সহজ চোখে তাকায়া থাকার একেকটুকরো মুহূর্ত

সহজ চোখে তাকায়া থাকার একেকটুকরো মুহূর্ত

কোনোকিছু পড়ার সময়, বিশেষত কবিতা পড়ার সময়, আগের পড়ার অভিজ্ঞতা বারবার সামনে এসে যায়। এসে যেমন পথ দেখায়, তেমনি পথ করে ব্যাহতও, পথরুদ্ধ করে, নির্দেশও করে পথ। সবসময় এই পথরোধ বা পথনির্দেশের ঘটনাটা যে সুখের হয়, তা না। আপদের মতোই মনে হয় বেশিরভাগ সময়। যা-ই হোক, এর থেকে মুক্তিও নাই বোধহয়। বিশেষত কবিতা পড়ার সময়। লাইনে লাইনে না-হলেও রিডিং বিটুয়িন দ্য লাইন্স পূর্বজ কবিদের/কবিতার মুখ-চোখ এসে পড়ে পাঠকের পাতে। ব্যাপারটা ভাতের বর্তনে চুল পড়ার মতো অস্বস্তিকর যেমন হয়, এসেনশিয়্যালি বিউটির সঙ্গে মুলাকাতও ঘটে এইভাবে, এই পন্থে, এই পন্থায়।

কেন বলছি ‘বিশেষত কবিতা পড়ার সময়’ বারবার, তার একটা কারণও বলি। টিএস এলিয়ট তো তিরিশোত্তর বাংলা আধুনিক কবিতায় ইম্প্যাক্ট রেখেছে একদম গোড়া থেকে; এলিয়টের ওয়েস্টল্যান্ডিক ভার্সিফিক্যাশন দিয়ে যেমন সরাসরি ইম্প্যাক্টেড বাংলা আধুনিক কবিতা, তার কবিতাভাবনাও তো বাংলায় নানাভাবেই ইঞ্জেক্টেড লক্ষ করি। ট্র্যাডিশন অ্যান্ড ইন্ডিভিজুয়্যাল ট্যালেন্ট তো অ টু চন্দ্রবিন্দু সকলেরই চিন্তায়-বুলিতে দেখতে পাই। মৃত কবিদের হাড়গোড়পোড়া ছাইয়ের উপরেই জীবিত কবি তার খাড়াইবার জমিনটা বানাইতে পারেন, শূন্যের মাঝারে ঘরবাড়ি বানাইতে পেরেছে কেউ? কথা হাছা। আর এইখানেই বিপত্তিটাও।

পূর্ববর্তী পড়াশোনা কোনোকিছুর রসাস্বাদনে কতটা বিড়ম্বনার হতে পারে, এর একটা সাক্ষ্য বুদ্ধদেব বসুর আত্মজৈবনিক খেদোক্তিতে পেয়ে যাই। বসুর কবিতা-নাটক-উপন্যাস-গল্প সবটা না-পড়লেও উনার প্রবন্ধগদ্য সমস্তই পড়া আমাদের বেশিরভাগ পাঠকের। তেমনই কোনো-এক গদ্যে বসু আক্ষেপ করছিলেন যে বাল্যবয়স থেকে এত কবিতা পড়ার জন্যে পরিণত বয়সে এসে তার খুব দুঃখ হয়; কেননা, আকাশে মেঘের ঘনঘটা আজ আর তিনি নিজের মতো উপভোগ করতে পারেন না, তাতে মেঘদূত বা কালিদাসেরই কিংবা আর-কোনো সংস্কৃত শ্লোকের প্রভাবটা অ্যাভোয়েড করা সাধ্যের প্রায় বাইরে তার পক্ষে। এই আফসোস অবশ্য অতটা আমাদের মধ্যে থাকার কথা না। কারণ সময় পাল্টেছে। এখন আপনি যদি ইথিয়োপিয়ার কবিতায় ক্ষিধেতেষ্টার প্রেজেন্টেশন কীভাবে হচ্ছে সেইটা না জানেন তাইলে বাংলাদেশের ক্ষিধেতেষ্টার মহাকাব্য করতে যেয়ে এমনকিছু করবেন যা অলরেডি ইথিয়োপিয়ার কবিতায় এক্সিস্টেড। উৎপলের উৎকেন্দ্রিকতা বা রণজিতের দার্শনিক প্রহেলিকা ইত্যাদি নিয়া বাংলা কবিতায় বিস্তর পনরুৎপাদনের কথা বলা বাহুল্য। অথবা বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যকীর্তন করতে যেয়ে এমনকিছু করে চললেন হয়তো-বা যা জীবন-জসিম-মাহমুদে ক্যাপ্চার্ড। পণ্ডশ্রমপ্রিয়দের নিয়া আমার অবশ্য সমস্যা নাই।

