আমার বাবা || গুরুপ্রসাদ দেবাশীষ

আমার বাবা || গুরুপ্রসাদ দেবাশীষ

গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত ভাটি অঞ্চল, বর্ষাকালে চারিদিকে শুধুই থৈ থৈ জলের কলকল শব্দ, রাস্তাঘাট এমনকি কারো কারো বসতভিটার দরজা পর্যন্ত বর্ষার জলের আনাগোনা, নৌকা আর বাঁশের সাঁকো যেখানে একমাত্র চলাচলের মাধ্যম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই এক নিস্তব্ধ নীরবতা, বাতাসের ধু ধু  শব্দ আর ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাক। কারো কারো বাড়িতে হয়তো মিটিমিটি আলো জ্বলছে, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হয়তো কেউ কেউ গলা হাঁকিয়ে গান ধরছে — “’ভবে আসা-যাওয়া যে যন্ত্রণা / জানলে ভবে আর আসতাম না” … ঘর থেকে আমরা বুঝতাম যে অমুক কাকা বাজার থেকে বাড়ি ফিরছে, কেমন যেন গানের গলা শুনেই বুঝে নেয়া যেত ওই মানুষটি ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে। তারই মাঝে কিছু কিছু কণ্ঠস্বর ভেসে আসত ছেলেমেয়েদের শব্দ করে পড়ার আওয়াজ, আর সেই শব্দ শুনে যে মানুষটি সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হতেন উনি ছিলেন একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আদর্শ শিক্ষক, ছিলেন একজন প্রকৃত মনুষ্যত্বসম্পন্ন খাঁটি ও আলোকিত মানুষ, আলোর দিশারী। যিনি একাধারে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন শতশত ছাত্রছাত্রীদের মাঝে, সবচেয়ে বড় শিক্ষা ছিল তাদের মাঝে প্রকৃত মনুষ্যত্বজ্ঞান ছড়িয়ে দিতেন। প্রতিটি সামাজিক কর্মকাণ্ডে থাকতেন সক্রিয়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক শক্ত স্তম্ভ হয়ে সম্মানিত হয়েছেন আপামর মানুষের কাছে। সাহিত্যচর্চা, সংস্কৃতিচর্চায় অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছেন সমগ্র এলাকায়। তিনি ছিলেন এমন এক আলোর দিশারী জাহাজের নাবিক যিনি পথ দেখিয়ে সঙ্গে নিয়ে চলতেন হাজারো যাত্রী, যে জাহাজ পরিণত হতো এক আনন্দধামে  যেথায় অবলীলায় চলত জীবনতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব বিষয়ক আলোচনা, বাকবিতণ্ডা, তারই মাঝে একজনার ভাবের উদয় হয়ে গলাটা ঝাঁকিয়ে ধরতেন — “গুরু বলে ভক্তিভরে ডাক রে আমার মন রসনা” … তারই সাথে সঙ্গী হয়ে বাকি সবাই দোহার দিতেন। ঈশ্বরভক্তি আর আধ্যাত্মিক ধর্মীয় চেতনায় ছিলেন একজন নিভৃতচারী সাধক। আত্মপ্রচারবিমূখ, নিরহঙ্কারী, সাদামাটা, সহজ, সরল জীবনযাপনকারী মানুষ কারো স্যার বা কারো মাস্টারমশাই হয়ে নীরবে-নিভৃতে কাজ করে গেছেন সবার জন্যে।

বর্ষাকালের কোনো-এক সাঁঝের বেলায় আকাশ ঘনিয়ে কালো মেঘে অন্ধকার নেমে আসতেই, একটি চিন্তিত কণ্ঠে ডাক পড়ত, “খুকুমনি…খুকুমনি…খুকুমনি…” ধীরে ধীরে কণ্ঠস্বরটি জোরালো হতে উঠত। গ্রামের কারো বাড়ির কোনো-এক কোণ হতে ভীত কণ্ঠে প্রত্যুত্তর আসত, “আইছি বাবা।” আমৃত্যু বাবা আমাকে ‘খুকুমনি’ বলেই ডাকতেন। আমার বাবা স্বর্গীয় শ্রীযুক্ত মনিভূষন হোম চৌধুরী, জন্ম ২৫শে  অক্টোবর ১৯৩৫ সালে, হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ থানার নগর গ্রামে। উনার জীবনকর্মের পরিধি অনেক বিশাল, তা একবারে অল্পকথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, কিছু অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র।

