না-লেখা দিনের দোসর

না-লেখা দিনের দোসর

‘বিপজ্জনক ব্রহ্ম বালিকাবিদ্যালয়’ — জহর সেনমজুমদার-এর কবিতার বই। ‘বৃষ্টি ও আগুনের মিউজিকরুম’-এর পরে এইটা হাতে পেয়েছি। দীর্ঘদিন পর জহর সেনের বই — আনকোরা, অ্যাট-লিস্ট ওই সময়ের জন্য, কবিতার — ২০০৪ বা কাছাকাছি বছরের কথা বলছি, জীবনের অন্যান্য দশ-পাঁচ কারবারের মতো যদি না প্রতারণা করে স্মৃতি। মিউজিকরুম-এর অভাবিত-অসাধারণ-অলোকসামান্য আটপাতাজোড়া ভূমিকা — কবিতার থেকেও জোরালো কবিতাভাষায় রচিত, আসলে রচিত না-বলে বলা ভালো ভূমিষ্ঠ — মনে থাকবে বহুদিন আরও। দশককাল আগে, ১৯৯৭ ইসায়িতে, বেরিয়েছিল মিউজিকরুম — সো ফার উই রিমেম্বার — সম্ভবত।

দুইটাতেই — মিউজিকরুম এবং ব্রহ্ম উভয়েতেই — দীর্ঘ গদ্যকাঠামোয় লেখা কবিতা, তদুপরি ছন্দদোল ও অন্ত্যমিলে ভরপুর বুনটের অক্ষরের পর অক্ষরে রচা রোদ-ঝড়-মেঘ-বিষাদ-বিবমিষা, মহাজাগতিক মাতলামি-পাগলামি। সিগ্ন্যালের পর সিগ্ন্যাল্। স্পষ্টাক্ষরে সেই সিগ্ন্যালগুলো ধরা যায় কিংবা পার্শ্ববর্তিনীকে ধরিয়ে দেয়া যায় হাতেনাতে নগদে, এমন নয় নিশ্চয়। এইটা আলবৎ যে-কোনো উন্নত উড়ানের কবিতাবাহনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সঙ্কেতব্যবস্থাই তো কবিতার পরানভোমর। কবিতাব্যবস্থাপনায়, রিডার এবং পোয়েট উভয়ের দিক থেকেই, ক্যাশ লেনাদেনা আদৌ সুলভ নয়। একেবারেই নেই এমনও নয়, ক্যাশ ট্র্যাঞ্জেকশন্ অফ কবিতা কোডিং অ্যান্ড ডিকোডিং, বিরলদৃশ্য হলেও নগদ নারায়ণী কবিতানুবোধিনী বিরাজে এই মিস্টেরিয়াস্ ভুবনডাঙায়।

ঠিকঠাকমতো হচ্ছে না বলা। আসলে এন্ড অফ দি ডে কবিতাবিষয়ে ঠিকঠাকমতো বলা যায় না আদৌ। তবে ভেদবৈচিত্র্যবহুল বহুতর অনুমান-আন্দাজ করা যায় বৈকি। রিডার্স রেস্পোন্স বলতে, রিগ্যার্ডিং কবিতা, এই মিহি-মোটা আন্দাজগুলো।

জহর সেনমজুমদার সম্পর্কে, মানে তার কাব্যপ্রকৌশলগত অভিনবতার ব্যাপারে, বেশকিছু অব্জার্ভেশন্ — উইথ অ্যা হিউজ্ রিজার্ভেশন্স — অবশ্যই থাকবে আপনার। অন্তত জয়জাগতিক — গোস্বামী, নিশ্চয় — কবিতাপাঠের অব্যবহিত পরেই আপনার হাতে এসেছে সেনমজুমদার। মনে রাখবেন তথ্যটা। আমরা ঠিক যে-বছরে সেনমজুমদারের মিউজিকরুমে যেয়ে ঢুকছি, ইন্ নাইন্টিন্ নাইন্টিসেভেন্, দ্বিতীয় খণ্ড জয় গোস্বামী কবিতাসংগ্রহ ওই বছরেই বাজারে বেরোয়। এরও অনেক আগে, ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে, এসে গেছে জয়ের প্রথম খণ্ড কবিতাসংগ্রহ বইদোকানের শেল্ফে; যেখানে ‘প্রত্নজীব’, ‘আলেয়া হ্রদ’, ‘উন্মাদের পাঠক্রম’, ‘ভুতুমভগবান’ ছাড়াও অসঙ্কলিত কবিতার একটা উল্লেখযোগ্য জগৎ একলপ্তে দেখা সারা। আর দ্বিতীয় খণ্ডেও ‘গোল্লা’ বা ‘বজ্র-বিদ্যুৎভর্তি খাতা’ পাওয়া যাচ্ছে, যেমন ২০০০ সনের তৃতীয়ায় এসে ‘সূর্য-পোড়া ছাই’ শীর্ষক সৌরজাগতিকতা ছাড়াও ‘এক’ শীর্ষক জগজ্জীবনী; কিংবা, বাহুল্য হয় না বললে, জয়জীবনী।