রিসেন্টলি একটা বইয়ের কিছু কবিতা পড়ে সেই বিরল সুখটুকু ভোগ করতে পেরেছি যার বিবরণ লিখতে যেয়ে দেখতে পাচ্ছি স্কিল দিয়া কুলাইতে পারছি না। আলোচনাফালোচনা আর তো কিছু না বিশেষ একটা স্কিল ছাড়া। কাব্য নিয়া আলোচনা মানে প্রিভিয়াস কবি ও কবিতার অভিজ্ঞতার সঙ্গে প্রেজেন্ট কবির ও কবিতার মিল-বেমিল দেখানো। নতুনতা বা প্রাচীনতা বা কালোত্তীর্ণতা বাৎলানো। মোস্টলি। বিরল না-হলেও কদাচিৎ এমন এক্সপেরিয়েন্স হয় যখন তুলনামনস্কতা হারায়া যায়। মানে, যেমন রুসুম এইসব ক্ষেত্রে, এই কবির ডিকশন বা তার কাব্যের প্রযুক্তি কি দিঙনিশানা ইত্যাদি নিয়া বাগাড়ম্বরে ভরা আলোচনা ফান্দা … হাত থমকায় হেন তরিকায় হায়মানি করতে যেয়ে। একমুহূর্তে সেই ফিরে-পাওয়া সহজ চোখটা বাধা দ্যায় বাঁধিগতের বুলি আওড়াইতে। এই সেই মুহূর্ত যখন আগের কোনো পড়াপড়ি এসে পণ্ডিতি করে না আপনার চোখের সামনে। যেমনটা ট্র্যাডিশন্যাল মিউজিক শোনার সময় আমাদের ভিতরে টের পাই, ঠিক তা-ই যেন। করিমের বা হাসনের গানের মতো অনায়াসবোধ্য। অথচ অবিবরণীয়।

কবিতার বইটার নাম ‘তুমি তেমনই বৃক্ষ’, কবির নাম ফজলুররহমান বাবুল। বইটা বাইর হয়েছে সেপ্টেম্বর ২০২০ সনে, বের করেছে ‘চৈতন্য’ নামে একটা পাব্লিক্যাশন। বইটা বাইরাবার অব্যবহিত পরের দুইমাসে এই বইটা আগাগোড়া আমি তিনবার পড়েছি। সিরাতুল মুস্তাকিম। সোজাসাপ্টা। প্যাঁচগোচে না-যেয়ে এই স্বীকারোক্তি করবার পিছনে একটা কারণ হচ্ছে এ-ই যে, এই বইটায় কী-এমন ধন্বন্তরী বিদ্যা বা বেদ বা বেদনাটা আছে যে এই আমার মতো কবিতাসংশ্রবহীনেরেও দুইয়ের অধিকবার পড়তে প্ররোচিত করল, ঘটনাটা আমি নিজেও বুঝে নিতে চাইছিলাম। ফলে এহেন সসংকোচ স্বীকারোক্তি যে জ্ঞানবিজ্ঞানখচিত ক্যারিশমাকাব্যের এই বিপ্লবী বাংলায় কাকচক্ষুর মতো স্পষ্ট সোজাসাপ্টা কাব্যের একটা বই তিন-তিনবার পড়েছি আমি বিগত ২০২০ সেপ্টেম্বর থেকে শেষ-নভেম্বর পর্যন্ত কুল্লে দেড়-দুইমাসের মধ্যে! এবং ভালোবেসেছি তিনের প্রত্যেকবারে। এমন যদি হতো যে এর মধ্যে তথাকথিত রহস্য আছে, বেদব্যথা আছে, জ্ঞানকাঠিন্য আছে তবু না-হয় মানা যেত। “সত্য যে কঠিন তাই কঠিনেরে ভালোবাসিলাম”-সূত্রে একটা রাবীন্দ্রিকতাঝাড়া আলোচনা তাইলে করা যেত। অথবা থাকত যদি ভাষা নিয়া ভাজুংভুজুং, প্রধানত ঢাকাইয়া বা খানিকটা সিলইট্টা বা আর-আর বাষট্টি কিসিমের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা, তবু একটা ডিস্কাশন জেনারেইট করা যেত। ‘তুমি তেমনই বৃক্ষ’ ওসবের কিছুই না, তারপরও তিনবার! সুবানাল্লা বলব, না লাহুল বলব?

