গুণদার গুণ  || সরোজ মোস্তফা

গুণদার গুণ  || সরোজ মোস্তফা

বাংলা কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ কী দিয়েছেন — এটা সময় বিচার করবে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালের নভেম্বরে। সময়টাই যেন উঠে এসেছে গ্রন্থের মলাটে। সময় কবিকণ্ঠকে প্রভাবিত করে। সময়ের দাবিকে নিষ্ঠাবান কবি অস্বীকার করতে পারেন না। একজন সাধক ও পরিণত কবি সময়টাকে কবিতায় উঠাতে জানেন। একটা নির্যাতিত বাংলাদেশের লাল কলিজাটাই চিত্রায়িত হয়েছে গুণের কাব্যভাষায়। প্রকৃত কবিতা জাতির ভেতরে উদ্দীপন তৈরি করে। জাতিকে জাগায় ও স্বপ্ন দেখায় প্রকৃত কবিতা।

বাংলা কবিতায় গুণের আগে কেউ স্বাধিকার আদায়ের আয়োজন ও প্রকৃতিকে এভাবে কবিতায় তুলে আনেননি। একটা জাগ্রত ভাষায় ভূমির রাজনীতিকে সত্তর কিংবা উনসত্তুরে কবিতায় আর কেউ ধারণ করেননি। সময়ের একটা অগ্নিঝরা মনকেই তিনি কবিতায় ধারণ করেছেন। তাই তিনি ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ লেখার হিম্মত দেখিয়েছেন।

সাধনা ও হিম্মত তাড়িত কল্পনা কবিকে ‘হুলিয়া’ লিখতে বাধ্য করেছে। গুণের এই হিম্মত অনেকের চোখ খুলে দিয়েছিল। আমি যে-কথাটি বলতে চাই, গুণের এই হিম্মতের উপরে দাঁড়িয়েই শামসুর রাহমান ‘নিজ বাসভূমে’ লিখতে পেরেছিলেন। ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ সে-সময়ের কবিচৈতন্যে একটা অনুভব তৈরি করেছিল। শামসুর রাহমান যে নাগরিক মধ্যবিত্তের ভাষা খুঁজছিলেন — সে-ভাষার বীজ কিংবা মগ্নচৈতন্যের একটা সংস্থান দিয়েছিল গুণের কবিতা।

নির্মলেন্দু গুণকিশোরগঞ্জনিবাসী মনসামঙ্গলের কবি কানা হরিদত্ত কবি নির্মলেন্দু গুণের মাতুল বংশীয় পূর্বপুরুষ। আর পিতা ছিলেন চিত্রশিল্পী। কাজেই, শিল্প ও কবিতা তাঁর রক্তে ছিল। আর বারহাট্টার কোমল প্রকৃতি তাঁকে জাতকবিতে পরিণত করেছে। ছোটবেলায় ময়মনসিংহ গীতিকার পালা আর বীরচরণের কবিতা ও গান শুনে শুনে তিনি বড় হয়েছেন। তাই তাঁর কবিতা সহজ। তাই তিনি লিখেন ‘চাষাভুষার কাব্য’। বাংলা কাব্যে নির্মলেন্দু গুণের উপহার একটা সহজ ভাষা। কী প্রেমের কবিতা, কী রাজনীতি কিংবা অধিকার আদায়ের কবিতা — গুণ একটা সহজ গল্প বলেছেন। কবিতা লিখতে এসে তিনি অতিরিক্ত কোনো স্টাইল তৈরি করতে চাননি। সময়ের কথাটা তিনি সময়ের ভাষায় বলেছেন। এখানেই গুণের কৃতিত্ব। এখানেই গুণের বড় গুণ।

কবিতা লিখতে এসে সমকালে গুণের চেয়ে বেশি গল্প কেউ তৈরি করতে পারেনি। শুনেছি, তথ্য মন্ত্রণালয় গুণের পার্মিশন ছাড়াই কোনো-একটা বিজ্ঞাপন কিংবা বিলবোর্ড জাতীয় কিছু তৈরি করেছিল। কবি গুণ যথারীতি সে-দফতরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন এবং বিজ্ঞাপনের জন্য সম্মানী আদায় করেছেন।

তার গ্রামের নাম ছিল কাশতলা। গুণ সে-নাম পালটে দিয়ে করেছেন কাশবন। এমনকি নেত্রকোণার প্রথম আন্তনগর ট্রেনের নামও তিনি কাশবন দিতে চেয়েছিলেন। এই নামের প্রতি তাঁর বিশেষ প্রীতি আছে। সেই কাশতলায় তিনি শান্তিনিকেতনের আদলে মন ও মননের একটা জগৎ তৈরি করেছেন।

নেত্রকোণার মালনীতে তৈরি করেছেন বিশ্বকবিতার আশ্রম। যার নাম ‘কবিতাকুঞ্জ’। কবি চান, মগরা নদীর তীরে এই আশ্রমে মানুষ আসুক। কবিরা আসুক। কবিতার প্রতি দরদ তৈরি হোক। মানুষ কবি ও কবিতাকে ভালোবাসুক। এটা কোনো ছেলেমানুষি তৎপরতা নয়। শুধু কবিতার জন্য এই ধরনের সাংগঠিক কাজ কে কবে করেছেন — আমার জানা নেই।

২১ জুন । বাংলার এই সাধক কবির জন্মদিন। বাংলা কবিতায় একইসঙ্গে তিনি বিল্পবী ও রোমান্টিক। কবিতা এবং জীবনের মধ্যে একটা সাঁকো তৈরি করেছেন তিনি। গুণকে অনেকে ‘মাস্তান কবি’ বলেন। মাস্তান খুবই ইতিবাচক শব্দ। কোনোকিছুর জন্য দেওয়ানা-মাস্তানা না হলে কোনোকিছু অর্জিত হয় না। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের প্রতি প্রেম থেকেই বিরুদ্ধ সময়ে দাঁড়িয়ে ‘স্বাধীনতা, এ শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’-র মতো অসাধারণ কবিতা লিখেছেন। লিখে বাংলা অ্যাকাডেমির মঞ্চে এই কবিতা পড়ে এসেছেন। এ-ই হচ্ছে গুণের প্রেম ও মাস্তানি।

কাশবনে কবি মাইকেল ও রবীন্দ্রনাথের ভাষ্কর্য গড়েছেন। গড়েছেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। কবিতায় কিংবা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠায় গুণ বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের রক্ষক।

ব্যানারে ব্যবহৃত প্রতিকৃতির শিল্পী  মাহবুবুর রহমান

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you