কয়েকদিন আগে দোহার-এর যেমন ২০ বছর পূর্তি হলো, তেমনি দোহারের সাথে আমার আত্মিক সম্পর্কের ১৭ বছর। তার সাথে একজন প্রাণের মানুষ কালিকাদা ও উনার প্রতি আমার ভক্তিপূর্ণ মন। সময়ের স্রোতে চলতে চলতে কিছু চেনাজানার ভালোবাসায় আত্মিক বন্ধনের সম্পর্ক গড়ে উঠে কিছু গল্পের সৃষ্টি করে দেয়। তেমনি দোহারকে মনের গভীরে ধারণ করে একটা বন্ধন তৈরি হওয়ার গল্প।
শুরুটা খুব ছোটবেলা থেকেই। বাংলার একদম ভাটি অঞ্চলে (আজমিরীগঞ্জ, হবিগঞ্জ) আমার জন্ম। বেড়ে উঠেছি নিজেদের বাড়িতে নিত্যদিনের কীর্তন গানবাজনায় আর কীর্তন-আসরে বাবার সাথে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে। জন্মপরবর্তী সময় থেকেই ‘দোহার’ শব্দের সাথে পরিচয়টা খুবই গভীর ও স্বাভাবিক, কারণ কীর্তনের আসরে মূল কণ্ঠস্বরের পিছন পিছন সমস্বরে গাওয়াই হচ্ছে দোহার দেয়া। সেটা আমাদের নিত্যদিনের ব্যাপার ছিল আর এভাবে দোহার দিতে দিতেই গ্রামের মানুষজন গানের সুর আর কথা শিখে নেয়। তাছাড়াও আউলবাউল-বয়াতি-গাজীর গান শোনা ও স্বয়ং তাদের সাথে বিচরণ করা ছিল আমার নিত্যদিনের সঙ্গী।
ছন্দপতন হলো হঠাৎ করে বাবার চলে যাওয়ায়। কিছুদিনের মধ্যেই স্থায়ীভাবে আমরা চলে আসলাম সিলেট শহরে, আমার কাছে প্রাণহীন কঠিন বাস্তবতা, চলছিল পড়াশোনা, তার মাঝে অল্পবিস্তর গানের চর্চা, কিন্তু দিন দিন সরে যেতে বসেছিলাম আমার শিকড়ের সংগীতের ধারা থেকে, চারিপাশ খুব নিমেষেই তথাকথিত আধুনিক হতে শুরু করে দিলো। ব্যান্ডের গান, রক-পপ-আধুনিক আর পাঁচমিশালি সংগীত, তার সাথে চারপাশের হেঁড়ে গলার সংগীতচৰ্চিত উঠতি গায়ক-গায়িকাদের ডায়রি নিয়ে দৌড়ঝাঁপ দেখে আমারও ছুটতে ইচ্ছা করত মাঝে মাঝে, কিন্তু পারিনি, মনে হতো আমার আর কিছুই নেই, আমি আমাকে হারিয়ে ফেলেছি। একদিন হঠাৎ করে কোথা হইতে শিকড়ের টান পেলাম, কিছু লোকগানের ছান্দিক আর নান্দনিক সংগীতে মন ফিরে পেতে শুরু করল আমার ভাটির গান।
২০০৩ সালের কোনো-এক সময়, কিছু লোকগানের রেকর্ড শুনতে পাই যা ‘দোহার’ নামের কলকাতার একটি গানের দল প্রকাশ করেছিল, অসাধারণ কিছু লোকগানের, অসাধারণ উপস্থাপনা, যেমন গানগুলোর সুন্দর কম্পোজিশন তেমনি দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের মনমাতানো বাজনা। ‘বাংলা গানের দল দোহার’ নামটা শুনেই একটা নাড়ির টান অনুভব করলাম, মনটা নিমেষেই কেড়ে নিলো, আমি যেন ফিরে পাওয়ার আভাস পেলাম আমার শিকড়ের গান, শুনতে শুনতে অনুধাবন করতে লাগলাম লোকগানের অসাধারণ উপস্থাপনার ঢং ও তার নির্যাসকে সবার মাঝে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা আর জানলাম তার পিছনের যে মূল কারিগর ‘কালিকাপ্রসাদ’। তখনো সিলেটে গুটিকয়েক সংগীতপিপাসু ছাড়া দোহারের গানগুলো সবার কাছে পৌঁছায়নি বা জানার সুযোগ পায়নি, আমাদের বন্ধুমহলের মাঝেই চর্চিত হতে থাকে দোহার ও তার কাজকর্ম, ধীরে ধীরে সময়ের ধারায় দোহারের বিস্তার ও প্রযুক্তিসুবিধায় বাড়তে থাকে দোহারের প্রচার ও প্রসার। দিনে-দিনে দোহার ছাপিয়ে যে-মানুষটি প্রাণের মানুষ হয়ে ওঠেন তিনি কালিকাপ্রসাদ, প্রিয় কালিকাদা।