হয়, এমন হয় জীবনে একাধবার। ফলে এর একটা খচখচানি আছে। সেইটা সারাইবার চেষ্টা থেকেই এইখানে স্পেসিমেন হিশেবে একাধটুকরা কবিতা প্লাক করছি। কিন্তু সবার আগে বলে রাখি যে এই নিবন্ধের সঙ্গে কবিতাবই ক্রিটিক করবার বা বাংলা সাহিত্য উদ্ধার করে ফেলবার কোনো যোগসাজশ নাই। নিছক কয়েকটা ছোট ছোট কবিতা ফাঁকফোকরে গেঁথে রেখে যেতে এসেছি যেন সবাই বুঝতে পারে কেন বইটা আমি তিনবার পড়ে ফেললাম দুইমাসে এবং অন্তত আরেকবার পড়ার বাসনা রাখি বাঁচি যদি আর একদিন মাত্র।

“যদি ভুলে যাই / মনে রেখো… / পথের ওপর হারিয়ে তোমায় / লিখছি আমি গান” — এই পিচ্চি সাইজের পঙক্তিনিচয় দিয়া আরম্ভ হয়েছে বইয়ের পয়লা কবিতা, যার আয়তন চারপৃষ্ঠা বা আস্ত দুইটা পাতা, আর কবিতার নামও ‘তুমি ছিলে ফুল, আমি পাতা’। বাবুলের পঙক্তিনির্মিতিই পিচ্চি পিচ্চি। চারপৃষ্ঠা, আড়াইপৃষ্ঠা, আধাপৃষ্ঠা বা এক-দেড়পৃষ্ঠা ব্যাপ্তির একেকটা কবিতা পড়ে মনে হয় যেন ঘুঘুপৈখের চোখ বা শ্রাবণবৃষ্টির ফোঁটা বা শীতরজনীর শিশির পড়লাম। টুপ। ছয়টা আলাদা টুকরায় বিন্যাস্ত কবিতার লাস্ট টুকরাটা কেমন, দেখি শুনে : “সে-ও এক পৃথিবী—/ যেখানে তুমি আমি / খেলেছি বরকনে… / সে-ও এক পৃথিবী ছিল / রঙিন দিনে… / তুমি লাল / আমি হলুদ / তুমি পাখি— / আমি ডানা— / যদিও আমরা উড়তে পারিনি / হাওয়ায়, আকাশে… / সে-ও এক দিন ছিল / তোমার আমার— / আমি চড়েছি গাছে / তুমি নিচে… / সে-ও এক দিন ছিল / তুমি ছিলে ফুল / আমি পাতা!” বাউলপদের মতো না? শাহ আবদুল করিমের ‘আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা’ বাক্যেরও তবু দুই-তিনটা লেয়ার বাইর করা যায়, কিন্তু ফজলুররহমান বাবুলের এই কবিতাবইয়ের সিদ্ধি এইখানেই যে এর একটা কাব্যকেও জুধা করা যায় না বাচ্যার্থ-ভাবার্থ টাইপের দ্বিকোটিকতায়। যেমন শব্দের ধাতু, আর তারে বিশ্লিষ্ট করা যায় না। মাল্টিলিনিয়ার বা মাল্টিলেয়ার থাকবার শর্তটা ভালো কবিতার ধর্তব্য হতে পারে, তেমনই শিখেছি আমরা, এই কবির বিশেষ এই বইটা ভালোমন্দের বাটখারায় মাপ্য হবার নয়। এর শিক্ষাদীক্ষা আলগ। বা, এ শিক্ষাদীক্ষার ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে যেয়ে জন্মেছে। এমনটা লাখে এক।

গোটা একটা কাব্য পড়ি, এইবার, নিচে :

শুনতে পাচ্ছ?