আমাদের কাঠের দোতলা বাড়ি। ঘরের সম্মুখভাগে, ডানে, বামে সবমিলিয়ে তিনটি দরজা দিয়েই মূল ঘরে প্রবেশ করা যায়, দরজার সামনের অংশটুকু প্রশস্থ বারান্দা যেখানে প্রতিদিন প্রাতঃকাল আর সন্ধ্যাবেলার ছাত্রছাত্রীদের মিলনমেলার কেন্দ্রবিন্দু। বিদ্যালয়ে পড়াশোনার বাইরেও সকাল-সন্ধ্যা বাড়িতে ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা ছিল নিয়মিত। ত্রিপাল বা সতরঞ্জি পেতে বারান্দাতেই চলত বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার যত কার্যক্রম। এ আসরে ছেলেমেয়ে, জাত-ধর্ম, ধনী-গরিবের কোনো ভেদাভেদ ছিল না, সবাই কেমন  যেন হাসি-আনন্দচিত্তে পড়তে আসত আবার চলে যেত।  কিছু কিছু ছাত্রছাত্রী সকালে গিয়ে আবার সন্ধ্যায়ও পড়তে আসত, এই-যে সকালে-বিকালে ছাত্রছাত্রীদের পড়তে আসা-যাওয়াটা ছিল সেখানে কিন্তু টাকাপয়সার কোনো বালাই ছিল না বললেই চলে। শুনেছি এমন কয়েকজন ছাত্রছাত্রীদের বেলায় এমনটি হয়েছে যে, বৃত্তি পরীক্ষা দিবে বা মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের টাকা জোগাড় হয়নি বলে বাবা সে-খরচটা দিয়ে দিতেন। আমি যখন থেকে এই পড়াশোনার আসরে বসতে শুরু করলাম সেটা সবার সাথে একসাথেই, আলাদা করে নয়। আর সে-আসরে আমিই ছিলাম সবচেয়ে গাধা ছাত্র, কিছুই পারতাম না, আমার বন্ধুরা, বড় বড় ছাত্রছাত্রীরা সবাই কিছু-না-কিছু পারত, আর আমার বড় দুই দাদা বরাবরই প্রতি ক্লাসে প্রথম থাকতেন, তাই আমি খারাপ ছাত্র ছিলাম বলে কিছুই মনে রাখতে পারতাম না, সেটা নিয়ে বাবা মাঝে মাঝে মার্ কাছে আক্ষেপ করতেন। পড়তে বসলেই আমাকে বাবার ঠিক কাছাকাছি বসতে হতো আর প্রায় প্রতিদিনই একমাত্র আমিই ছিলাম যার ভাগ্যে একটা-দুইটা ঠাসঠাস জুটত, সেটা নিজের ছেলে বলেই বোধহয় জুটত তাছাড়া অন্য কোনো ছাত্রের কপালে জুটেছে বলে আমি দেখিনি। আমি আমাদের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়েই পড়তাম, বাবার সাথে যেতাম-আসতাম; যখন চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছি, লক্ষ করলাম আমাদের স্কুলের হেডস্যার বাবাকে খুব সম্মান দিয়ে স্যার স্যার করে ডাকতেন, পরে জানলাম আমাদের হেডস্যার বাবারই ছাত্র ছিলেন। এমন অনেক ছাত্রছাত্রী ছিলেন যারা কেউ কেউ ডাক্তার আবার কেউ কেউ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করছেন। এমন অনেক অনেক উদাহরণ আছে একদিন হয়তো আরো বিস্তারিত তুলে ধরতে পারব।

