এই ইস্কুল রে, এই মেট্রিক এই ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা রে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দাও রে, বিদ্যালয়ে শিক্ষক, কড়া গ্রেড পাও রে, ছেলেমেয়ে হুলস্থুল একটু প্রেম দাও রে, তোমার লিগা সব কুড়ামু, স্যার বসেদের গালি, তারবাদে এগল্লি ঐগল্লি রাজপথ ঘুইরা, বিসিয়েস দিয়া প্রশ্ন ফাঁস দিয়া একবারে বড় হয়ে উঠে গেলাম রে। এই লুটেরা অর্থনীতির কোলে ঘেঁষতে চাইতে, অনেক পাউয়ে কদম মিলাইতে, আপিসে আদালতে কলম ঘষতে ঘষতে স্যার ডাকতে ডাকতে, সংসার সমাজের চাপ মানতে মানতে, আমাগো পিরিত ভাংতে ভাংতে, বোনের মায়ের ভায়ের বাপের আদর চুমা থিকা দূরে যাইতে যাইতে, আমাগো শিশুকাল একটা লাল মুরগের ঝুঁটির লগে দোস্তি কইরা ফেলায়। তারবাদে ভাবতে থাকি ঐটাই ছিল, শিশুকাল ছিল আর আছিল বিস্ময়, নদীতে, উঁচা উঁচা টিলাতে, মেঘের ভিত্রে লালনীল ঘাসফুল বইনের নাকফুল মিলাইতে মিলাইতে ধুপ কইরা কোনো তাতানো দুপুরে একটা পাতলা বেদনা কই থিকা জানি আসে কই থিকা জানি যায়গা। পাতলা জর্জেটের সফেদ উড়নীর মতন কইলজার উপরে আস্তর পড়ে মিহি বেদনার। কুয়াশাপুর তখনে আমাগো একমাত্র দেশের বাড়ি।
এম্নে কইরাই অনেক কথা ভাবন যায় কবি বিজয় আহমেদ-এর ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ পড়তে গেলে। বিজয় আমার দোস্ত, তাই পক্ষপাতহীন কথায় জড়ানো মুশকিল হয়া যায়। আমারে বইটা দিয়া কইল, তর পুলাপানের লিগা। বইটা লয়া আমি আসলে খানিক খাবি খাই। খানিকটা কফিটেবিল সাইজের বই। ভিত্রে রাজীব দত্তের ইলাস্ট্রেশন ( প্রচ্ছদও তারই করা) একরঙা, লাল। আর বিজয় দাবি করতেছে তার এই লেখা কবিতাগুলা পুলাপানের লিগা, আন্ডাবাচ্চার লিগা। বই খুইলা পড়তে থাকি। আমাগো সময়ে মানে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকেও বাচ্চাগো বা শিশুপাঠ্য বইলা যে বইগুলা বাইর হইত অইগুলাও একরঙেই ছাপানি হইত, হয়তো কাঠের ব্লকের ছবি সাথে জুইড়া দেয়া। তখনে বুঝতাম আমরা গরিব দেশ চাইর কালারে ছাপানি যায় না, ছাপাইলেও পয়সা নাই। অন্য এক বাচ্চাগোলিগা প্রকাশনীর বড় ভাই কইছিলেন একটা গল্প, এইগুলা তো (তার চাররঙা ছবির বইগুলারে দেহায়া ) বাচ্চাগো বই এত দাম ক্যা ? কমায়া রাখেন।