তোমার মধ্যে হারিয়ে গেল যে—
কী হবে তার?

তোমার মধ্যে আমাকে দেখতে পাচ্ছি না

নানান রঙের অন্ধকার
ভ্রু কুঁচকে যায়
আর
খেয়ে ফেলে আলো

শুনতে পাচ্ছ কি?

কী করব?

এখন সময় শুধু দূরে থাকার?

ওইটুকু। ‘প্রচ্ছন্নতা’। ভাঙতে পারবেন এইটা? ভাঙলে আর কিছু থাকবে অবশেষ? বোঝাবুঝির কিছু নাই। জিন্দেগিভর বহোৎ বুঝদারি হইসে। এইবার সোজা তাকাও। গর্তে ঢোকার আগে যেমন সর্প। করোনাক্রান্তিকালে সেকেলে সমুজদারি ছাড়ো। সোজা হও, আরামে দাঁড়াও, আর স্বীকার যাও।

বইয়ের নামের মধ্যেই বিরাজিত সর্বনামটুকু। সর্বশাঁসটুকু। ‘তুমি’। কিন্তু ‘বৃক্ষ’? কোন বৃক্ষ? ‘তেমনই’ — কী? — কে? — কৌন? বইটা পড়ুন, জানতে পারবেন। বা, না-পারলেও মনে হবে না পারেন নাই। আধুনিক বাংলা কবিতার নামে এইটা কালিদাস পণ্ডিতের ধাঁধার বই নয়, বা কোকা পণ্ডিতের আদি ও আসল ইন্দ্রজাল। কবিতার নামে ধাঁধা ফলাইবার ক্ষেতখামারি না-হলেও ‘গোলকধাঁধা’ নামে একটা কাব্য আছে এই বইটায়, আস্তাটা টাইপ করে দিতেসি :

কোনও-এক বিষণ্ণ সূর্যের মতো
তোমার মুখের ছায়া অর্থহীন—
তা আমরা কীভাবে বলি?

তোমার মুখটি শুধু তোমার…

আমরা কেবল পেছন থেকে দেখি
এক গোলকধাঁধা

তোমার মুখের ছায়া
দেখতে দেখতে দিন চলে যায়

আমাদের বিস্মৃত গল্পের পরিবর্তে
তোমারই গোলকধাঁধায়
বারবার ফিরে আসো তুমি
আর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে থাকো

আমরা তোমাকে দেখি না
কেবল দেখতে থাকি ছায়া।

আল্লা! এই ‘তুমি’ চিনা যায় না? ট্রাই করেন, আস্তিক-নাস্তিক দুই বলদে মিলে। প্রেমিক-অপ্রেমিক দুনো সম্বুন্ধি মিলে এই ছিল্লক নিয়া ঘামাও গোবরভরা মাথা। আর দ্যাখো, কবিতায় কীভাবে ডিল করা যায় দিনদুনিয়া। আছো তো একেকটা আত্মবিশ্বাসের আখাম্বা আজাগর হয়া, নিজেরা যা ভাবো আর বলো ওইতেই দিনদুনিয়া তামা হয়া যাবে মনে করে লাফাও খালি, বেভুদা বান্দরগুলা! যদিও কথা ছিল উভয় গোত্রেরেই সংশয়ী হবার। না, ছায়া নিয়া লাফালাফিতেই জীবন ফকফকা। ফাকিং ফ্যালাসিভরা দাঙ্গাবাজগুলা! আচ্ছা, ইয়াদ থাকতে আরেকটা কবিতা জুড়ি :

সব মানুষেরই আছে শিকড়
আমরা বিশ্বাস করি—
এটা বিশ্বাস করতে হয়

আমরা বিশ্বাস করি
পাটখেতেও আগাছা হয়
আমরা বিশ্বাস করি
ঘাসের শিকড়েও মাটি থাকতে হয়
আমরা বিশ্বাস করি
ঘাসের শিকড়ে থাকা মাটিও বৈচিত্র্যময়—
যেমন বৈচিত্র্যময় টিলা, পাহাড়
বন্যার জল, নিষিদ্ধ পল্লির নারী
কিংবা সবুজ ভুট্টাগাছ সারি সারি