কালিকাদা, যিনি বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমকে প্রাণের মুর্শিদ মানতেন সেই মনের মানুষের খোঁজে দলবল নিয়ে স্বয়ং হাজির হন আবদুল করিমের বাড়িতে, যেন গুরুর বাড়ি গিয়ে শিষ্যত্ব গ্রহণ। এই যে উনি পেলেন উনার মুর্শিদকে, আমরাও যেন ভিন্নরূপে পেলাম কালিকাদাকে। কালিকাপ্রসাদ হয়ে উঠলেন আমাদের কালিকাদা। এই যে সহজ মানুষকে সহজ গানের মাধ্যমে সহজ কথায় পৌঁছে দিতে লাগলেন সবার মাঝে, আমরা পুলকিত হয়ে শুনতাম উনার কথা, গান শোনার থেকে যেন কথা শোনার বা গানের ব্যাখ্যা শোনার জন্যে মন ব্যাকুল হয়ে উঠত। মনে হতো আমিও এভাবেই ভাবতে চাই, আমিও এইভাবে গানগুলো অনুধাবন করতে চাই, আমিও এভাবে গাইতে চাই, সে তো আমারই মনের কথা। তখন আমি লোকসংগীত শুনছি, ভাবছি, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে অনুপ্রাণিত হচ্ছি। এই যে নিজের চাওয়ার সাথে, কালিকাদার করণীয় কাজগুলো মিলে যাচ্ছিল অবিরত এতে কি করে যে দিনে-দিনে একটা আত্মার বন্ধন তৈরি হয়ে গিয়েছিল নিজের অজান্তেই সেটা বুঝতে পারিনি।
কালিকাদার একটা বিষয় খুব লক্ষ করতাম, কথা বলতে বলতে ডুবে যেত কথার গভীরে, একটা অন্তরের সাথে যুক্ত হয়ে যেত আমার মতো আরো হাজারো অন্তর। সাবলীল পরিস্কার আর সহজ বাচনভঙ্গি দিয়ে জয় করে নিয়েছিলেন হাজারো মানুষের অন্তর। সবাইকে একসাথে নিয়েই যে সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা করতে হয় তা শিখেছি কালিকার কাছ থেকেই। বাউলগানকে অন্তরে ধারণ করে সঙ্গ করেছেন বাউল-ফকিরদের সাথে, তুলে ধরেছেন বাউল পদকর্তাদের তত্ত্বকথা। এত বছরে দোহার তথা কালিকাদার কর্মকাণ্ডের বিস্তার অনেক, খুব অল্পকথায় শেষ হবার নয়। খুব উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কর্মকাণ্ড যা লোকসংগীতের ভাবনাকে আরো সুন্দরভাবে মানুষের মণিকোঠায় পৌঁছে দিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম ‘সহজ পরব’ ভাবনা যেখানে তুলে ধরা হয় আমাদের গ্রামবাংলার লোকসংস্কৃতিকে, দোহারের মাধ্যমে চিনলাম বিখ্যাত ঢোলকবাদক বলরাম হাজরাকে, চিনিলাম মনসুর ফকিরকে, গ্রামবাংলার আরো বাউল সাধুদের। জিটিভিতে সারেগামাপা অনুষ্ঠানে কালিকাদার পরিচালনায় লোকসংগীতগুলো সবার কাছে অন্যমাত্রায় স্থান পেয়েছিল। লোকসংগীতের কর্মশালা হবে, সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে দোহার।
আজো হৃদয়ে ভালোবাসা অবিচল, একটা সুখানুভব সর্বদা চিত্ত প্রফুল্ল করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দোহার শুনতে স্বচ্ছন্দবোধ করি, এ যেন আত্মার সাথে মিশে-যাওয়া আত্মার সম্পর্ক। আজও কালিকাদার সশরীর অনুপস্থিতিভাবনায় চোখ ছলছল করে, বুকের ভিতরে একটা শূন্যতা তৈরি হয়ে হাহাকার করে ফেরে, কিন্তু সেইসাথে জাগ্রত হয় প্রচণ্ড অনুপ্রেরণার। দোহারের কথা মনে এলেই প্রথমে যে-মানুষটির ছবি ভেসে ওঠে উনি কালিকাদা, আর মনে মনে একটি গানের সুর বাজতে থাকে …
বন্ধু তোর লাইগা রে আমার তনু জরজর
মনে লয় ছাড়িয়া রে যাইতাম থুইয়া বাড়িঘর
বন্ধু তোর লাইগা রে …
… …
- আমার বাবা || গুরুপ্রসাদ দেবাশীষ - June 21, 2020
- দোহার ও আমার আত্মিক বন্ধন || গুরুপ্রসাদ দেবাশীষ - August 23, 2019
COMMENTS