তা যা কইতাছিলাম, এই লাল মোরগের ঝুঁটিও বাই-কালারে ছাপা। বইটা দেখলে আমাগো দরিদ্র শিশুকাল মনে পড়ে। শিশুকাল পাল্টাইছে টের পাই, ঘরে যে আন্ডাবাচ্চাগুলা আছে তাগো লগে আমাগো আর কোনো মিলই নাই। তাগোরে শাসাইতে গিয়া, আদব লেহাজ লয়া বয়ান দিতে গিয়া খালি নিজেগো শিশুকালের কথা টাইনা আনি এইদিক অইদিক থিকা। মানুষের অভ্যাসই বোধয় এমুন। কিন্তু মাঝেমাঝে এই বাচ্চাগো শিশুকাল আমি একদমই চিনা পারি না। এই এক অদ্ভুত অচিন শিশুকাল। এরা কি পড়ে আর কি পড়তে চায় এই নিয়া আমার তেমন কোনো যোগাযোগ নাই। শিশুকাল শেষ হউনের পরে যেমনি কইরা শিশুখাদ্য বাদ দিয়া ঝালমশ্লা খাইতে শিখছি, এমনি শিশুপাঠ্যও তেমনি ছুইড়া ফেলায়া প্রচুর ঝালমশ্লা দিয়া ঝালমুড়ি খাইতেছি। তাই রক্তমাংশের শিশুতে আমাগো যোগাযোগ তেমন নাই। তাই ঠিক কইরা ধরতে পারতেছি না, শিশুরা এই কবিতাগুলারে (ছড়া-ফড়া এইসব বলতে আমার ভালো লাগে না। কবিতা ছড়ার মতন সুন্দরী হইতে পারে তেমনি ছড়াহীনতা নিয়াও সে বুক উঁচায়া তার জালওয়াও দেখাইতে পারে।) কেম্নে আপ্যায়ন করব তার সম্পর্কেও কোনো সিগ্ন্যাল পাইতাছি না।
বইডা পড়তে পড়তে আমরা ধানের দিনে যাইতে পারি, গাইতে পারি ধানের গান ঘুমনুপূরের ঝানানাঝানানা। কিন্তু আমি যে-শহরে বড় হইছি তাতে তো এইসব নাই। এইসব দেখা পাইতাম ইস্কুলের ছুটিতে গেরামে গিয়া। মাঝেমাঝে গেরামে যাওয়া হইত, এই ছিল গেরামের লগে আমার খাতির। বিজয়ের কবিতাডি পড়লে তা-ই মনে হয়। একটা নির্দোষ গ্রামবাংলা। পুলাপানের লিগা লিখছে বইলা হয়তো। ছুটিতে একটা কিশোর/কিশোরী অই প্রকৃতি আর নিসর্গ দেখতে দেখতে অবাক হইতে হইতে কোন মায়ার বান্ধনে জড়ায়া গেলগা। অই-যে ধান আসতেছে উঠানে কী বেহেশ্তি তার ঘেরান। দুই তিনটা পক্ষী, পাহাড়, নানান রঙের দুর্বা, বাঁশি ম্যাঘের মতন আউলা তার বাড়ি ফিরনের বহুত শখ। এই-যে ট্রেইনে বাড়ি যাইতে যাইতে, অনাগত আনন্দের দিনের কথা ভাবতে গিয়া, অনন্ত ঝিকঝিক রাস্তায়, মনফড়িঙে কত-না-কত আল্পনা আঁকতে থাকে, আঁকতে থাকে তারাগো বইনে। এমনে কইরাই বিজয় দেখে অথবা বাচ্চাগো দেহাইতে চায় ছোটখাটো নির্ভেজাল সুখ আসতে থাকে অইসব বনবনানী গেরাম আর পাহাড়ের সিনায় সিনায় ছড়ানো গাছপালা আর অর বইনের লাল খোঁপা থিকা। এভ্রিডে মান্ডেইন সিনারির ভিত্রে এত সুখ, এইরকম চোখের পাপড়ি মুদানো রইদের আলোর ভিতরের সুখ, প্রাপ্তবয়স্ক হইতে হইতে ভুইলা যাইতে থাকি। অথচ, অনেক জ্ঞানবিজ্ঞান পার হয়া শেষে দেহি সুখ নাকি থাকে মনের ভিত্রে, যা ভাবছিলাম লোকের মালা, আর পকেটের ফোলা রোগে, আমাগো বাইত্তে আয়া সুখ দিয়া যাইব, তা তো একদম মিথ্যা।
পড়তে পড়তে মনে হইতে থাকে এইটা বোধয় বুড়াকালের বিজয়ের নিজস্ব ছেলেবেলা। আরেকবার চান্স পাইলে এমনেই সে দেখতে চায়। পুরা বইটা জুইড়া কী জানি একটা মনখারাপের পরত। ঐ-যে বাপরে লয়া সে লেখতেছে,
একটা পাহাড় টানছে বুকে
একটা পাহাড় হাসছে সুখে;
একটা পাহাড় কাঁদছে দুখে
একটা পাহাড় ভীষণ কাছে!