সব মানুষ (নারী-পুরুষ)
সারি সারি ভুট্টাগাছের মতো নয়—
তবু বিশ্বাস করি
মানুষের শিকড় থেকে
বৈচিত্র্যের জন্ম হয়…

এক নয়, দুই নয়, বিভিন্ন প্রকারের, বিভিন্ন শেইডের, বিবিধ ছায়ার, বিচিত্র আলোর ‘তুমি’ পাওয়া যাবে এই বইটায়। দার্শনিক বা কাব্যিক কোনো প্রহেলিকা বা হেঁয়ালি ছাড়া এমন তুমিগুচ্ছ খুব সুলভ নয় বাংলায়। বা, আরেকভাবে এমনও বলা যায়, বাংলায় তো সহজ কবিতার বহুবিচিত্র ধরন দেখেছি আমরা। ভারতীয় কবিতায় এমন কবি অনেকেই আছেন যাদের দ্বারা আমরা ব্যাপক উপকৃত হয়েছি, বাংলাদেশে এমন সহজসিদ্ধির দুইজন কবির নাম নিতে গেলে একজন নূরুল হক এবং আরেকজন কাশীনাথ রায়, ভারতীয় বাংলায় যেমন শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে। এই কবিতাবই দিয়া বাবুল সহজসিদ্ধির আরেক পর্দা আমাদের সামনে এনে দেখালেন।

অতি তুচ্ছ মনে হলেও অত্যন্ত সুন্দর একটা তুমি কীভাবে ক্যাপ্চার করছেন বাবুল, দেখা যাক এই কবিতায় : “তুমি হাসলে পাতাবাহারে বসে প্রজাপতি / গাছে গাছে ফোটে ফুল / তুমি হাসলে আকাশ তার সমূহ দরজা খুলে দেয় / আর সুখের তরণিতে ভাসে পাথরের দেয়াল / সুখে ভাসে হাওয়া মেঘ নদী পাখি / মেঘের আড়ালে চাঁদ হাসে সূর্য হাসে / তুমি হাসলে তারায় তারায় বাজে গান / তুমি হাসলে আমি মহীয়ান!” কবিতা সাঙ্গ ওইখানেই। কিংবা আরেকটা ফ্যুলস্কেইপ শাদা কাগজের কবিতায়, ‘বিরহ’ নামক, এই তুমিই আসে ফের : “একদিন যে-হৃদয় লুটে নিলে তুমি / তা ফিরে পাইনি আর…” খানিক দূরে যেয়ে, একই কবিতায়, “হৃদয় আমার লুটে নিলে তুমি / আর আমি কেবল লিখে গেলাম প্রেম / দূরে দূরে…” ফের পাচ্ছি : “যে-হৃদয় লুটে নিলে তুমি / ফিরে পাইনি তা আর… / আজও তুমি প্রেম আমার” … এই কবিতাটা শেষ হচ্ছে এইভাবে : “তোমার জন্য বুকভর্তি ব্যথা / বুকের ভিতর রক্তক্ষরণ / দেহ যেন দুঃখের ভাঁড়ার / আজও তুমি প্রেম আমার…”। পুনরুচ্চারণগুলিও কত সুন্দর কত মনকেমন হতে পারে, এই বই রিডিং দিয়া আরেকবার মনে পড়বে আপনার। দেখবেন যে একই তুমি, আবার একই নয়, ফিরে ফিরে চোখে ঝাপট দিয়া যায় পাতায় পাতায়। রিফ্রেশিং, রিজয়েসিং, রিভিয়িলিং। “তুমি আগে, তুমি পরে… / বলি, তোমার কোনও সীমানা নেই… / উজ্জ্বল আলোয় কিংবা গাঢ় অন্ধকারেও / চোখ বুজে ফুল-পাতা ঝরে পড়ে— / ঝরে বৃষ্টি তোমার আঙিনায় / সময় ভুলে যায় তার পদচিহ্ন / আর কত আনন্দ-বিষাদের তারা / ঝলসে ওঠে চোখের পাতায়, আর / তোমার সীমানা খুঁজতে খুঁজতে / আমার পথ শেষ হয়ে যায়… / হারিয়ে-যাওয়া চাবির মতো / তুমি ভুলে যেয়ো না আমায়।” এইটা আরেক, ‘নিবেদন’ শীর্ষক, কবিতা একই কবির। একইসঙ্গে পাখির মতন হাল্কা আর পাহাড়ের মতন নিঝুম মিজাজের এই তুমিনামা।

