শিরীষফুল শিরীষফুল…

শিরীষফুল শিরীষফুল…

শিরীষফুলের শোভা দেখে শিরশিরিয়ে উঠল গোটা শরীর, সেদিন, আপিশ থেকে ফেরার পথে। সূর্যাস্তমুহূর্ত তখন, ডুবি-ডুবি দিন বৃষ্টিবিলীন, ফিরতেসিলাম ফলাফলহীন প্রায়-পরিত্যক্ত। চুপসানো বেলুনের মতো, গোধূলিবিবিক্ত, অবসন্ন। সহসা ডালপালা শিরীষের, সপুষ্পক, ভরে তুলল স-ফল আমার ন্যাতানো মন। শরীরে টের পেলাম সহর্ষ শিহর, সোল্লাস উদ্ভাসন, সুস্মিত সৌরভ। শাহজালাল ব্রিজের ঢালুমুখের ডানপাশ ভরে আছে উদ্বাহু ঝাকড়া শিরীষে। ফুলগুলা হাল্কা খয়েরি, নরম, কিশোরীর গালের লজ্জালালিমা যেন। অজস্র পরাগকেশর একেকটা ফুলে, অশ্বকেশ মনে পড়ে যায়, এবং গোছাবদ্ধ কুন্তলের রঙে আবিররঙিন পুরো ফুলটাই। ছোটবেলা আমরা শিরীষফুল গালে বুলিয়ে কাল্পনিক সাবানফেনা আর কাগুজে ব্লেডে খেলাচ্ছলে গোঁফদাড়ি কমানোর শিশুতোষ কসরত করতাম। ততদিনে বাবা-কাকাদের দেখে জেনে গেছি যে রোজ সকালে গণ্ডমুণ্ডনের পর মানুষ কেমন নতুন হয়ে ওঠে! এটা ছিল বড় হওয়ার প্রাথমিক পাঠগুলার মধ্যে একটি। শিরীষফুলের ব্রাশ খুব আরামদায়ক ও ত্বকসহনীয়, শৈশবের ক্ষৌরকর্মবান্ধব, খেলনা হিশেবে ছিল উৎকৃষ্ট ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন। শরীর সত্যি সত্যি শিরশিরাতো তখন, ওই পুষ্পপরাগস্পর্শে, এবং মিষ্টি সুন্দর একটা সুবাস বেরোত ফুলের গা থেকে। ঘন গাঢ় গন্ধ নয়, যেমনটা থাকে ছাতিমের ফুলে, হাল্কা রিমরিমানি ঘ্রাণ তার। আমরা মোহিত হয়ে থাকতাম শিরীষফুল-ফুটন্ত ঋতুতে। অবশ্য কেবল খয়েরি রঙেরই নয়, শিরীষফুল শাদা রঙেরও হয়। ঠিক শাদা না, খানিক ঘিয়া শাদা। ঘ্রাণে একই রকম, উভয়ে, রঙে ভিন্ন। দুটোই সুন্দর, দুটোর সৌন্দর্য দু-রকম। শাদা ফুলের শিরীষগাছে ধরে লম্বা শিমাকৃতি ফল, খয়েরি ফুলওয়ালা গাছের ফলটি অনেকটা তেঁতুলসদৃশ। শাদা ফুলের শিরীষফল বিশুষ্ক, ভক্ষ্য নয়; অন্যদিকে তেঁতুলসদৃশ শিরীষফল ভেজা ও চটচটে ভেতরভাগ, খেতেও বেশ। এই তেঁতুল, সিলেটে বলে তেতই, আমরা প্রচুর খেয়েছি পাঠশালায় যাওয়া-আসার পথে। সরকারি শিরীষগাছে ভরা ছিল আমার শৈশবের সুনসান বড়-বড় মহাসড়কগুলো। দুইধার ছেয়ে থাকত পড়ে-থাকা মক্কার তেঁতুলে, আমরা স্কুলব্যাগের ছোটপকেট ভরে নিয়ে আসতাম কুড়িয়ে, খেতাম এবং স্লেট কালো করতাম ওই ফল ঘষে। পুরো পেকে শুকিয়ে যাওয়া ফল সুমিষ্ট খেতে, আধপাকাগুলা তেতো হলেও মুখভর্তি ছিল তখন জুয়েল আইচের জাদু — মুখে সদা মজুত থাকত তেতো-টক-বিস্বাদ খাদ্যদ্রব্য সুস্বাদু করে তুলতে সহায়ক পর্যাপ্ত মধু। মুখে দাও, জহর-তেতো কুইনাইনও, মজা লোটো। তবু আম্মা পেটপীড়ার ভয় দেখাতেন উঠতে-বসতে, প্রয়োজনে মৃদু পিটুনি সহ। ভক্ষণযোগ্য শিরীষফলকে বলতাম মক্কার তেতই, বইয়ের বাংলায় এরে বলে তীর্থের তেঁতুল — বড় হয়ে জেনেছি। কিন্তু মূল মক্কার তেঁতুল সুদূর আরবদেশে জন্মে, ফি-বছর হজফেরতা হাজি-সাহেবেরা এই ফলটি বয়ে আনেন স্যুভেনির হিশেবে, সঙ্গে আরো অনেক রকমের তবরুক ও জমজমের জল কয়েক পিপা। পূণ্যার্থী আত্মীয়স্বজন সেইসব স্যুভেনিরের ভাগ পেয়ে থাকেন। এত কথা মনে পড়ে গেল ওই পুষ্পপ্রসঙ্গে, শৈশবানুষঙ্গিক, শিরীষফুল দেখে।
— জাহেদ আহমদ / ১৭ এপ্রিল ২০১৭

COMMENTS

error: