‘নারী’ শীর্ষক একটি তেলচিত্র দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। এতে নারীকে তিনি উপস্থাপন করেছেন ভাঙাচোরা স্থাপনা কিংবা ডানাভাঙা আহত পাখির মতো। ফিলিস্তিনের অসহায় বাচ্চার আহাজারি, সুন্দরবন ধ্বংস করে বিদুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে তাঁর আঁকায় দেখা যায় কাটা গাছের উপর হারিকেন কিংবা বিমর্ষ বাঘ আর বিপন্ন বনজের ছবি, রানাপ্লাজা ধসে অসংখ্য শ্রমিকের মৃত্যু ইত্যাদি  বিষয়গুলোও বাদ যায়নি সত্যজিতের তুলি-কলম থেকে।

এক-দশকের দীর্ঘ সময়সীমায় আঁকা তাঁর কাজগুলোর প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপন আমরা দেখতে পেলাম ‘স্টার্কেইভ অ্যান্ড দি গ্যালাক্টিক স্কিন্স’ শীর্ষক শিল্পীর অভিষেক একক এক্সিবিশনে। এখানে শিল্পীর পঞ্চাশটিরও বেশি কাজ প্রদর্শিত হয়। ঢাকার জয়নুল গ্যালারিতে ২০১৬ অক্টোবরের পয়লা সপ্তাহ জুড়ে এক্সিবিশন চলাকালে শেষের দিনটায় ক্যানভাস ও অন্যান্য ছোট/মধ্যায়ত/মাঝারি আকারের ফ্রেমবন্দি শিল্পকর্মগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সুযোগটা হাতছাড়া করি নাই।

চিত্রপ্রদর্শনীটির ইংলিশ টাইটেলের পাশাপাশি একটা বাংলা টাইটেল ছিল ‘নক্ষত্রগুহা ও ছায়াপথের ত্বক’। প্রদর্শনীস্থিত/প্রদর্শিত প্রত্যেকটা কাজেই ছিল দূরগামী শিল্পীর পথযাত্রার দাগ। ছবিগুলোতে রঙের ব্যবহার এবং টেক্সচারসমূহ প্রদর্শনীশিরোনামের যাথার্থ্যই প্রমাণ করে। এহেন অপার্থিবতা আর অতিজাগতিকতা ধারণ করে রেখেছে প্রত্যেকটা কাজ, মনে হয় যেন নক্ষত্রগুহার আলোর অধিক ঘনকৃষ্ণ অত্যাচ্ছন্নতা আর গ্যালাক্সির গাত্রচর্ম সংমিশ্রিত হয়ে ক্যানভাসকর্মগুলো গড়ে উঠেছে।

ডেব্যু সোলো প্রদর্শনী দিয়েই চিত্রকলানুশীলক ও শিল্পসমুজদারদের আগ্রহপারদ অনেক উঁচায় নিয়ে উঠিয়েছেন সত্যজিৎ চক্রবর্তী। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও শেষ-পর্যন্ত সমাগত সমস্ত প্রদর্শনীতেই শিল্পীর নিরীক্ষাপ্রাচুর্য, শৈল্পিক ক্ষুৎপিপাসা আর তাঁর দরিয়া পারানোর সাঁতারনৈপুণ্য ও সসঙ্কল্প-সপণ নিষ্ঠা আমাদেরকে বারে বারে টেনে নিয়ে যাবে এক্সিবিশনগুলোয়, এমনটা আকাঙ্ক্ষা রাজন ওর্ফে সত্যজিৎ চক্রবর্তী ইতোমধ্যেই তৈরি করতে পেরেছেন।

… …

সৈয়দ মবনু

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you