আরও অন্তত গোটা-চারেক কবিতা টাইপ করার পরিশ্রম অ্যাভোয়েড করে এই নিবন্ধ থেকে কেমন করে বেরোনো যায় ভাবতে ভাবতে পঞ্চম কবিতাটা হাত উঁচায়া থামায় আমায়। একটু আগের এক অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের কবিতায় ভাষাবিপ্লববাজি নিয়া ব্যাকানো উক্তি করেছিলাম, মাফ-কি-জিয়ে, এই কবিতাবইয়ে ‘ভাষার উপসংহার’ নামে একটা কবিতা পাওয়া যায়, ইন্ট্রেস্টিং : “জীবদ্দশায়, ইতিহাসের পাতায় / ভাষার রাজ্য ভাষার শহর— / অলিগলি অনেক বড়ো…” পরের গোটা স্ট্যাঞ্জা জাম্প দিয়া যায়া পাবো, “সকলেই বুঝে না সকল ভাষা / কিংবা সকল ভাষার উনুনে / সকলেই রাঁধে না রূপকথা… / আসুন, আসুন— / ভাষার জন্য রাখি কিছু স্বাধীনতা… / ভাষা আছে সবুজ পাতার— / হলুদ পাতার…”। প্রমথ চৌধুরীর আগে-পরের সমস্ত ভাষাবিপ্লবের এবং ততোধিক কড়া বিপ্লবীদিগের ইঙ্গিতগুলা মাথায় ঘাই মারে। এবং হলুদ পাতার বা মরাটে-ক্ষয়াটেরও একটা ভাষা থাকে এবং সেই ভাষার জন্যে স্পেস রাখাটাও তো মাথায় রাখতে হয়, এই মিনতিটা জানা হয়া যায় যেন। কবি কী বুঝাইতে চেয়েছেন তা তো বুঝবার দরকার আমার নাই, আমি কী বুঝতে পারলাম তা-ই বিবেচ্য।

অবশ্যই। ‘বিশ্বাস’ নামে একটা কবিতার কথা বলে নিয়ে প্যাকআপের দিকে এগোব আমরা। “আমি যদি বলি পাথর হাসছে— / সে বিশ্বাস করে… / সে বিশ্বাস করে আমাকে / আর আমি কেবল সত্য হয়ে উঠি / আমি জানি / সে পাথরকে দেখে না / কেবল আমাকেই দেখে / আমি যে-বিন্দু থেকে যাত্রা করি / সেই বিন্দুতেই ফিরে আসি / আমি বলি পাথর হাসছে— / সে বিশ্বাস করে / সন্দেহ নেই— / সে আমাকে বিশ্বাস করে / কোনওভাবে / আমি আছি তার কাছে— / যে আমাকে বিশ্বাস করে।” এই কবিতার ভাবার্থ-গূঢ়ার্থ নিয়া তামাশা মাচাবার দরকার নাই হুদা। আমরা এই বইটার গোটাগুটি কিছু কবিতা পড়ে গেলাম শুধু, কোনো মূল্যাঙ্কন ছাড়া। বাগাড়ম্বরের ভটভটি, রেটোরিকের ঝনঝনি, শব্দের পটকাবাজি থেকে ঢের তফাতে কবিতাকাণ্ডটা সাধিত হয়। আমরা জানি। কিন্তু ঘটনাটা তো হররোজ ঘটে না। তাই অন্তর্বর্তীকালে এত পটকা ফাটাই।