কিশোর বয়স থেকে ধর্মপ্রাণ ছিলেন বাবা, ঈশ্বরভাবনায়-পূজাঅৰ্চনায়, ধ্যান-আরাধনায় নিমগ্ন থাকতেন। মাত্র পনেরো বছর বয়সেই দীক্ষিত হন, গুরুভজনে গুরুভাইদের নিয়ে উনার সাধনকর্মে আর আধ্যাত্মিক আরাধনায় নিমগ্ন থাকতেন (উনার গুরু-শিষ্য ভাবলীলা সম্পর্কে বিস্তারিত অন্য-একটা লেখায় বলব)। জন্মগত ব্রাহ্মণ না হলেও উনার উচ্চমার্গীয় ব্রহ্মজ্ঞানে ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ।  তাই তো উনার গুরুদেব উনাকে দীক্ষা দেয়ারও অনুমতি দিয়েছিলেন। আমাদের স্থানীয় জন্মগত ব্রাহ্মণরা কখনো বাবার সাথে ধর্মীয় তর্কে যেতেন না, বাবার ধর্মীয় ভাবনাকেই সহমত ও সম্মান প্রদর্শন করতেন। নিজের বাড়িতে পূজাঅর্চনাগুলো বাবা নিজেই করতেন, কোনো ব্রাহ্মণ ডাকা হতো না। কীর্তনের আসরে গান গেয়ে, হারমোনিয়াম বাজিয়ে, খোল বাজিয়ে সরব রাখতেন ভক্তশ্রোতাদের — তা সে প্রথম প্রহর হতে অষ্টপ্রহর, অষ্টপ্রহর হতে ষোলোপ্রহর কীর্তন, কখনো ক্লান্ত হতেন না। এক নির্মল আনন্দের আভাস আর প্রশান্তির ছাপ থাকত মুখ জুড়ে। কালীপূজার রাতে সারারাত ধরে চলত শ্যামাসংগীত যার মধ্যে প্রধান ছিল মালসি গান, মালকোষ রাগের উপরে এই শ্যামাসংগীতের আধার। নিশি ফুরিয়ে ভোর হয়ে এলে প্রসাদ খেয়ে বাড়ি ফিরতেন, আমরা ঘুম ভেঙে দেখতাম বাবা ঠিক উনার নিত্যকর্মগুলো প্ৰতিদিনকার মতোই করছেন কোনো ক্লান্তির ছাপও নেই। সে এক অন্থহীন ঘটনাপ্রবাহ।

কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই আমাদের ঠাকুরের ঘর, কাঠের পাটাতনের উপর বসেই ছিল নিত্যদিনের কীর্তনের আসর, পড়তে আসা ছাত্রছাত্রী সহ সবাই দোতলায় উঠে প্রথমেই গুরুবন্দনা সংগীত — “ভবসাগর তারণ কারণ হে / রবি-নন্দন-বন্ধন-খণ্ডন হে / শরণাগত কিঙ্করভীত মনে / গুরুদেব দয়া কর দীনজনে।” সবাই কণ্ঠ মিলায়ে গেয়ে যাওয়া, কেউ হারমোনিয়াম, কেউ খোল, কেউ করতাল, কেউ কাশী আর কেউ হাতেতালি। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর প্রতিদিনের এমন চর্চায় কেউ কেউ কীর্তনের আসরে হয়ে উঠতেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাল্লা দিয়ে গাইত স্যারের সাথে নিখুঁত সুরে আর তালে। আমরা ঘরের বাইরের সবাই ঐ আসরেরই ছাত্র ছিলাম।

আজো আমি খুঁজে পাই, অনুধাবন করি বাবার দেয়া শিক্ষাগুলো, সেই সময়, সেই ভালোবাসা, সেই জ্ঞান এখনো যেন অম্লান। এত বছর পর হয়তো একটু একটু করে বুঝতে পারছি, অনুধাবন করতে পারছি যে কী আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মনের ভিতরে, কানের মধ্যে মন্ত্রের মতোই ভেসে আসে কথাগুলো, এটাকেই হয়তো গুরুর দেয়া বীজমন্ত্র বলে।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you