কিন্তু কোনোভাবেই বলা যাবে না যে এসবের সোজাসাপ্টা নাম প্রভাব বা ইত্যাদি কিছু। বলা হচ্ছেও না। যা বলা যায় তা এতটুকুনই যে, সেনমজুমদারে দৃষ্ট জগতের পূর্বসূরি ছিল। কোনোকিছুই আল্লার দুনিয়ায় পরম্পরাহারা বা ভুঁইফোঁড় নয়। এতকিছু সত্ত্বেও বলতে হবে আপনাকে যে সেনমজুমদার আদতে এক অন্য কিসিমের কবি, মিউজিকরুম বলি কিংবা বালিকাবিদ্যালয় এক অন্যরূপায়ণের কবিতা। বালিকাবিদ্যালয় নামাঙ্কিত নতুনটিও অমনই, মিউজিকরুমের মতো। মোটা বই। অনেকদিন পর একসঙ্গে একবাঁধাইয়ের ভেতরে অনেক কবিতা। কাব্যভাঙা কাব্যঘন। পুতুপুতু নয় একটিও।

জহর সেনমজুমদারের কবিতাবিচার, কিংবা জয়ের সঙ্গে সেনমজুমদারের তুলনামূলকতা, এই নিবন্ধের অভিপ্রেত লক্ষ্য কিংবা উপলক্ষ্যও নয়। এবং কোনো উপলক্ষ ব্যাতিরেকে এই বইস্মৃতিটা চারণ করা হতেছে এখানে। এবং চটজলদি অমুকের সঙ্গে তমুকের মিলমুহব্বত ধরে কথা বলা মানুষের এক আশ্চর্য হতভম্বকর ক্ষমতা; সেই খ্যামতা নাই নিবন্ধকারের, বলা বাহুল্য। ‘ব্রহ্ম বালিকাবিদ্যালয়’ জ্যাকেটকাভার উল্টাতেই একটা লাইন চোখে পড়বে, এবং হয়তো গোটা জীবনের জন্য সঙ্গে থেকে যাবে সেই পঙক্তিটা আপনারও। উৎসর্জন, বইয়ের দ্বিতীয় পাতায় দেখা গেল, কবিরই এক বন্ধুকে, যে-বন্ধু নিজেও একজন কবি। উৎসর্জনজ্ঞাপক বাক্যটি কী দারুণ! — “আমার না-লেখা দিনের একমাত্র বন্ধু … কে” — আততায়ী একটি সত্যি বাক্য। মনে হলো। চমকে উঠেছি। অদৃশ্য কুর্নিশ করেছি এই কবিকে। এই দুই কবিকে।

সেই উৎসর্গপঙক্তির উদ্দিষ্ট কবিবন্ধুর নামটা আজ আর মনে নেই, কিন্তু পঙক্তিটুকু মনে গেঁথে গেছে দেখছি। ঈর্ষণীয় নয় কি সেই লিখনবন্ধ্যাত্বে জেরবার কবির নসিব, যিনি লিখনবন্ধ্যাকালে একজন বন্ধুকে পান পাশে, ফাঁড়া কেটে ফের ফর্শা আকাশের ফুরসতে সেই কবিটিও বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞনতজানু হন?

জহর সেনমজুমদারের কবিতাবই পরেও বেরিয়েছে বেশ গাব্দাগোব্দা খান-কতেক, ততদিনে লেখাপড়ার পাট চুকেছে এই নিবন্ধকারের চিরতরেই। কিন্তু লক্ষ করেছি দুই-তিন বছর আগেও জহরের শ্রেষ্ঠ কবিতার বই বেরিয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী থেকে। একটা ডেড দৈনিক পত্রিকার প্রকাশনা ‘কাগজ প্রকাশন’ থেকে সেই বই রিলিজ হয়েছিল। যথাপূর্ব জহরের মোটাগাট্টা বই। ইদানীং অনেককিছুই আননেসেসারি মনে হয়। এমএসওয়ার্ডের এমাথা-ওমাথা পাগলপারা কাব্যিপনাও তথৈবচ। অতটা আদৌ কল্পনাবান্ধব? অত ঘোড়া দৌড়ানো বল্গাহারা? প্রায় নিঃশব্দে যা বলা যায় না, বা অশব্দ প্রকাশের উপযোগী নয় যা, তা নিয়া হাজার হাজার শব্দস্তূপ-পঙক্তিস্তূপ দিয়া গাট্টামোটা মার্জিনের এস্পার-ওস্পার আওয়াজের সমারোহ মহাকবিতা/গ্র্যান্ডপোয়েট্রি হতে পারে, কে জানে, আমি জানি না, আল্লায় জানে। গ্র্যান্ড লিখতে/পড়তে চাইলে ঠিকাছে। এখন আপনি ডিসিশন নেন যে গ্র্যান্ডকবিতা চাই আপনার, না শুধু কবিতা? গ্র্যান্ড-মেটা বা আরও যত মোটাগাট্টা মেজার্মেন্ট দিয়া যা মাপনযোগ্য নয়, সেই কবিতা … আছে না? হালে এই কিসিমের কথাবার্তার বেইল বোধহয় হারাম নাই একেবারেই। বিলক্ষণ।

  • ব্যানারে-ব্যবহৃত বইপ্রচ্ছদের ছবিটা প্রণবেশ দাশের সৌজন্যে পাওয়া

লেখা : জাহেদ আহমদ

… …

জাহেদ আহমদ

আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you