বই-ওপেনার কবিতাটার একদম স্টার্টিং চারটা লাইন যদি ফিরে দেখি আরেকবার, যেখানে বলা হয়েছিল “যদি ভুলে যাই / মনে রেখো… / পথের ওপর হারিয়ে তোমায় / লিখছি আমি গান” — এর লগে একটা পাস্ট এক্সপেরিয়েন্স মিলিয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে আপনার। অভিজ্ঞতাটা অবশ্য পরশু-তরশুর নয়, আরও আগের, পুরাণের, অভিজ্ঞতাটা দ্য মহাভারতের। ওই-যে, মিথুনরত ক্রৌঞ্চজোড়ের একজনার তিরবিদ্ধ জুধা হবার পরেই বিস্ময়বেদনায় চিৎকারিয়া ওঠা ‘মা নিষাদ’ এবং তারপরেই পৃথিবীর অগ্রগণ্য মহান্যারেটিভটার উদ্ভব ও বিকাশ। হারানোর বেদনা থেকেই জন্ম বেদব্যাস ও বাবুলের যথাক্রমে ‘মহাভারত’ ও ‘তুমি তেমনই বৃক্ষ’ বইদ্বয়। এই কোভিডকরোনাক্রান্ত কুড়িকুড়ি খ্রিস্টাব্দ ও কৌরব-পাণ্ডব দ্বন্দ্বসংঘাতাচ্ছন্ন কুরুক্ষেত্র উভয়েই মিসমার কাতারে কাতার বেশুমার হারানোর হাহাজারিতে ব্যথায় বেদনায়। এবং এই বইয়ের, ‘তুমি তেমনই বৃক্ষ’ কবিতাবইয়ের, পঙক্তিমালায় আমরা আরও অনেক ইশারা আবিষ্কার করে ফেলি নিজেদের দায়িত্বে, কবিকে এইখানে তেমনকিছুই ইম্পোজ করে দিতে হয় নাই। বিরলদৃষ্ট এমন জাদুটোনায় আমরা আবিষ্ট ও অন্তরাপ্লুত হই বাবুলের বইবিহারের সময়।

আচ্ছা। তারপর বই-স্টপার ‘কবিতা’ শীর্ষক কবিতাটি নিয়া খানিক খেদ প্রকাশ করব কি? ঠিক কবিতাটি নিয়া না, কাব্যখণ্ড হিশেবে এর স্ট্যান্ডার্ড নিয়া আপত্তি বা আক্ষেপ নাই, কবিতাটি এই বইয়ের মিজাজের সঙ্গে আগাগোড়া সাযুজ্যপূর্ণ। যদিও কবিতার প্রশস্তি-গাওয়া কাব্য কবিতাবইয়ের আওতাভুক্ত হলে পরে ক্ষ্যাত্ মনে-হওয়া আজকের দুনিয়ায় আনন্যাচারাল নয়। এই কবিতাটা পাঠ করতে বেশ লাগে অবশ্য। শুরুতে একটা এপিগ্র্যাফিক লাইন দিয়েছেন কবি : “তা-ই কবিতা — যা আমি ভাবতে পারি না, কেবল ভাবতে পার তুমি” … বিউটিফ্যুল না লাইনটা? মাঝখানে বেশকিছু পঙক্তি নিশ্চেষ্ট সুন্দরের উজ্জ্বল উদাহরণ। অন্তিম স্তবকটাও উল্লেখযোগ্য সুন্দর। তো, খেদোক্তির জায়গাটা হচ্ছে এই বইয়ের শেষলেখা হিশেবে এর অবস্থিতি। ঠিক আগের কবিতাটা শেষে এবং শেষের কবিতা আগে — এমন প্রতিস্থাপন দিয়া আমারে হ্যাপি করা যায়। শেষের কবিতার আগেরটার নাম ‘সন্ধে হল কোথায়?’ এবং এর সিগ্নিফিক্যান্স আরেকটা মাত্রায় যেতে পারে বইয়ের অন্তিমে এর অধিষ্ঠান এনশিউর করা গেলে। এই কবিতাটা আমাদেরে অন্তর্জলী যাত্রা মনে করায়া দ্যায়। যেই বইয়ের শুরু হয় একটা আনজানা হারানোর বেদনায়, এর শেষে এ-মরজীবন সাঙ্গ করার সকৃতজ্ঞ অভিজ্ঞান জুতে দিলে যাত্রাচক্র পূর্ণ হয় :

আমাকে নামিয়ে দাও জলে…

সকাল থেকে বিকেল হল
মনের আলো কোথায় গেল—
সন্ধে হলো কোথায়?

জানতাম কি
পথের ওপর বিকেল হবে উধাও—
রাত্রি নামবে?