একটা পাহাড় অনেক ডানা
খুব গভীর, মায়ার চাউনি!
ডাকছে আমায় ‘কই রে ছেলে
আয় ঘাসের গল্প শুনি’!
বাপ্রেবাপ, এমুন জন্মেও হুনি নাই। আমাগো পিতৃপ্রেম কবেই-যে আব্বাগো পাহাড় বানায়া দিছে খিয়ালই করি নাই। আমরা যারা এতিম হইছি তাগো লিগা তো এইটা সাংঘাতিক। তারপরে দেখেন
‘ধানের গান’-এ লেখতেছে,
পাখির ডানা
পাহাড় জুড়ে ওড়ে
রৌদ্রছানা
মনটা হুহু করে!
ধানের গান
শুনছো তুমি যেই !
মধুর আহা
পথটা হারাবেই !
এই হুহু-করা মনটা কার? এইটা বাচ্চা বিজয়ের, আর আমাগোও। আমরা যারা এখনো অইসব শিশুকালের আইল ধইরা হাঁটতে চাইতে থাকি, শহরের ঘামে, বাসে, কামে ধুকতে ধুকতে, বড় সাবের ঠাপ খাইতে খাইতে। তা এই কবি কি তাইলে এই বই দিয়া শৈশবের আইলে ঘুইরা বেড়াইতে চায়? আরে ভাই বাস্তবফাস্তব এইসব মাননের দরকার নাই এই বুঝছি। বাঁইচা থাকা লাগব তো। অতীত আঁকড়ায়া ধইরা নিশা করার মিধ্যে খুব বেশি ফযিলত নাই। আছে খালি ডুকরায়া ডুকরায়া কান্দা। তেমনি শৈশবের মেঘে চইড়া বেড়ানিতেও কোনো ক্ষতি নাই। এর ভিত্রেই কবি নিজের ছুডুকালো আইনা সামায়া দিছে। দেখেন,
ফড়িং পাখি ভাব ধরেছে
পালালো ইশকুল
ঘাসের বনে
আঁকছে দেখ
বোনের নাকফুল
ফড়িংকবি, রঙ চিনেছে
লালের সাথে নীল
টানলে রেখা, যেমন খুশি
পড়ল মনে চিল!
কবি নিজের কবি হউনের ঘটনাও লেইখা ফেলাইতেছে। পুরা বইয়ে তার নিজের সাথে এইরকম কথা আরো অনেকই আছে। তার কাব্যের সাথে বোঝাপড়া নিয়া লেখতেছে,
একটা পাখি আঁকি, হয় না
একটা মাছ আঁকি, হয় না
পাখিগুলো কই থাকে, দেখাও
মাছগুলো কই থাকে, ডাকাও
রঙগুলো তারপরে মাখাও
এলেবেলে কোনো কিছু হোক না!
চাঁদ–আলো লাল হয়ে যাক না !
