ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কথাসাহিত্য ও কবিতায় আলাদা আদলের স্বর ও ব্যঞ্জন উপহার দিয়ে পাঠকের নিত্য ও নির্জন পড়ার পরিসরে স্থান করে নিয়েছেন যারা, রায়হান রাইন তাদের মধ্যে একজন। তার নতুন কবিতাবই ‘নিক্রোপলিসের রাত’, ২০১৭ অব্দে প্রকাশিত, বইটি প্রকাশ করেছে ‘চৈতন্য’ প্রকাশন।
আবির্ভাবসময়ের হিসাব ধরে রায়হান রাইন নব্বইয়ের দশকের কবি হিশেবেই পরিচিত। শুধু কবিতাই নয়, লেখালেখিজীবনের গোড়া থেকেই রাইন কবিতার পাশাপাশি সমান ধ্যানে নিমগ্ন রয়েছেন গদ্য ও অনুবাদ নিয়ে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের ছোটগল্পে তার সিদ্ধি প্রমাণিত হয়েছে, যেমন কবিতায় তেমনি বিশ্বের দার্শনিক অনুধ্যানাবলির সঙ্গে বাংলা পাঠকের পরিচয় তিনি নিবিড়ভাবে করিয়ে দিয়েছেন তার মাননিক গদ্যের বইগুলোর মাধ্যমে। একইসঙ্গে সৃজনশীল ও মননশীল উভয় জাতের রচনাকাজে তিনি নিজের ধ্যানমগ্ন অনুশীলনজাত পারঙ্গমতা হাজির করেছেন ইতোপূর্বে।
কবিতায় দার্শনিক বোধির বিনিয়োগে একটা আলাদা তাৎপর্য যোগ করতে রাইন সক্ষম হয়েছেন আবহমান বাংলায়। ‘নিক্রোপলিসের রাত’ বইটিও কবির সেই পৃথক বৈশিষ্ট্য উদ্ভাসনে ধীঋদ্ধ পাঠকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করবে সন্দেহ নাই। একাংশ কবিতা এইখানে দেখি :
চতুর শেয়াল
কাহিনির বন থেকে বেরিয়ে পড়েছে,
জোছনায় ধোয়া মাঠ পার হয়ে গেছে সে ভোরের দিকে হেঁটে,
এবং যেখানে আছে শারনের গোলাপ বাগান,
এবং যেখানে ফোটে মিষ্টি লিলিফুল।
আহা সুলেমান,
যে তুমি পয়গম্বর ডাইনীর বাহুডোরে শুয়ে
শুনেছ আওয়াজ অপার্থিব,
কোথাও রোদের গন্ধে বুঁদ হয়ে একটি বিকাল
মজেছে নিজেরই মদে, আর থোকা থোকা
ফুটেছে গোলাপ ফুল, শারনের গোলাপ।
রায়হান রাইনের কবিতার ধাঁচ ও ধক সম্পর্কে এইভাবে উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতি টানা যায়। একই বই থেকে, ‘নিক্রোপলিসের রাত’ কবিতাবই থেকে, আরও উদ্ধৃতি ছিঁড়িয়া আনা যায়। যেমন, এখানে আরেকটা :
সুতরাং চলো, আমরা এগিয়ে যাই,
হাওয়া হয়ে যাই আজ রাতে; কোথাও নিখোঁজ হয়ে যাই
এই সন্ধ্যাবেলা,
আমাদের পথটাকে আর এই গোধূলিকে
গুটিয়ে নিজের দেহে
গুম হয়ে যাই।
চলো, একটা গাছ হই,
ঢুকে পড়ি ধুতুরার বীজের ভেতর,
ঘাসের ঘুমের মধ্যে —
সবুজ মাংসের উষ্ণ আনন্দ আস্বাদ করা যাক।
পুরো বইটিতে এ-রকম কণ্ঠ মন্দ্র ও মৌনী এক অনাবিল ধ্বন্যালোক সৃষ্টি করেছে। এই চিৎকারজান্তব কবিতাকালে এহেন স্বরসংশ্রয় ভিন্নতর কবিতাজাগতিক বাস্তবতায় পাঠককে ডেকে নিতে চেয়েছে যেন।
দর্শনে স্নাতকোত্তর কবি রায়হান রাইন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন দুই দশকের কাছাকাছি হলো। দর্শনশাস্ত্রেরই শিক্ষক। উল্লেখযোগ্য দুটো পূর্বপ্রকাশনা ‘আকাশের কৃপাপ্রার্থী তরু’ এবং ‘তুমি ও সবুজ ঘোড়া’ ছাড়াও মনসুর হাল্লাজের ‘তা ওয়া সিন’ গ্রন্থটি বঙ্গানুবাদের মধ্য দিয়ে রাইন বাংলাভাষী পাঠকের মনোযোগ লভেছেন। প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাস ছাড়াও দর্শনকেন্দ্রী বিবিধ অনুবাদ ও সম্পাদনা।
‘নিক্রোপলিসের রাত’ বইটি ২০১৭ বইমেলায় একটা তাৎপর্যবহ প্রকাশনা হিশেবে ক্রেতাসাধারণ ও কবিতাপাঠকের কাছে বিবেচিত হয়েছে বললে বাড়াবাড়ি হবে না। বইয়ের উৎপাদনমান, ছাপা-বাঁধাই-পৃষ্ঠান্যাস-প্রচ্ছদ ও অন্যান্য মুদ্রণসৌকর্য, অত্যন্ত নয়নশোভন। চৈতন্য প্রকাশনীর পক্ষে ‘নিক্রোপলিসের রাত’ বইটি প্রকাশ করেছেন মো. জাহিদুল হক চৌধুরী রাজীব।
প্রতিবেদন / সুবর্ণ বাগচী
… …
- শরৎরাত্রিতে || আনম্য ফারহান - September 23, 2023
- হাওর সিরিজ || শামস শামীম - September 23, 2023
- জনমানসে বিরাজিত সাংস্কৃতিক সংঘাত ও মাতিয়ার রাফায়েলের কবিতা || আহমদ মিনহাজ - September 23, 2023
COMMENTS