রৌদ্র এবং বৃষ্টির কাছে
রয়ে গেছে অনেক ঋণ…

শোধ হবে কি কোনওদিন?

দিন ও রাতের শূন্যপাতায়
ঋণের গল্প লেখে আকাশ এবং মাটি
লেখে আগুন এবং জল…
লিখতে থাকে অন্ধকারে

পথের কাছে আমার অনেক ঋণ।

শেষের দিকে আগাই। আরও অন্তত তিনটা কবিতা টাইপ করে ফেলতে পারলে ভালো হতো। সম্ভব নয়। আমার কোনো সেক্রেটারি নাই। কিন্তু কবিতাত্রয়ের নাম তো বলতে পারি। ‘কাঁটা’, ‘মানুষ, আকাশ’ এবং ‘রান্নাবান্না’। আরও আছে। এইখানে আর না। শুধু এই কথাটাই বলবার থাকে যে, এই নিবন্ধে ব্যবহৃত উদ্ধৃতিগুলার স্তবকফাঁক ও পঙক্তিবিন্যাস ঠিকঠাক দেখানো সম্ভব হলো না। আচ্ছা। আর, আরেকটা কথা, ‘তুমি’ নিয়া আলাপ সঞ্চালিত হলেও ‘বৃক্ষ’ নিয়া আলাপ করা গেল না এই নিবন্ধে। সেইজন্যে ‘তুমি, আমি’ শিরোনামের কবিতাটা পাঠের জন্যে প্রেস্ক্রাইব বা সাজেস্ট করা গেল। ফলেই পরিচয়। মানে, গোটা বইটায়।

এই বই বাংলাদেশের কোথায় কোথায় পাওয়া যায় আমার জানা নাই। ইন্ডিয়া, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের প্রকাশনাশিল্প নিয়া আমার যথেষ্ট গ্যুগলজ্ঞান থাকলেও বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্প নিয়া বা আরও স্পষ্ট বললে এর বিপণনব্যবস্থাদি নিয়া আমি বিন্দুবিসর্গও জানি না। যাদের জানা আছে তারা আমাদেরে না-জানালে এই সীমাহীন অজ্ঞানতার অন্ধকার আমার ইহজনমে ঘুচবে না। আরেকটা জিজ্ঞাসা এ-ই যে, একটা বইয়ের বহুল বেচাবিকি কামনা/দোয়া করলে এবং দোয়া ফলে গেলে লেখকের/কবির কি তাতে ফিন্যানশিয়্যাল ফায়দা কিছু হয়?

এই বইটার প্রচ্ছদ বড় সুন্দর, বড় মনোরম, বড়ই মিজাজমণ্ডিত। প্রচ্ছদচিত্র সত্যজিৎ রাজন। প্রোডাকশনটাও টাইটফিট। মুদ্রণপ্রমাদ আছে বেশকিছু, তবে সেসব অগণিত নয়, গণনীয়। মুদ্রণপ্রমাদ আর বানানবিভ্রাট একই জিনিশ নয়। এই বইয়ের ভিতর বানানবিভ্রাট বা হাল-ফ্যাশনের বানানবিপ্লব নজরে ঠেকে নাই। কিছু টাইপো না-থাকলে একটা বই লিভিং বিয়িং বলেও মনে হয় না তা আমি মানি। এই বইয়ের বেশ কয়েক জায়গায় ড্যাশ-হাইফেনের ব্যারাছ্যারা আছে যা নিয়া নেক্সট এডিশনটায় পাব্লিশারের এডিটর/প্রুফরিডের প্যানেল নিশ্চয় লেখকের লগে বসবেন।

লেখা : জাহেদ আহমদ নভেম্বর ২০২০


নিবন্ধের শিরোনামঋণ : “একমুহূর্তে ফিরিয়ে দিলে / সহজ চোখে তাকিয়ে থাকা / ওই তো তোমার চোখেই আমার / সদ্যলেখা পদ্য রাখা / পদ্যটাতে সুর ছোঁয়ালেই / গান হবে কী দুজন মিলে / সহজ কৌতূহলের অঙ্ক / চোখের ছোঁয়ায় মিলিয়ে দিলে” — কবীর সুমন

… …

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you