আমি কাব্যের ব্যাকরণ বুঝি না, কোনোদিন হয়তো বুঝতেও চাই নাই, অইসব কাব্যের পরিভাষা। তাই ভারী ভারী শব্দে অনেককিছুরেই বাগে আনতে পারি না। কিন্তু দেখেন আমরা ছোটগো কাব্য লয়া যেমন ধারণা মাথায় রাখি, তারচেয়ে বিজয়ের লেখাগুলা অনেক দিক থিকাই আলাদা। মাঝে মাঝে মনে হয় এইসব আসলে একটা কনফিডেন্ট বাচ্চার মনোলগ। আমার বেশ ভাল্লাগে। যদিও অনেক ট্রাডিশনাল ইশারাই পাইবেন তার বইতে। এই ধরেন ধানের গান, মেঘের পাহাড়ের পুত্র, টুকটুইক্কা বৌ নানান ফুল আর ইচ্ছামতন প্রকাশের সাহস। এইসব আমাদের গ্রামের আহ্লাদ। আর দেখেন তার কাছে এইসবই কিন্তু একটা ‘কুয়াশাপুরের’ ঘটনা। যারে সে আর ঠিকমতে জড়ায়াও ধরতে পারতেছে না। এই বেদনাই মাঝেমাঝে হয়তো বাইর হয়া যাইতেছে। ছোটরা পইড়া হয়তো বুঝতে পারবে, বড় হইলে, ছোট না থাকবার বেদনা তারে ঘিরা ধরতে পারে। তারপরেও একটা সুখী গ্রাম থাকে। শহরে কবি হয়তো তেমন মানায়া নিতে পারেন নাই, নয়তো, তিনি চান না কোনো শিশু শহরে এই জঘন্য দুনিয়ারে মানতে শিখুক। তার অ্যাটিচিউডের মইধ্যেও একটা গেরাইম্মা ভাউ আছে খিয়াল করছি। এই-যে কী সহজেই বইন বানায়া ফেলাইতেছে কী সহজেই ভাই বানায়া ফেলাইতেছে। এইসব ঈর্ষণীয়, ব্যাপক ঈর্ষণীয়। এইসব পড়তে পড়তে বুকটারেও খানিক আলগা কইরা মেইলা ধরতে চায় মন, আয় রে আমার হারানো বইন বুকে আয় আরে আমার ভাই, তোর কান্ধে চইড়া, ‘নীল মখমল হয়া থাকা, খুব কুয়াশার ঘাসের দল’ দেখতে যামু। অই-যে কবি কইতেছে,
নীল তুলোর বল
দেখছে কোলাহল
হাওয়া আসে ধীরে
একলা যাবি উড়ে!
মেঘের ছানা ওই
নাম হারালি কই ?
ডাকছি আমি একা
দুপুরে হোক দেখা!
এর মইধ্যেই আপনেরা অই পুঁজিবাদী সমাজের অ্যালিয়েনেশন, লোনলিনেস ইত্যাদির নানান ইশারা পাইতে পারেন। নিউক্লিয়াস ফ্যামিলির একলা বাচ্চার দুনিয়া। আর দেখেন তার বুকে বুকে মিলনের কী আশ্চর্য হাহাকার!
আজকা যখনে এই লেখা লেখতেছি তখনে চোখে ভাইসা আসছে সিরিয়ার বাচ্চাগো রক্তমাখা ছবি। শিশুরা আর মানুষ নাই একেকটা লাশ হয়া ফিরতেছে পৃথিবীর বুকে। আর ঘরের কোণে রোহিঙ্গারা তো আছেই। আর ঘটনা খুঁজলেই পাইবেন এইদেশে বাচ্চাগোরেও কেম্নে রেইপ করা হইছে, পাছায় কম্প্রেসরের হাওয়া দিয়া মাইরা ফেলা হইছে। এইসব ছাড়ায়া একদিন বাচ্চারা সাহসী হয়া উঠব। বিজয়ের কবিতাগুলা নিজের মনের মতন পড়তে পারব।
লাল মোরগের ঝুঁটি বইটাতে কবির নিজের কৈশোরে ফিরা যাউনের আকুল বাসনা আছে। সে হয়তো অমন সুন্দর একটা শৈশবই চায়। তারও বাপ হউনের বয়স হইছে, প্রকৃতি বোধয় তার কইলজাতে পিতৃস্নেহের ফুল ফুটাইতেছে। সেও তার শিশুদের আমাদের শিশুদের একটা মনোহারী রাস্তা খুইলা দেউক। শিশুরা তাতে হাঁটব, আমরা দেইখা কইলজা জুড়ামু। আর আমরাও কোনো-একদিন ভরদুপুরে চোখ ভিজামু আমাগোর শৈশবের লিগা। আর কিই-বা আছে মানুষের।
লাল মোরগের ঝুঁটি, বইটা প্রকাশ করছে আগামী প্রকাশনী। এইবারের বইমেলাতেই [২০১৮] বাইরইছে।
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ।। মালিবাগ
লাল মোরগের ঝুঁটি
বিজয় আহমেদ
কৈশোরোপজীব্য কবিতাবই ।। দুইবর্ণা রাজকীয় আকৃতিক ছাপা ।। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬৪
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ রাজীব দত্ত ।। প্রকাশক আগামী প্রকাশনী ।। প্রকাশকাল ২০১৮ ।। ঢাকা ।। দাম ৩২০ টাকা
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS